মঙ্গলবার, ১৩ মে, ২০২৫  |   ২৭ °সে
জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয় অন্যান্য
ব্রেকিং নিউজ
  •   খালেদা জিয়াকে স্বাগত জানাতে বিমানবন্দরে নেতাকর্মীদের ঢল

প্রকাশ : ১২ মে ২০২৫, ২৩:২২

ফরিদগঞ্জে দুগ্ধ প্রকল্পের টাকা নিয়ে নয়ছয়

ফরিদগঞ্জ ব্যুরো
ফরিদগঞ্জে দুগ্ধ প্রকল্পের টাকা নিয়ে নয়ছয়

শিশুদের মতো অনেক প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তিরও দুধ পছন্দ। এই দুধকে বলা হয় সুপার ফুড বা সর্বগুণসম্পন্ন খাবার। এতে রয়েছে ক্যালসিয়াম, পটাশিয়াম, ফসফরাস, প্রোটিন, ভিটামিন এ, ভিটামিন ডি, ভিটামিন বি-১২, নিয়াসিন ও রিবোফ্লভিন। দুধের নানা পুষ্টিগুণ মানুষকে সুস্থ, সবল ও নিরোগ রাখতে পারে। অ্যাসিডিটির সমস্যা, পিরিয়ডের সময় তীব্র যন্ত্রণা, কাজের স্ট্রেসে অস্থির অবস্থা--এসব সমস্যা থেকে মুক্তি দিতে পারে এক গ্লাস দুধ। প্রতিদিন মাত্র এক গ্লাস দুধ পানেই এমন অনেক সমস্যা থেকে মুক্তি পেতে পারে মানুষ ।সরকার এ লক্ষ্যে দেশের দুগ্ধ ঘাটতি মোকাবেলায় বড়ো উদ্যোগ গ্রহণ করে। সমবায়ের মাধ্যমে এ ঘাটতি মোকাবেলার জন্যে সারাদেশে ৫০ উপজেলায় ১০০টি সমবায় সমিতি গঠন করে দুগ্ধ সরবরাহ বাড়াতে ২০২২ সালে একটি প্রকল্প হাতে নেয় । এর মধ্যে ফরিদগঞ্জ উপজেলাও অন্তর্ভুক্ত হয়।

গত ৯ জানুয়ারি ২০২৫ দুগ্ধ ঘাটতি উপজেলা হিসেবে ফরিদগঞ্জে দুগ্ধ সমবায় কার্যক্রম সম্প্রসারণ প্রকল্পের আওতায় একশত উপকারভোগীর মাঝে ঋণের চেক বিতরণ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। এতে মুঠোফোনে প্রধান অতিথির বক্তব্য রাখতে গিয়ে সমবায় অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. শরিফুল ইসলাম বলেছিলেন, সমবায়ের মাধ্যমে দুগ্ধ খামারিদের একতাবদ্ধ করে প্রশিক্ষণ, ঋণ এবং সার্বিক সহযোগিতার মাধ্যমে বাংলাদেশে দুগ্ধ উৎপাদনের ঘাটতি মেটাতে সরকারের এতো আয়োজন। এই ঋণ পাওয়ার মাধ্যমে ঋণ গ্রহীতারা গরু ক্রয় করে দুগ্ধ উৎপাদন বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখবেন। এক্ষেত্রে সফলতা দেখাতে পারলে আমরা এই খাতে বিপ্লব ঘটাতে সক্ষম হবো। কিন্তু সমবায় ডিজির এই কথা উপস্থিত সদস্যরা এক কান দিয়ে শুনে অন্য কান দিয়ে বের করে দেন। গরু কেনার জন্যে দেয়া ঋণের টাকা দিয়ে করেছেন অন্য কাজ। যেমনটা এনজিওগুলোর কাছ থেকে নেয়া ঋণের ক্ষেত্রে হয়।

সম্প্রতি ফরিদগঞ্জ উপজেলার দুটি সমিতির মাধ্যমে উপজেলার তিনটি ইউনিয়নে ১০০জন ঋণ গ্রহীতার মধ্য থেকে ৬১ জনের বিষয়ে অনুসন্ধানে অনিয়ম ও দুর্নীতির আশ্রয় নেয়ার অভিযোগ উঠে এসেছে।

ফরিদগঞ্জ উপজেলায় দুটি দুগ্ধ সমিতির মাধ্যমে ১০০ জনের মধ্যে প্রথম পর্যায়ে ঋণ বিতরণ হয় ১ কোটি ৬০ লাখ টাকা। অভিযোগ রয়েছে, ঋণ গ্রহীতা যাচাই-বাছাইয়ে অনিয়ম এবং দুর্নীতির আশ্রয় নেয়া হয়েছে। ঋণের টাকা বিনিয়োগ হয়েছে অন্য খাতে। ৬১ জনের মাঝে অনুসন্ধান করে মিলেছে এমন চাঞ্চল্যকর তথ্য। এর মধ্যে ২৯ জনই ঋণের টাকা কোরবানিতে বিক্রির জন্যে পশু ক্রয়ে বিনিয়োগ করেছেন, কেউ কেউ অন্যের গোয়াল ঘর দেখিয়ে ঋণ নিয়েছেন, আর কয়েকজনের নামের ঋণের টাকা একজনই নিয়েছেন।

