রবিবার, ১০ আগস্ট, ২০২৫  |   ৩২ °সে
জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয় অন্যান্য

প্রকাশ : ০৮ জানুয়ারি ২০২৪, ০০:০০

একটি গৌরবদীপ্ত দীর্ঘ জীবনের অবসান

অনলাইন ডেস্ক
একটি গৌরবদীপ্ত দীর্ঘ জীবনের অবসান

চাঁদপুর জেলায় গৌরবদীপ্ত অনেক মানুষের মধ্যে হাতে গোণা কিছু মানুষই পেয়েছেন দীর্ঘজীবন, তাঁদের অন্যতম হাজীগঞ্জের বহুল পরিচিত প্রবীণ ব্যক্তিত্ব বিএম কলিম উল্লাহ। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে তিনি এক অবিস্মরণীয় নাম। কারণ, তিনি একজন সাধারণ মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন না। অসম সাহস, বীরত্বপূর্ণ কার্যক্রম, সাংগঠনিক দক্ষতা ও রণকৌশলে তিনি নিজেকে পরিণত করেছিলেন কিংবদন্তিতুল্য। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসর রাজাকার, আলবদরদের নিকট তিনি ছিলেন মূর্তিমান আতঙ্ক। তিনি মুক্তিযুদ্ধকালীন তৎকালীন চাঁদপুর মহকুমা ও সন্নিহিত থানা নিয়ে গঠিত এলাকার মুক্তিবাহিনীর সহ-অধিনায়ক ছিলেন।

তিনি ১৯১৮ সালে চাঁদপুর জেলার হাজীগঞ্জ উপজেলার গোয়ালখোড় গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত ভূঁইয়া পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা মরহুম হায়দার আলী ভূঁইয়া, মাতা মরহুমা একতের নেছা ও স্ত্রী মাহমুদা কলিম। তিনি ৮ সন্তানের জনক এবং পাঁচ ভাই-বোনের মধ্যে ছিলেন চতুর্থ। তিনি শিক্ষার্থী হিসেবে ছিলেন মেধাবী। হাজীগঞ্জ হাই স্কুল থেকে ১৯৪৮ সালে ম্যাট্রিকুলেশন ও চাঁদপুর কলেজ থেকে ১৯৫০ সালে ইন্টারমেডিয়েট পাস করেন। ১৯৫২ সালে ঢাকার জগন্নাথ কলেজ থেকে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন এবং ভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন।

তিনি ছিলেন এমন এক বিরল ব্যক্তিত্ব, যিনি দেশের গৌরবজনক দুটি আন্দোলন ভাষা আন্দোলন ও স্বাধীনতা আন্দোলনে অগ্রসেনানী হিসেবে অংশ নেয়ার সৌভাগ্য অর্জন করেছিলেন। তিনি কলেজে পড়ার সময় ছাত্র রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন এবং ভাসানী ন্যাপে যোগদান করেন। ভাসানী ন্যাপ জাতীয় নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করে স্লোগান তোলে ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধর, পূর্ব বাংলা স্বাধীন কর'।

