প্রকাশ : ৩০ জুলাই ২০২৫, ১২:১৯
৭ মাসে ৬৫ জন মাদক বিক্রেতা গ্রেপ্তার : রায়পুরে গ্রামে গ্রামে মাদক ব্যবসা ও সেবন বেড়েছে

'মামা--কী খবর? আছে নি? কোনটা? ইয়াবা না গান্জা না বোতল? -ব্রিজের ওপর (কাঞ্চনপুর বিল-রাস্তার সেতু)। রোববার (২৭ জুলাই ২০২৫) সন্ধ্যার পর লক্ষ্মীপুরের রায়পুর পৌরসভার ৬নং ওয়ার্ডের টিএন্ডটি সড়ক দিয়ে সামনে গেলে কাঞ্চনপুর বিল ও তার মধ্যখানে একটি ব্রিজের ওপর চারজন যুবক এভাবেই ইয়াবা কেনার আহ্বান জানান।
পৌরসভার পশ্চিম ও দক্ষিণ কাঞ্চনপুর ব্রিজের ওপর গিয়ে দেখা যায় (রুস্তম আলী কলেজ রাস্তা) চার যুবক বসে আছেন। পাশে ৩টি মোটরসাইকেল। এ প্রতিবেদককে দেখে মোটরসাইকেল নিয়ে দুজন চলে যান। এ সময় আরেক মোটরসাইকেল আরোহী ইয়াবা কিনতে আসেন। একজন ইশারা দিয়ে কিছু একটা বোঝালেন।
এ সময় নাম প্রকাশ না করে তারা জানান, তারা দু বছর ধরে গ্রামের নির্জন এ স্থানে বসে ইয়াবা বিক্রি করছেন। উপজেলার ১০ ইউনিয়নের গ্রামের রাস্তাগুলোতে এখন ইয়াবা বিক্রি হয়। গত ৭ মাসে মাদক ব্যবসায়ীরা শহরের সাথে গ্রামেও ব্যাপকভাবে এটি ছড়িয়ে দিয়েছে।
পুলিশ বলছেন, গত ৫ আগস্ট সারা দেশের ন্যায় রায়পুর থানাও অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে। এতে অস্ত্র লুটসহ সকল মালামাল পুড়ে যায়। তার ৪-৫ মাস পর যানবাহনের কারণে পুলিশের টহল বাড়ানো যায়নি। দুটি গাড়িসহ সিএনজি অটোরিকশা দিয়ে অভিযান চালানো হয়। গত ৭ মাসে মাদক মামলা হয়েছে ৬২ টি। আসামী গ্রেপ্তার হয় ৬৫ জন। এ সময় অভিযানে ১৩ কেজি ৫২৩ গ্রাম গাঁজা ও ৩৫৬৩ পিস ইয়াবা ট্যাবলেট মাদক জব্দ করা হয়েছে।
স্থানীয় ব্যক্তিরা জানান, সহজলভ্য হওয়ায় কিশোর-তরুণেরাও এ মরণ নেশায় ঝুঁকে পড়ছেন। প্রশাসন-সংশ্লিষ্টদের কোনো তৎপরতা না থাকায় গ্রামে ইয়াবার জমজমাট ব্যবসা চলছে। এ কারণে সেবনকারীর সংখ্যা আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে।
স্কুল শিক্ষক মনির ও জাকির হোসেন বলেন, প্রতিদিন বিকেল থেকে রাত ১টা পর্যন্ত মাদক ব্যবসায়ীরা গ্রামের রাস্তায় ও ব্রীজের উপর ও বিলের মধ্যে বসে ইয়াবা বিক্রি করেন। প্যান্ট, শার্ট ও লুঙ্গির ভেতর রেখে মোবাইলে যোগাযোগ করে তা বিক্রি করা হয়।
পৌরসভার ৬ নং ওয়ার্ডের দেনায়েতপুর ও পশ্চিম কাঞ্চনপুর প্রামের বাসিন্দারা জানান, টিএন্ডটি সড়ক দিয়ে ও এএসপি অফিসের সামনে ডানে দিয়ে রাস্তা গেছে কাঞ্চনপুর বিল,
রুস্তম আলী কলেজ সড়ক, পোস্ট অফিস সড়ক দিয়ে ও ধানহাটা দিয়ে ডাকাতিয়া নদীর পাড় দিয়ে পাউবোর কলোনী, টিসি সড়কের মহিলা মাদরাসার উভয় পাশে দিয়ে পাউবোর নার্সারি ও নদীর পাড়ে, শহীদ মিনারে, নতুনবাজার জামে মসজিদের পুকুর পাড়ে, সুপারি বাগানে, তার আরও সামনে পিলার কারখানার পাশে, পানবাজার, তার পাশে নদীর পাড়ে, মহিলা কলেজের পাশে মধুপুর গ্রামে নদীর পাড়ে পৌর শ্মশানের পাশে, বাসটার্মিনাল জামে মসজিদের পেছনে সুপারি বাগানে, রায়পুর ইউনিয়ন পরিষদের পেছনে জনকল্যাণ হাই স্কুলের পেছনের সুপারি বাগান ও ব্রিজের উপর, সোলাখালি ব্রিজের আগে মৈশাল বাড়ির পেছনের নদীর পাড়ে, সরকারি হাসপাতালের কোয়ার্টারের পেছনে সুপারি বাগানে ও সরকারি কলেজের পেছনের সড়কে।
