সোমবার, ২৮ জুলাই, ২০২৫  |   ২৯ °সে
জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয় অন্যান্য

প্রকাশ : ২৮ জুলাই ২০২৫, ০২:৫৮

শতবর্ষ পেরিয়ে মানবতার বাতিঘর পুরাণবাজার পৌর দাতব্য চিকিৎসালয়

এটির কার্যক্রম বন্ধ করতে ষড়যন্ত্র ও অপপ্রচার

স্টাফ রিপোর্টার
শতবর্ষ পেরিয়ে মানবতার বাতিঘর পুরাণবাজার পৌর দাতব্য চিকিৎসালয়
ছবি : চাঁদপুর পৌরসভার ঐতিহ্যবাহী পুরাণবাজার পৌর দাতব্য চিকিৎসালয়।

চাঁদপুর শহরের পুরাণবাজারের এক কোণে দাঁড়িয়ে আছে একটি প্রতিষ্ঠান, যার দরজায় প্রতিদিন ভিড় করেন শত শত অসহায় মানুষ। যেখানে মাত্র দু টাকার বিনিময়ে মিলে চিকিৎসা ও ওষুধ। অদ্ভূত শোনালেও সত্যি। নাম তার পুরাণবাজার পৌর দাতব্য চিকিৎসালয়। বয়স তার ১০৫ বছর। ১৯২০ সালে এই দাতব্য চিকিৎসালয় প্রতিষ্ঠা করে চাঁদপুর পৌরসভা।

এক শতাব্দীরও বেশি সময় ধরে মানবতার এই সেবাকেন্দ্র যেন ছায়া হয়ে দাঁড়িয়ে আছে পৌর এলাকা ও চরাঞ্চলের দরিদ্র মানুষের পাশে। ব্রিটিশ শাসনামলে সূচনা হয়েছিল এই অনন্য দাতব্য চিকিৎসা সেবার। কালের পরিক্রমায় বদলেছে শাসক, বদলেছে সময়ের চাহিদা। কিন্তু বদলায়নি এই প্রতিষ্ঠানটির মানবিক কার্যক্রম।

চাঁদপুর পৌরসভা শত প্রতিকূলতার মাঝেও অবিচল থেকেছে এই সেবা চালু রাখার ব্যাপারে। সরকারি বা বেসরকারি অনেক হাসপাতাল যেখানে রোগীর আর্তনাদে মুখ ফিরিয়ে নেয়, সেখানে এই ছোট্ট চিকিৎসালয় যেন শত সহস্র গরিবের একমাত্র আশ্রয়।

দু টাকার বিনিময়ে একজন রোগী এখানে চিকিৎসকের দেখা পান, প্রয়োজনীয় প্রাথমিক চিকিৎসা ও ওষুধও পান। বিশেষ করে বয়স্ক মানুষ, শিশু, গর্ভবতী নারী, শ্রমজীবী নারী-পুরুষ। যাদের জন্যে আধুনিক প্রাইভেট হাসপাতালের দরজা খোলা থাকলেও ভেতরে ঢোকার সাধ্য নেই, তাদের কাছে এই চিকিৎসালয় শুধু একটি হাসপাতাল নয়—এ এক প্রার্থনার স্থান।

সম্প্রতি এমন মানবিক উদ্যোগ নিয়েও চলছে ষড়যন্ত্র ও মিথ্যা অপপ্রচার। একটি সুবিধাবাদী মহল 'লস প্রজেক্ট' আখ্যা দিয়ে চাঁদপুর পৌরসভার এই প্রাচীন দাতব্য চিকিৎসালয়টি বন্ধ করতে উঠেপড়ে লেগেছে।

তাদের চাওয়া পৌর প্রশাসককে ভুলভাল বুঝিয়ে এই আলোর বাতিঘরটি চিরতরে বন্ধ করা। সমাজ সচেতন মানুষেরা মনে করছেন, অপপ্রচারকারীদের উদ্দেশ্য খুব পরিষ্কার—মানবতার এই বাতিঘর নিভিয়ে দিয়ে হয়তো তারা চালু করবে নিজেদের মুনাফাভিত্তিক কোনো বাণিজ্য প্রতিষ্ঠান।

ফলে তারা গণমাধ্যমকে ব্যবহার করে বিভ্রান্তিকর তথ্য ছড়াচ্ছে। যেনো চাঁদপুর পৌরসভা এই মানবিক প্রতিষ্ঠানটির কার্যক্রম গুটিয়ে নিতে বাধ্য হয়।