মেহনতি মানুষের বন্ধু হিসেবে তিনি কমরেড খ্যাতি পেয়েছিলেন। তিনি ভাসানী ন্যাপের পতাকা নিয়ে ১৯৬৮ সাল থেকেই গোপনে গোপনে পশ্চিম পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রামের প্রস্তুতি শুরু করেন। সেই সময় থেকে তিনি ভাসানী ন্যাপের সশস্ত্র ক্যাডারদের প্রশিক্ষণ দিতেন। তিনি ১৯৭১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে দেশের পরিস্থিতি বুঝে তাঁর সশস্ত্র ক্যাডারদেরকে নিয়ে হাজীগঞ্জ থানার অস্ত্র লুট করে হস্তগত করেন। ওই দিন তিনি হাজীগঞ্জ থানা থেকে ৬টি রাইফেল ও কিছু বুলেট সংগ্রহ করেন। ১৯৭১-এর ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ভাষণের দিকনির্দেশনা অনুযায়ী তিনি হাজীগঞ্জের ডাঃ আবদুস সাত্তার, তাফাজ্জল হায়দার নসু চৌধুরী, আবদুর রব মিয়া, আলী আহমেদ দিগচাইল, আঃ মান্নান বিএসসিসহ আরো অনেক স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও অন্যান্য দলের নেতাদেরকে নিয়ে হাজীগঞ্জে সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ গঠন করে মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে থাকেন। কিছুদিন পর তাঁর যোগ্য নেতৃত্বে চাঁদপুরের শত শত ছাত্র-জনতা মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। তিনি তাঁর উদ্ভাবিত নিত্য নতুন রণকৌশল, সাংগঠনিক ক্ষমতা এবং আধুনিক গোয়েন্দা কার্যক্রম দ্বারা চাঁদপুরে পাকিস্তানের ৩৯তম ডিভিশনের হেডকোয়ার্টারের প্রধান মেজর জেনারেল রহিম খানের মতো বিখ্যাত পাকিস্তানি সমরনায়ককে নাস্তানাবুদ করেন।

স্বাধীনতোত্তর বাংলাদেশে তিনি নিতান্তই রাজনৈতিক তৎপরতায় না থেকে দেশের কল্যাণে নানা গঠনমূলক কাজে অংশ নেন, বেশ ক'টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ায় মনোনিবেশ করেন এবং ধর্মীয় কাজে আত্মনিবেদন করেন। তিনি বিভিন্ন নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন এবং সমাজসেবামূলক কাজে নিজেকে জড়িয়ে রাখেন। নানাবিধ ব্যস্ততায় তিনি সুস্থতার সাথে দীর্ঘজীবন লাভ করেন। তবে নবতিপর বয়সে তিনি চলে যান ঢাকায় এবং যথাযথ চিকিৎসায় শতায়ু হয়ে গৌরবদীপ্ত জীবনকে প্রলম্বিত করার সুযোগ পান। অবশেষে গত ৫ জানুয়ারি ২০২৪ শুক্রবার রাত ১২টা ৯ মিনিটে ঢাকার একটি হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ১০৬ বছর। শুক্রবার বাদ জুমআ হাজীগঞ্জ ঐতিহাসিক বড় মসজিদে প্রথম জানাজা এবং নিজ গ্রাম গোয়ালখোড় ভূঁইয়া বাড়ির সামনে দ্বিতীয় জানাজাশেষে পারিবারিক কবরস্থানে বাদ আসর দাফন করা হয়। তাঁকে হাজীগঞ্জ উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদাস্বরূপ গার্ড অব অনার প্রদান করা হয়। প্রথম জানাজার পর সর্বস্তরের জনসাধারণের শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্যে মসজিদ মাঠে তাঁর মরদেহ রাখা হয়।

গৌরবদীপ্ত দীর্ঘজীবনের অধিকারী বিএম কলিম উল্লাহর মৃত্যু ঘটেছে সপ্তাহের সবচে’ পবিত্রদিন শুক্রবারে এবং তিনি বাদ জুমআ হাজীগঞ্জ ঐতিহাসিক বড় মসজিদে পেয়েছেন সর্বস্তরের মানুষের অংশগ্রহণে বিশাল জানাজা, রাষ্ট্রীয় মর্যাদা ও দলমত নির্বিশেষে সকল মানুষের শ্রদ্ধা। এমন সৌভাগ্য খুব কমসংখ্যক মানুষের জীবনেই ঘটে। আমরা এই মহান ব্যক্তিত্বের জীবনাবসানে চাঁদপুর কণ্ঠ পরিবারের পক্ষ থেকে গভীর শোক প্রকাশ করছি, মরহুমের বিদেহী আত্মার মাগফেরাত কামনা করছি এবং শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি আন্তরিক সমবেদনা জানাচ্ছি।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়