মঙ্গলবার, ১০ জুন, ২০২৫  |   ২৯ °সে
জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয় অন্যান্য

প্রকাশ : ০৯ জুন ২০২৫, ১৩:৫৭

স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় সিরাজুল আলম খানের অবদান অনস্বীকার্য. :সারোয়ার ওয়াদুদ চৌধুরী

অনলাইন ডেস্ক
স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় সিরাজুল আলম খানের অবদান অনস্বীকার্য. :সারোয়ার ওয়াদুদ চৌধুরী

নিউক্লিয়াসের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা, স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার কিংবদন্তিতুল্য সংগঠক, সৎ সাহসী, নির্ভীক, নিঃস্বার্থ, নিবেদিত দেশপ্রেমিক সিরাজুল আলম খানের অবদান অনস্বীকার্য ও অবিস্মরণীয়। দ্বিতীয় মৃত্যুবার্ষিকীতে জাতির সূর্য সন্তান সিরাজুল আলম খানের অমর আত্মার শান্তি কামনা করে শোকাহত স্বজন ও গুণগ্রাহীদের প্রতি গভীর সমবেদনা জ্ঞাপন করছি।

সিরাজুল আলম খান ৬ জানুয়ারি ১৯৪১ সালে নোয়াখালী জেলার বেগমগঞ্জে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা খোরশেদ আলম খান ও মা সৈয়দা জাকিয়া খাতুনের দ্বিতীয় সন্তান তিনি। তাঁরা পাঁচ ভাই ও তিন বোন। পিতা খোরশেদ আলম খান এডিনবরায় (স্কটল্যান্ড) পড়াশোনা শেষে স্কুল পরিদর্শক হিসেবে তাঁর কর্মজীবন শুরু করেন। তিনি সরকারি কর্মকর্তা হওয়ায় বিভিন্ন জায়গায় বদলি হয়ে যেতেন। তাই শৈশবের বেশির ভাগ সময় তিনি নোয়াখালী থেকে দূরে ছিলেন। সিরাজুল আলম খান বলতেন, শৈশব থেকেই বাবাই তাঁর পরামর্শদাতা ছিলেন।

১৯৫৬ সালে খুলনা জিলা স্কুল থেকে অসামান্য কৃতিত্বের সঙ্গে ম্যাট্রিকুলেশন (এসএসসি) পাস করেন সিরাজুল আলম খান। এরপর ঢাকা কলেজ থেকে বিজ্ঞান শাখায় উচ্চ মাধ্যমিক পাস করে ১৯৫৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গণিত বিভাগে সম্মান শ্রেণিতে ভর্তি হন। তিনি ফজলুল হক হলে থাকতেন।

‘কনভোকেশন মুভমেন্টে’ অংশগ্রহণ করার কারণে গণিতে স্নাতক ডিগ্রি নেওয়ার পর তাঁকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করা হয়। প্রতিদিন রাত করে হলে ফিরতেন তিনি। ফলে হল থেকেও একবার বহিষ্কৃত হন। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করায় তাঁর পক্ষে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নেওয়া সম্ভব হয়নি।

১৯৬৩ সালের শেষদিকে ‘কনভোকেশন মুভমেন্টের’ কারণে তিনি গ্রেপ্তার হন। ১৯৭৬ সালেই জিয়াউর রহমানের আমলে তিনি গ্রেপ্তার হন এবং ১৯৭৯ সালে মুক্তি পান।

সর্বশেষ ১৯৯২ সালে বিদেশ যাওয়া আগে ঢাকা বিমানবন্দর থেকে ২৪ মার্চ সিরাজুল আলম খানকে গ্রেপ্তার করা হলে চার মাস পর হাইকোর্টের রায়ে মুক্তি পান।

ভিন্ন ভিন্ন তিন মেয়াদে প্রায় সাত বছর কারাভোগ করেন তিনি।

দীর্ঘ কারাজীবনে তিনি দর্শন, সাহিত্য, শিল্পকলা, রাজনীতি-বিজ্ঞান, অর্থনীতি, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক, সমাজবিজ্ঞান, পরিবেশবিজ্ঞান, সামরিক বিজ্ঞান, মহাকাশ বিজ্ঞান, সংগীত, খেলাধুলা নিয়ে ব্যাপক পড়াশোনা করেন।

রাষ্ট্রবিজ্ঞানের উপর গড়ে উঠে তাঁর অগাধ পাণ্ডিত্য এবং দক্ষতার কারণে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা না থাকলেও তিনি ১৯৯৬-৯৭ সালে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক নিযুক্ত হন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উইসকনসিন রাজ্যের ওশকোশ বিশ্ববিদ্যালয়ে।