জানা গেছে, ‘দুগ্ধ ঘাটতি উপজেলায় দুগ্ধ সমবায়ের কার্যক্রম সম্প্রসারণ’ প্রকল্পের আওতায় ফরিদগঞ্জ উপজেলার ১৫ ইউনিয়নের মধ্যে মাত্র ঋণ বন্টনে বেছে নেয়া হয়েছে ৩ ইউনিয়নকে। এর মধ্যে চান্দ্রা দুগ্ধ সমবায় সমিতির ৫০জন বালিথুবা পশ্চিম ইউনিয়নের। গাজীপুর দুগ্ধ সমবায় সমিতির ৫০জন হলেন সুবিদপুর পশ্চিম ও পাইকপাড়া দক্ষিণ ইউনিয়নের বাসিন্দা।

উপজেলা সমবায় কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, চলতি বছরের ৯ জানুয়ারি দুটি দুগ্ধ সমিতির ১০০ জন ঋণ গ্রহীতার মাঝে উন্নত জাতের গাভী ক্রয় করার জন্যে ১লাখ ৬০ হাজার টাকা করে ঋণের চেক প্রদান করা হয়। কিন্তু ঋণ বিতরণের প্রায় ৪ মাস পর অর্থাৎ এপ্রিল মাসেও অনেক ঋণ গ্রহীতা গাভী ক্রয় করেননি।

চান্দ্রা দুগ্ধ সমবায় সমিতির ৫০জন ঋণ গ্রহীতার মধ্যে ২৯ জনের মধ্যে অনুসন্ধান চালানো হয়। এর মধ্যে ১৭ জন গাভী ক্রয় করেননি। ঋণের টাকা বিনিয়োগ করেছেন অন্য খাতে। ঋণের টাকা যথাযথ বিনিয়োগের কোনো চিহ্ন পাওয়া যায়নি বালিথুবা পশ্চিম ইউনিয়নের সকদিরামপুর গ্রামের সফিকুর রহমান ও মদনেরগাঁও গ্রামের জহিরুল হক (আরিফ)-এর মধ্যে।

জহিরুল হক উপজেলা প্রাণিসম্পদের আওতায় একটি প্রকল্পে চাকরি করেন। তার মা ফয়েজুন্নেছা জানান, ঋণের টাকায় কোরবানিতে বিক্রির জন্যে ষাঁড় গরু ক্রয় করা হয়েছে।

সকদীরামপুর গ্রামের ঋণ গ্রহীতা নাজমা আক্তার। তিনি জানেন না কতো টাকা ঋণ নিয়েছেন এবং কী কাজে। পরে জানালেন তার ভাই ইসমাইল জানেন এই বিষয়ে। একই ইউনিয়নের মিনু বেগম, তফুরী বেগম, মো. নুর মিয়া, মো. ওয়াসিম হোসেন, ফাতেমা বেগম, নাছির উদ্দিন, মো. জাহাঙ্গীর হোসেন গাজী, মো. সেলিম মিয়া, ফাহিমা আক্তার ও রৌশন আরা বেগম ঋণ নিলেও গাভী ক্রয় করেননি। এদের মধ্যে ওয়াসিম হোসেন ঋণের টাকায় নিম্নমানের ওষুধ কিনে মজুদ করেছেন। স্থানীয় ফার্মেসীতে তিনি এসব ওষুধ বিক্রি করেন।

চান্দ্রা দুগ্ধ সমিতির সমন্বয়ক ও ঋণ গ্রহীতা মোহাম্মদ শাহাবুদ্দিন। তিনি নিজে, তার স্ত্রী ফাতেমা বেগম, ঋণ গ্রহীতা নুরুন্নাহার আক্তার লাকী ও মো. নাছির উদ্দিন ঋণের টাকা নিয়ে বিনিয়োগ করেছেন তাদের পূর্বের গরুর খামারে। তাদের এই খামারে আছে ২৮টি ষাঁড় গরু। এসব ষাঁড় বিক্রি করবেন কোরবানির হাটে।

গাজীপুর দুগ্ধ সমবায় সমিতির ৫০জন ঋণ গ্রহীতার মধ্যে ৩৩ জনের মধ্যে অনুসন্ধান চালানো হয়। এর মধ্যে ১৪ জনই গাভী ক্রয় করেননি। সমিতির ঋণ গ্রহীতা সাখাওয়াত হোসেন, রাজু হোসেন, মো. কাইয়ুমের বাড়িতে গিয়ে গরুর কোনো অস্তিত্বই পাওয়া যায়নি। তারা অন্যের গোয়াল ঘর দেখিয়ে ঋণ নিয়েছেন। সাখাওয়াত মুন্সিরহাট বাজারে জুতার ব্যবসায়ী, রাজু বাড়িতে থাকেন না এবং কাইয়ুম বালু ব্যবসায়ী। কাইয়ুম জানালেন, তিনি গোয়াল ঘর ঠিক করে গরু ক্রয় করবেন। গোবরচিত্রা গ্রামের মোহাম্মদ রাশেদ খান ও নুর হোসেন খানের বাড়িতে গিয়ে গোয়াল ঘরের অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি।

