রবিবার, ২৭ জুলাই, ২০২৫  |   ৩১ °সে
জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয় অন্যান্য

প্রকাশ : ২৭ জুলাই ২০২৫, ০৯:০৯

অস্থিরতার মুখে বাংলাদেশ : বিকল্প রাজনীতি নাকি পুঃনপ্রতিষ্ঠিত সংঘাত

রহমান মৃধা
অস্থিরতার মুখে বাংলাদেশ : বিকল্প রাজনীতি নাকি পুঃনপ্রতিষ্ঠিত সংঘাত

২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টের গণঅভ্যুত্থান যেন এক অনিবার্য বিস্ফোরণের ফল। শেখ হাসিনা সরকারের বিরুদ্ধে শিক্ষার্থীদের নেতৃত্বে যে গণআন্দোলন শুরু হয়েছিল, তা শেষ পর্যন্ত এক রক্তাক্ত সন্ধিক্ষণের দিকে গড়ায়। শেখ হাসিনার নির্দেশে নিরাপত্তা বাহিনীর গুলিতে শিশু ও সাধারণ নাগরিকসহ প্রায় ১৪০০ জন নিহত হয় বলে জাতিসংঘের প্রতিবেদনে উল্লেখ রয়েছে। তবে সেনাবাহিনী এই গণবিধ্বংসী আদেশ মানতে অস্বীকৃতি জানিয়ে একটি মোড় পরিবর্তনের সূচনা করে। ৫ আগস্ট, ২০২৪Ñমাত্র ৪৫ মিনিটের নোটিসে শেখ হাসিনা গণভবন ত্যাগে বাধ্য হন। এই মুহূর্তটি একদিকে যেমন স্বস্তির নিঃশ্বাস এনে দেয়, অন্যদিকে তেমনি এক গভীর অনিশ্চয়তার দ্বার উন্মোচন করে। শেখ হাসিনা সরকারের পতন একটি পরবর্তী ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার সুযোগ সৃষ্টি করে, কিন্তু একই সাথে তৈরি করে এক জটিল রাজনৈতিক, আদর্শিক এবং সামাজিক দ্বন্দ্বের নতুন ক্ষেত্র।

ড. ইউনূস ও উত্তরণের সম্ভাবনা

ড. মুহাম্মদ ইউনূস এই সংকটকালে এক বিকল্প নেতৃত্বের প্রতীক হয়ে ওঠেন। জাতিসংঘের মানবাধিকার সংস্থা (ঙঐঈঐজ)কে তদন্তে যুক্ত করা, বিভিন্ন সংস্কার কমিশন গঠন এবং প্রশাসনিক ও আর্থিক দুর্নীতির ওপর হোয়াইট পেপার প্রকাশের মাধ্যমে তিনি এক স্বচ্ছ ও জবাবদিহিমূলক রাষ্ট্র কাঠামোর সূচনা করেন। তবে সাম্প্রতিক রাজনৈতিক অস্থিরতা, নীতিগত জটিলতা এবং প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে প্রশাসনিক অনীহার কারণে ড. ইউনূস নিজেই দেশ পরিচালনার প্রতি অনাগ্রহ প্রকাশ করেছেন। এই অবস্থান উত্তরণের সম্ভাবনাকে যেমন দুর্বল করে তুলছে, তেমনি নতুন করে অনিশ্চয়তার ছায়া ফেলছে রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার ওপর।

তাঁর সামনে এখন দুটি বড়ো চ্যালেঞ্জÑএকদিকে অসহিষ্ণু ও সাম্প্রদায়িক শক্তির পুনরুত্থান, অন্যদিকে মুক্তিযুদ্ধ ও গণতন্ত্রের আদর্শকে বিকৃত করে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার কৌশলী অপপ্রয়াস। বিএনপি, জামায়াত এবং নতুন গঠিত ছাত্রনেতৃত্বভিত্তিক রাজনৈতিক শক্তির মিলিত ছায়ায় এক ধরণের ইতিহাস পুনর্লিখনের প্রবণতা দিন দিন স্পষ্ট হয়ে উঠছে। জামায়াত ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধকে ‘ভুল যুদ্ধ’ আখ্যা দিয়ে নিজেদের ‘ভুক্তভোগী’ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে চায়, যা জাতীয় অস্তিত্বের মৌলিক ভিত্তিতে আঘাত হানছে। বঙ্গবন্ধুর বাড়ি ভাংচুর, ১৯৭২ সালের সংবিধান বাতিলের দাবিÑএসব নিছক ঘটনা নয়; বরং তা বাংলাদেশের রাজনৈতিক ভূচিত্র নতুন করে আঁকার সচেতন অপচেষ্টা।

সেনাবাহিনী : নিরপেক্ষতা না কি নিয়ন্ত্রিত অংশগ্রহণ?