এছাড়াও উপজেলার কেরোয়া ইউনিয়নের সুনামগঞ্জ, মালিবাড়ি, মোল্লারহাট, বাঁশতলা, নায়ারহাট, চরপাতা ইউপির পূর্ব চরপাতা, বোর্ডার বাজার, পশ্চিম চরপাতা, সিংহের পুল থেকে সুনামগঞ্জ বাজার সড়ক, সোনাপুর ইউনিয়নের বাসাবাড়ি, চরবগা, রাখালিয়া, বামনী ইউপির বাংলাবাজার, কবির হাট এলাকাসহ বিভিন্ন গ্রাম্য সড়কে বিক্রি হচ্ছে ইয়াবা। চরমোহনা, রায়পুর, উত্তর চর আবাবিল, দক্ষিণ চর আবাবিল, উত্তর চরবংশী, দক্ষিণ চরবংশী ইউনিয়নে এর বিক্রি বেশি হচ্ছে।
রায়পুর শহরের ট্রাফিক মোড় দিয়ে ডান দিকে পীর ফয়েজউল্যা সড়কের ১০-১৫ স্পটে মাদক ব্যবসা ও সেবন চলছে। সম্প্রতি সেনাবাহিনীর ওয়ারেন্ট অফিসার শাহআলমের নেতৃত্বে সাইচা গ্রামে আবদুস সাত্তারের ছেলে ফরহাদ হোসেন (৩৫)কে আটক করে। এ সময় তার কাছ থেকে ২৮ পিচ ইয়াবা, ২টি খালি জিপার, ২টি মোবাইল ও নগদ ৫২৭০ টাকা উদ্ধার করা হয়।
রোববার, সোমবার ও মঙ্গলবার সন্ধ্যার পর ঘুরে দেখা যায়, পৌরসভার টিএন্ডটি, রুস্তম আলী কলেজ, এএসপি কার্যালয়ের সামনে দিয়ে কাঞ্চনপুর রাস্তা দিয়ে ১০-১৫টি মোটরসাইকেল এদিক-সেদিক ছুটে বেড়াচ্ছে। বিভিন্ন স্থানেই রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে মোটরসাইকেলে থাকা লোকজন পথচারীদের সঙ্গে কথা বলছেন। কথা শেষে আবার মোটরসাইকেল নিয়ে চলে যাচ্ছেন। চালতাতুলি ও দেবিপুর গ্রামে রাস্তাগুলোতেও চলছে মাদক বিক্রি ও সেবন করতে দেখা গেছে।
এলাকাবাসী জানান, এরা গ্রামের বাসিন্দা ক'জনের সাথে এসব কাজ করছে। সন্ধ্যা হলে এরা মোটরসাইকেলে ঘুরে ইয়াবা বিক্রি করেন। এ সময় এলাকায় রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীদেরও আনাগোনা বাড়তে থাকে। কাঞ্চনপুর এলাকার এক ইয়াবা বিক্রেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, আগে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের কাছ থেকে তারা পাইকারি দরে ইয়াবা কিনে আনতেন। এখন শুধু হাতবদল হয়েছে, লোকজনই ইয়াবা বেচাকেনায় জড়িত।থানায় খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, জেলার কুখ্যাত মাদক সম্রাট রাজু কেরোয়া ইউপির মোল্লারহাট এলাকার বাসিন্দা। তার বিরুদ্ধে থানায় মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে ২০-২৫টি মামলা রয়েছে। জেলে থাকলেও তার সহযোগীরা ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছেন। রোববার রাত নয়টায় রায়পুর-পানপাড়া সড়ক এলাকায় কলেজের পেছনের সড়কে মালেক পরিচয় দিয়ে এক ইয়াবা বিক্রেতা জানান, তিনি রাজুর কাছ থেকে ইয়াবা এনে বিক্রি করেন। রায়পুর ইউনিয়ন, কেরোয়া ইউনিয়ন, চরমোহনা ইউনিয়ন ও চরপাতা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান কয়েকজন সদস্য (মেম্বার) বলেন, গ্রামের প্রত্যেকটি নির্জন সড়কেই ইয়াবা বিক্রি হয়। আইনশৃঙ্খলা কমিটির সভায় বিএনপির কয়েকজন নেতা বিষয়টি একাধিকবার উপস্থাপন করেও কোনো সুফল আসছে না।
কয়েকজন মাদক বিক্রেতা জানান, একটি বড়ো রাজনৈতিক দলের ৫-৬ জন নেতাকে ১১ মাস ধরে মাসোহারা দিয়ে তারা নির্বিঘ্নে এ ব্যবসা চালাচ্ছেন। ক্রেতার সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় তারা গ্রাম ও এলাকা পর্যায়েও মাদক বিক্রি করছেন।
রায়পুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) নিজাম উদ্দিন ভুইয়া বলেন, সুনির্দিষ্টভাবে কোনো কোনো এলাকায় ইয়াবা বিক্রি হয়, তা পুলিশের জানা নেই। আসলে এলাকায় ঘুরে এই ইয়াবা বিক্রি হয়। এদের ধরতে পুলিশের টহল চলে। প্রায় ৭ মাসে কমপক্ষে ৬৫ জন মাদক ব্যবসায়ীকে গ্রেপ্তার এবং এসময়-১৩ কেজি ৫২৩ গ্রাম গাঁজা ও ৩৫৬৩ পিস ইয়াবা ট্যাবলেট) মাদক জব্দ করা হয়েছে।।