এই সমিতির ঋণ গ্রহীতা সুখরঞ্জন, মরিয়ম বেগম, মো. সাইফুল, ফাতেমা বেগম, নাছিমা বেগম, জিয়াউল হক ও মো. আলমের বাড়িতে কোনো গরু পাওয়া যায়নি। এদের মধ্যে ফাতেমা বেগমের স্বামী সাবেক চেয়ারম্যান হুমায়ুন কবির। তাদের বাড়িতে কোনো লোক নেই। থাকেন চাঁদপুর শহরে। সাইফুল ইসলাম নামে ঋণ গ্রহীতা দেখালেন তার ভাইয়ের গোয়াল ঘর। পার্শ্ববর্তী ঘড়িহানা গ্রামের সরদার বাড়িতে বেশ কয়েকজন নিয়েছেন ঋণের টাকা। তাদের আগ থেকে অনেকের গোয়ালঘর এবং বিভিন্ন ধরনের গরু আছে। এই বাড়ির জসিম উদ্দিন মিন্টু ছিলেন গাজীপুর দুগ্ধ সমিতির সমন্বয়ক। তিনি নিজ বাড়ির লোকদের এবং আশপাশের ১১ জনের ঋণ নেয়ার কাজে সহযোগিতা করেন। এদের মধ্যে অনেকেই আগ থেকে কোটি টাকা বিনিয়োগ করে খামার করেছেন।

জসিম উদ্দিন বলেন, এই ঋণ বিতরণের সময় সমিতিতে যাদের নাম ছিলো, চূড়ান্ত করার দিন তা পাওয়া যায়নি। উপজেলা সমবায় অফিসার এবং ওই কার্যালয়ের কর্মচারীরা তালিকা চূড়ান্ত করেছেন। ওইদিন আমি উপস্থিত হয়ে দেখলাম রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের উপস্থিতি। ওই সময়ে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ নেতাদের সামনে সাহস করে কোনো কথা বলতে পারিনি। যে কারণে ঋণের টাকা বিতরণে অনিয়ম হয়েছে।

ফরিদগঞ্জ উপজেলা সমবায় কর্মকর্তা মোহাম্মদ দেলোয়ার হোসেন বলেন, ঋণ বিতরণের জন্যে দুটি সমিতির সদস্য যখন চূড়ান্ত হয়, তখন আমি এই উপজেলায় ছিলাম না। তবে ঋণ বিতরণ হয়েছে আমি দায়িত্বরত অবস্থায়। যেসব সদস্যের বিরুদ্ধে অনিয়মের অভিযোগ এসেছে, তাদের বিষয়ে আমরাও তদন্ত করে দেখছি। কেউ কেউ কোরবানিতে বিক্রির জন্যে ষাঁড় ক্রয় করেছেন।

তিনি আরো বলেন, আমাদের তদন্তে যাদের অনিয়ম পাওয়া যাবে, তাদের বিষয়ে অবশ্যই ব্যবস্থা নেয়া হবে। কারণ ঋণের ২ লাখ টাকার মধ্যে ১লাখ ৬০ হাজার টাকা প্রদান করা হয়েছে। এছাড়াও পরবর্তী ৪০ হাজার টাকা চেক বিতরণ অপেক্ষমান। এসব বিষয় সামনে রেখে আমাদের পরবর্তী কার্যক্রম চালাতে হবে।

চাঁদপুর জেলা সমবায় কর্মকর্তা (ভারপ্রাপ্ত) মোহাম্মদ বিল্লাল হোসেন বলেন, এই ঋণ বিতরণ সম্পর্কে আমি অবগত না। তখন আমি দায়িত্বে ছিলাম না। এই ধরনের অনিয়ম হয়ে থাকলে প্রকল্পের দায়িত্বরত কর্মকর্তাকে লিখিতভাবে জানানো হবে। যারা ঋণের টাকা নিয়ে অনিয়ম করেছেন তাদের বিষয়ে পরবর্তীতে নিদের্শনা আসবে এবং ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারবো।

এই বিষয়ে জানতে চাইলে চাঁদপুরের বিখ্যাত সমবায়ী ও বাংলাদেশ জাতীয় সমবায় ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক জসিম উদ্দিন শেখ বলেন, দুগ্ধ উৎপাদন বৃদ্ধির জন্যে সরকারের এই প্রকল্পটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ঋণ বিতরণ এবং নেয়ার ক্ষেত্রে যদি অনিয়ম হয়ে থাকে, তাহলে অব্যশই তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া প্রয়োজন।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়