আর্থ-সামাজিক বিশেষণে সিরাজুল আলম খানের তাত্ত্বিক উদ্ভাবন বাংলাদেশের রাজনীতিতে এক নতুন অধ্যায়। মার্কসীয় ‘দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ’র আলোকে বাংলাদেশের জনগণকে শ্রমজীবী-কর্মজীবী-পেশাজীবী হিসেবে বিভক্ত করে ‘রাষ্ট্রীয় রাজনৈতিক’ মডেল হাজির করেছেন সিরাজুল আলম খান। চিরাচরিত পার্লামেন্টারি ধাঁচের ‘অঞ্চল ভিত্তিক’ প্রতিনিধিত্বের পাশাপাশি শ্রম, কর্ম, পেশায় নিয়োজিত সমাজ শক্তি সমূহের ‘বিষয় ভিত্তিক’ প্রতিনিত্বের ব্যবস্থা সংবলিত ‘দুই কক্ষ’ বিশিষ্ট পার্লামেন্ট গঠন, ফেডারেল সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তন, বাংলাদেশকে কয়েকটি প্রদেশে ভাগ করে প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচন এবং প্রাদেশিক সরকার গঠন, উপজেলা পর্যায়ে স্ব-শাসিত স্থানীয় সরকার পদ্ধতি চালু করার মধ্য দিয়ে ব্রিটিশ-পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক আইন ব্যবস্থা ও শাসন কাঠামোর পরিবর্তে স্বাধীন দেশের উপযোগী শাসন ব্যবস্থা গড়ে তোলার মডেল উত্থাপন করেন তিনি। বাংলাদেশের অন্য জাতিসত্তাসমূহের স্বীকৃতির প্রয়োজনও তাঁর চিন্তার অন্যতম বৈশিষ্ট্য। বাংলাদেশে শিল্পায়ন করার লক্ষ্যে প্রবাসীদের অর্থায়নে ‘উপজেলা শিল্প এলাকা’ এবং ‘পৌর শিল্প এলাকা’ গঠন করার তাঁর প্রস্তাব ইতোমধ্যেই সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের ‘মাইক্রো ক্রেডিট’ ব্যাংকিং ব্যবস্থা এবং ‘সামাজিক ব্যবসা'র সমর্থক সিরাজুল আলম খান।

রাজনৈতিক তত্ত্ব উদ্ভাবন এবং অর্থনৈতিক উন্নয়ন মডেল প্রণয়নে তাঁর প্রধান সহযোগীরা হলেন ড. জিল্লুর রহমান খান, প্রফেসর রাজিয়া আহমেদ এবং মহিউদ্দিন আহমদ।

জাসদের চিন্তাগুরু সিরাজুল আলম খান কর্নেল তাহেরকে মাঠে নামিয়ে দিয়ে চলে যান অজ্ঞাত স্থানে। যদিও সেখান থেকেই তিনি তাহেরের সঙ্গে যোগাযোগ রাখেন। কিন্তু মূল দৃশ্যপট থেকে নিজেকে সরিয়ে রাখেন তিনি। আরও কুশীলব ছিলেন মেজর জলিল, আ স ম আবদুর রব। সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব ভুলে গেলেও সাম্যবাদী দার্শনিক কার্ল মার্ক্সের আদলে লম্বা দাড়ি ও চুল তাঁর আমৃত্যু সঙ্গী হয়ে ছিলো। অকৃতদার থেকে তিনি বিপ্লবী ঐতিহ্যের দৃষ্টান্ত হয়ে আছেন।

৯ জুন ২০২৩ তারিখে দুপুর আড়াইটায় ৮২ বছর বয়সে ব্যক্তিগত জীবনে অবিবাহিত আমৃত্যু সংগ্রামী সিরাজুল আলম খান ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।

ইতিহাসে প্রত্যেকের অবদানের স্বীকৃতি থাকা প্রয়োজন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম ও রাজনৈতিক আন্দোলনের ইতিহাসে যাঁর যে অবদান, তাঁর স্বীকৃতি জাতির প্রত্যাশা। একটি জাতির ইতিহাসের অনেক নির্মাতা থাকেন। কোনো একজন বা দুজন ইতিহাস নির্মাণ করতে পারেন না। তাঁদের কোনো একজনকে এককভাবে মূল্যায়ন করলে অন্যদের অবস্থান খাটো হয়। সিরাজুল আলম খানের যে সম্মান প্রাপ্য ছিলো, রাষ্ট্র তাঁর প্রতি সেই সম্মান জানায়নি। হয়তো তাঁর রাজনীতির পদ্ধতিতে কোনো ত্রুটি ছিলো। তা নিয়ে সমালোচনা হতে পারে। কেউ সমালোচনার ঊর্ধ্বে নন। তবে তাঁকে উপেক্ষা করার চেষ্টা করা হলে তা ইতিহাসকেই ত্রুটিপূর্ণভাবে উপস্থাপন করার শামিল হবে। সিরাজুল আলম খানকে নিয়ে ফ‍্যাসিস্ট হাসিনার দম্ভ, ধৃষ্টতা, ঔদ্ধত্যপূর্ণ বক্তব্যের কথা মনে পড়লে হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হয়।

সারোয়ার ওয়াদুদ চৌধুরী :

লেখক ও গবেষক।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়