সেনাবাহিনী এই সংকটে যে নিরপেক্ষতা দেখিয়েছে, তা একদিকে আশাব্যঞ্জক হলেও অন্যদিকে অনেক প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। অতীতে ১৯৯০ সালে এরশাদের পতন কিংবা ২০০৭ সালে সেনা-সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উদ্ভবেও সেনাবাহিনীর একই ধরনের ভূমিকায় দেখা গিয়েছিল। তবে ২০২৪ সালে এই প্রতিষ্ঠানটির নীরবতা এবং গোপন তৎপরতাÑবিশেষ করে রাজনৈতিক শৃঙ্খলাজনিত ক্ষেত্রগুলোতেÑনতুন করে বিশ্লেষণের দাবি রাখে।

যখন রাষ্ট্রের প্রধান নির্বাহী গণহত্যার নির্দেশ দেয় এবং বেসামরিক প্রশাসন ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী তা কার্যকর করতে প্রস্তুত থাকে, তখন সেনাবাহিনীর ভূমিকা শুধু নিরাপত্তার নিশ্চয়তা নয়, রাষ্ট্রের নৈতিক দিকনির্দেশক হিসেবেও কাজ করে। এই মুহূর্তে, নির্বাচনের জন্যে যেভাবে তড়িঘড়ি চলছেÑতা এই প্রশ্ন তোলে, সেনাবাহিনী কি সত্যিই ‘নিরপেক্ষ’? না কি একটি নির্ধারিত গেমপ্ল্যানের অংশ হয়ে কোনো বিশেষ পক্ষের জন্যে সময় ও প্রেক্ষাপট তৈরি করছে?

নির্বাচন : গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার উপায় না ছলনাময় প্রতিযোগিতা?

বর্তমান সরকার একটি দ্রুত নির্বাচন আয়োজনের যে পদক্ষেপ নিচ্ছে, তা স্পষ্টভাবে রাজনৈতিক বৈধতা অর্জনের এক কৌশল। কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায়Ñযে রাষ্ট্র এখনো ভেঙ্গে পড়া প্রশাসনিক কাঠামো, বিভক্ত সমাজ ও রাজনৈতিক সহিংসতার মুখোমুখি, সে রাষ্ট্রে দ্রুত নির্বাচন আদৌ কার্যকর ও অংশগ্রহণমূলক হবে তো?

ড. ইউনূস ও তাঁর তত্ত্বাবধায়ক প্রশাসন কি এক পদ্ধতিগত এবং ইনস্টিটিউশনাল পুনর্গঠনের জন্যে যথেষ্ট সময় পাচ্ছেন? না কি একটি ‘গণতান্ত্রিক রূপকথা’ তৈরি করে দ্রুত আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি অর্জনের তাগিদে তারা নিজেই এক ছলনাময় খেলায় জড়িয়ে পড়ছেন?

আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপট ও বহির্বিশ্বে প্রভাব বিস্তার : ভারতের একচোখা নীতি ও প্রবাসী রাজনীতির উত্তাপ

বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক সংকটে ভারতের ভূমিকা, বিশেষ করে মোদি সরকারের আওতাধীন রাষ্ট্রযন্ত্রের একচোখা অবস্থান, দিন দিন এক উগ্র বৈদেশিক বিভাজনের জন্ম দিচ্ছে। শেখ হাসিনা সরকারের গণবিরোধী দমননীতি, নির্বাচন প্রহসন এবং মানবাধিকার লঙ্ঘন ভারত যেভাবে উপেক্ষা করেছে বা সমর্থন করেছে, তা বাংলাদেশের জনগণের মাঝে ভারতের প্রতি গভীর অবিশ্বাস সৃষ্টি করেছে। ভারতের শাসকদলের মিডিয়া ট্রোল, প্রাক্তন কূটনীতিকদের নেতিবাচক বক্তব্য, এবং বাংলাদেশে ড. ইউনূসের নেতৃত্বাধীন উদারপন্থী পরিবর্তনশীল শক্তির প্রতি নির্লজ্জ বিরূপতা শুধু রাজনৈতিক কূটচালের বহিঃপ্রকাশ নয়, বরং একপ্রকার আধিপত্যবাদী মনোভাবও প্রকাশ করে। বিপরীতে, এই অবিশ্বাস পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নের একটি সম্ভাব্য ক্ষেত্র তৈরি করেছেÑযদিও পাকিস্তান বর্তমানে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে ভঙ্গুর। তবে ঐতিহাসিকভাবে ১৯৭৫-পরবর্তী বাংলাদেশে ভারতের বিকল্প প্রতিপক্ষ হিসেবে পাকিস্তানকে ব্যবহার করার প্রবণতা আবার মাথাচাড়া দিচ্ছে, যা সাম্প্রতিক প্রেক্ষাপটে রাজনৈতিক প্রতীকীতা হিসেবেই বেশি তাৎপর্যপূর্ণ।

এই পরিস্থিতিতে আন্তর্জাতিক ভূরাজনীতিও বাংলাদেশকে কেন্দ্র করে এক নতুন ব্যালান্স অফ পাওয়ার নির্মাণে ব্যস্ত। যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের প্রভাব, ভারত-ইন্দো-প্যাসিফিক নীতির বাস্তবায়ন, এবং রিজিওনাল জোট যেমন ইওগঝঞঊঈ ও অঝঊঅঘ-এর ভূমিকাও বাংলাদেশের প্রতি আন্তর্জাতিক আগ্রহ বাড়িয়ে তুলছে। এই প্রেক্ষাপটে প্রবাসী বাংলাদেশী জনগোষ্ঠী, বিশেষ করে পশ্চিমা বিশ্বে অবস্থানরত ডায়াসপোরা, একটি বিকল্প জনমত গড়ে তুলছে। এই ডায়াসপোরিক প্রভাব এখন শুধু সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সীমাবদ্ধ নয়, তারা বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মানবাধিকার ফোরামে, জাতিসংঘের অধিবেশনে এবং বৈদেশিক পার্লামেন্টারি লবিংয়েও সক্রিয়ভাবে অংশ নিচ্ছে। ফলে দেশের রাজনীতিতে তাদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রভাব ক্রমেই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে।

সাংস্কৃতিক মেরুকরণ ও স্মৃতির রাজনীতি,

ইতিহাস পুনঃলিখনের রাজনীতি ও সামাজিক অপসৃয়ণ

সামাজিক মাধ্যমে পরিচালিত বিদ্বেষমূলক প্রচারণা, কিছু প্রবাসী ইনফ্লুয়েন্সারদের উসকানি এবং তথাকথিত ‘নৈতিক পুলিশ’-এর আবির্ভাবÑসবকিছু মিলে একটি প্রতিক্রিয়াশীল, একমুখী ও বিভাজনমূলক সমাজের সূচনা করছে। যারা মুক্তিযুদ্ধ, ধর্মনিরপেক্ষতা ও বহুত্ববাদে বিশ্বাস করেÑতারা এখন নিজ দেশেই কোণঠাসা। নতুন শাসনব্যবস্থা একটি কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখেÑতাদের হয় নিরপেক্ষ, মানবিক ও গণতান্ত্রিক পথে চলতে হবে, না হয় আবারও এক অসহিষ্ণু, একনায়কতান্ত্রিক ঘূর্ণিতে ফিরে যেতে হবে।

এই মুহূর্তে বাংলাদেশ যে সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে, তার ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে রাজনৈতিক নেতৃত্বের প্রজ্ঞা, সেনাবাহিনীর সদিচ্ছা এবং জনগণের অংশগ্রহণের ওপর। ইতিহাস আমাদের শিক্ষা দেয়, জনতার ইচ্ছার বিরুদ্ধে কোনো শাসন দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে না। কিন্তু এই ইচ্ছার সঠিক ব্যাখ্যা এবং কার্যকর রূপায়ণ ব্যর্থ হলে, বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ শুধু বিভ্রান্ত অতীতের পুনরাবৃত্তি নয়, বরং এক গভীর অনিশ্চয়তা ও প্রতিক্রিয়াশীল দুঃস্বপ্নে রূপ নিতে পারে।

রহমান মৃধা : গবেষক এবং লেখক; সাবেক পরিচালক, ফাইজার, সুইডেন।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়