বৃহস্পতিবার, ২৬ জুন, ২০২৫  |   ৩১ °সে
জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয় অন্যান্য

প্রকাশ : ২৬ জুন ২০২৫, ০৮:৪২

ভাই কখনো আপন হয় না

হাসান আলী
ভাই কখনো আপন হয় না

আদি পিতা হযরত আদম (আ.)-এর দু ছেলে হাবিল এবং কাবিল। কাবিল হত্যা করে হাবিলকে। এভাবেই পৃথিবীতে প্রথম রক্তপাতের মধ্য দিয়ে ভাইয়ের সাথে ভাইয়ের বিবাদ সৃষ্টি হয়।

হযরত ইয়াকুব (আ.)-এর পুত্ররা তাদের ছোট ভাই হযরত ইউসুফ (আ.)কে শিশু বয়সে হত্যার উদ্দেশ্যে গভীর কূপে ফেলে দেয়।

অটোমন সাম্রাজ্যে ১৫৯৫ সালে সুলতান মুরাতের (৩য়) মৃত্যুর পর তার সিংহাসনের ক্ষমতা পুত্র মেহমেতের হাতে অর্পণ করা হয়। সুলতান মেহমেত (তৃতীয়) রাজপ্রাসাদে থাকা ১৯জন রাজকুমারকে হত্যা করেন, যারা ছিলো তার ভাই।

ভারতের মুঘল সম্রাট শাহজাহানের ছেলে সম্রাট আওরঙ্গজেব তার সব ভাইকে হত্যা করে এবং বৃদ্ধ পিতাকে আমৃত্যু বন্দী করে রাখে।

লঙ্কার রাজা রাবণ তার সৎ ভাই কুবেরের কাছ থেকে লঙ্কা রাজ্য দখল করে নিয়েছে। রাবণের সাথে লঙ্কায় ভগবান রামের যুদ্ধের সময় বিভীষণ রামের পক্ষ অবলম্বন করে। বিভীষণ ছিলো রাবণের আপন ছোট ভাই।

কর্ণ মহাভারতে বর্ণিত সর্বশ্রেষ্ঠ যোদ্ধাদের অন্যতম। তিনিই ছিলেন একমাত্র যোদ্ধা যিনি মহাভারতের অপর শ্রেষ্ঠ যোদ্ধা অর্জুনকে যুদ্ধে পরাজিত করতে সক্ষম ছিলেন। কর্ণ ছিলেন সূর্য দেব ও কুন্তীর সন্তান এবং সেই সূত্রে পাণ্ডবদের বড়ো ভাই। ভাগ্যচক্রে কৌরব রাজকুমার দুর্যোধনের ঘনিষ্ঠতম মিত্রে পরিণত হন। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে তিনি কৌরবদের পক্ষে নিজ ভাই পাণ্ডবদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেন এবং নিহত হন। কর্ণের শেষকৃত্য সম্পাদন করে দুর্যোধন।

জার্মানীর ডেসলার ব্রাদার্স সু ফ্যাক্টরির মালিক ছিলেন রুডলফ ও অ্যাডলফ নামের দুই ভাই। নিজেদের মধ্যে ঝগড়া-বিবাদ শুরু হলে তারা আলাদা হয়ে যান। রুডলফ তৈরি করেন পুমা ব্র্যান্ড আর অ্যাডলফ তৈরি করেন এডিডাস ব্র্যান্ড। সু-ফ্যাক্টরী ভাগাভাগির দিন দু ভাই মুখোমুখি বসেছিলেন, তারপর আর কোনোদিন তাদের দেখা কিংবা কথা হয়নি। একই কবরস্থানে সমাহিত হতে দু ভাই আপত্তি করেছিলেন। ফলে তাদের দুজনকে আলাদা আলাদা কবরস্থানে সমাহিত করা হয়।

গ্রীক মিথলজিতে বিবাহিতা ইফিমেডিয়া প্রেমে পড়েন সমুদ্র দেব পসাইডনের সাথে। তাদের মিলনে জন্ম লাভ করে জমজ পুত্র এফিয়ালটেস এবং ওটাস । দেবী আর্টিমিসের সাথে কে আগে মিলিত হবে এই দ্বন্দ্বের কারণে একে অপরকে তীর নিক্ষেপে হত্যা করে।

অ্যাট্রিয়াস গ্রীক মিথলজিতে পেলোপসের পুত্র। অ্যাট্রিয়াস মাইসিনের রাজা হন এবং তার ভাই থিয়েস্টেসকে রাজ্য থেকে তাড়িয়ে দেন।

ভারতের মধ্য প্রদেশে দুই ভাইয়ের ঝগড়া এমন অবস্থায় পৌঁছে যে, পিতার শেষ কৃত্য সম্পাদনে মরদেহ সমান দু ভাগে ভাগ করে দেবার দাবি উঠে। ধ্যানী সিং ঘোষ (৮৪) থাকতেন ছোট ছেলে দেশরাজের সাথে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হস্তক্ষেপে ধ্যানী সিং ঘোষের শেষ কৃত্য সম্পাদনের সুযোগ পায় ছোট ছেলে দেশরাজ।

বাংলাদেশের জনপ্রিয় অভিনেতা এটিএম শামসুজ্জামানের এক ছেলে আরেক ছেলেকে হত্যা করে।

একই মায়ের পেটে জন্ম হলেও স্বার্থের দ্বন্দ্বে এক ভাই অপর ভাইয়ের শত্রু হিসেবে দাঁড়িয়ে যায়। জন্মের পর থেকেই একে অপরকে সহ্য করতে পারে না। শৈশবে কৈশোরে খাবার দাবার, জামা-জুতা, খেলার সরঞ্জাম, বইপত্র, কাগজ, কলম নিয়ে মনোমালিন্য শুরু হয়। পরিবারের সিনিয়র সদস্যরা বাচ্চাদের বুঝিয়ে শুনিয়ে, শাসন করে, ধমক দিয়ে, মারধর করে নিয়ন্ত্রণে রাখে। সাময়িকভাবে কিছুটা দমে গেলেও মনের মধ্যে রাগ-ক্ষোভ পুষতে থাকে। কম বয়সে ভাইকে দরকার সাহায্য পেতে, ভয় কাটাতে, খেলার সঙ্গী হিসেবে, নিঃসঙ্গতা দূরীকরণে, ঝগড়া-বিবাদ করতে, মা-বাবাকে ফাঁকি দিতে, শক্তিশালী ভাব বজায় রাখতে। বয়স বাড়তে শুরু করলে, নির্ভরতা কাটতে থাকলে, স্বাধীনতার ছোঁয়া পেলে ভাইয়ের সাথে দূরত্ব বাড়তে থাকে।

একটা সময়ে আমাদের পরিবারে ভাই-বোনের সংখ্যা বেশি ছিলো। বড়ো ছেলে মা-বাবা, পরিবার পরিজনের স্নেহ-মমতা, আদর-সোহাগে একচেটিয়া অধিকার পেয়ে থাকে। মেজো ছেলে জন্মের পর বড়ো ছেলে মা-বাবার মনোযোগ, স্নেহ-মমতা, আদর-সোহাগ থেকে খানিকটা বঞ্চিত হতে থাকে। সেজো ছেলে জন্ম লাভের পর মেজো তার অবস্থান ধরে রাখতে বড়ো ভাই ও ছোট ভাইয়ের সাথে ঝগড়া বিবাদে লিপ্ত হয়ে উঠে। সংসারে বড়ো ছেলেরা সাধারণত গড় মানের হয়ে থাকে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বড়োভাই পিতার সংসারের দায়িত্ব গ্রহণ করে। লেখাপড়া আয়-রোজগারে তুলনামূলকভাবে পিছিয়ে থাকে। বেশিরভাগ পরিবারে মেজো ছেলে আয় রোজগারে, ব্যবসা বাণিজ্য, চাকরি বাকরি, লেখাপড়ায়, পদ-পদবীতে খুবই ভালো অবস্থানে থাকতে দেখা যায়। আবার ব্যতিক্রম হিসেবে বড়ো ছেলেরা বড়ো জায়গায় থাকতে দেখা যায়। একইভাবে সেজো, ছোটরা কোনো কোনো ক্ষেত্রে অনেক ভালো কিছু করে। ভাইদের মধ্যে আয়-রোজগারে, ক্ষমতায় যিনি এগিয়ে থাকেন তিনি পরিবারের সদস্যদের কল্যাণে সব থেকে বেশি টাকা-পয়সা খরচ করেন এবং পরিবারের নেতৃত্বে থাকেন। পারিবারিক সহায়-সম্পদ বিলি-বন্টনকে কেন্দ্র করে প্রত্যেক পরিবারে কিছু না কিছু মনোমালিন্য তৈরি হয়।

কোনো কোনো পরিবারে ছোট ছেলে সারা জীবন ছোটই থেকে যায়। তারা ভাই-বোনদের সাহায্য সহযোগিতা নিয়ে জীবনযাপন করে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ছোট ভাইয়েরা বড়োদের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করে। সংবাদপত্র, টিভি, সোশ্যাল মিডিয়া এবং আশপাশের দিকে তাকালে আমরা দেখতে পাই, ছোট ভাইয়েরা বড়ো ভাইকে আক্রমণ করেছে । খুবই অল্প সংখ্যক ঘটনায় বড়ো ভাইদের হাতে ছোট ভাইয়েরা আক্রান্ত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে।

গ্রামে প্রবাদ আছে, ভাইয়ের শত্রু ভাই, মাছের শত্রু চাঁই। ভাই যে কখনো আপন হয় না তা আমাদের বাপ-চাচাদের দিকে তাকালেই বোঝা যায়। আমরা আপন ভাইদের ত্রুটি-বিচ্যুতি মানতে পারি না, ক্ষমা করতে জানি না, সম্পর্ক রাখতে চাই না, দায়সারা গোছের সম্পর্ক বজায় রাখি, দায়িত্বপালন করি দয়া করে, হিসাব নেই কড়ায় গণ্ডায়, আঘাত করি নিষ্ঠুরভাবে, কথা হয় না বছরের পর বছর ধরে, অপমান করতে দ্বিধাবোধ নেই, সম্পদ হাতিয়ে নিতে সিদ্ধহস্ত, বোনদের বঞ্চিত করতে একাট্টা, উপকার করে খোঁটা দেই, কষ্টে থাকলে ভালো লাগে, ক্ষতি করে আনন্দ পাই, দেখা হলে রাগ উঠে, রাগ উঠলে খুন করি।

ভাইয়ের সাথে ভাইয়ের সম্পর্কের অবনতি চূড়ান্ত বিচারে সামাজিক অবক্ষয়ের নিষ্ঠুর ছবি।আপন ভাই, মামাতো, ফুফাতো, চাচাতো, খালাতো ভাইদের সাথে দুর্বল সম্পর্ক রেখে একটি ন্যায়ভিত্তিক মর্যাদাপূর্ণ সমাজ বিনির্মাণ প্রায় অসম্ভব। ভাইদের সাথে আন্তরিক মর্যাদাপূর্ণ সম্পর্ক ভবিষ্যতে বার্ধক্যের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সহায়ক ভূমিকা পালন করবে। বার্ধক্যের কঠিন দিনগুলোতে পারিবারিক এই বন্ধন, সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক প্রবীণকে মানসিক ও শারীরিকভাবে সক্ষম রাখতে সহায়তা করবে।

একটি প্রবীণবান্ধব সমাজের স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে চাইলে সর্বপ্রথম ভাইদের সাথে সম্পর্কের উন্নয়ন ঘটাতে হবে। ভাই কখনো আপন হয় না, আপন করে নিতে হয়।

লেখক : প্রবীণ বিষয়ে লেখক, গবেষক ও সংগঠক।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়