দাতব্য চিকিৎসালয়ের বারান্দায় বসে থাকা বৃদ্ধা রহিমা বেগম কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বললেন, 'আমার এই বয়সে আর কোথাও যাওয়ার জায়গা নাই। প্রাইভেট ক্লিনিকে যাওয়ার তো টাকা নেই। এইখানেই দুই টাকায় চিকিৎসা পাই, কিছু ওষুধও দেয়। এটা বন্ধ হইলে আমরা মরার আগেই মরে যামু।'

এমনই করুণ বাস্তবতা অনেকের। শ্রমিক জসিমউদ্দিন, রিকশাচালক শহিদুল, গৃহকর্মী সালমা কিংবা অসহায় বিধবা পার্বতী রাণী—সবাই একবাক্যে বলছেন, “এই চিকিৎসালয় আমাদের বাঁচিয়ে রাখছে। এটি বন্ধ হলে আমরা কোথায় যাবো?”

চাঁদপুরের সচেতন নাগরিক সমাজের দাবি, এই দাতব্য চিকিৎসালয় শুধু একটি প্রতিষ্ঠান নয়, এটি চাঁদপুর পৌরসভার গৌরব। এটি দেশের জন্যেও একটি মডেল। এই মানবিক কার্যক্রম চালু রাখা মানেই মানবিক রাষ্ট্র গঠনের পথে এক ধাপ এগিয়ে যাওয়া।

এই প্রতিষ্ঠানটি চাঁদপুর পৌরসভার সম্মান বৃদ্ধি করেছে। সুতরাং এটিকে বন্ধ নয়, নতুন উদ্যমে, নতুন ভাবনায় এগিয়ে নেয়ার পরিকল্পনা গ্ৰহণ করা সময়ের দাবি।

সচেতন নাগরিক সমাজ মনে করে, প্রয়োজনে জেলা সিভিল সার্জনের সহযোগিতা নিয়ে এখানে সাপ্তাহিকভাবে একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক নিয়োগ করা হোক। যাতে দরিদ্র মানুষেরা আরো উন্নত সেবা পেতে পারে।‌ এ জন্যে ২ টাকার টিকেট ১০ টাকা করা যেতে পারে।

এ বিষয়ে চাঁদপুর দক্ষিণ অঞ্চল নদী ভাঙ্গন প্রতিরোধ‌ কমিটির সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা ও ব্যাংকার মো. মুজিবুর রহমান বলেন, এখানে দীর্ঘদিন এমবিবিএস ডাক্তারও ছিলো। স্বাস্থ্য সহকারীর মাধ্যমে টিকা কেন্দ্রসহ স্বাস্থ্য সেবা বহাল ছিলো। কোনো হটকারী সিদ্ধান্তে জনস্বার্থের বিপরীত এই প্রতিষ্ঠান বন্ধ করা অন্যায় কাজ হবে।

পুরাণবাজারের দরিদ্র মানুষের চিকিৎসার কেন্দ্র এটি। এ ব্যাপারে তিনি জেলা প্রশাসক ও পৌর প্রশাসকের সুদৃষ্টি কামনা করেছেন।

চাঁদপুর চেম্বার অব কমার্সের সাবেক পরিচালক ও দক্ষিণ অঞ্চল নদী ভাঙ্গন প্রতিরোধ কমিটির সাধারণ সম্পাদক মমতাজ উদ্দিন মন্টু গাজী বলেন, দাতব্য চিকিৎসালয় হিসেবে এই প্রতিষ্ঠানটি পৌরসভার ঐতিহ্য বহন করে আছে। সাধারণ চিকিৎসা কেন্দ্র হিসেবে এটি বহাল রাখার জন্যে কর্তৃপক্ষের প্রতি অনুরোধ জানাচ্ছি।

সচেতন চাঁদপুর পৌরবাসী মনে করে, মানবতা কখনো লাভ-লোকসানের হিসাব মানে না। একশো বছর ধরে যে প্রতিষ্ঠান দরিদ্রের কান্না মুছেছে, সেটিকে লস প্রজেক্ট বলে বন্ধ করে দেয়া শুধু অমানবিকই নয়—এটি হবে এক ভয়াবহ ভুল সিদ্ধান্ত।

চাঁদপুর পৌরসভার এই দাতব্য চিকিৎসালয় যেনো আরো শত বছর বাঁচে, এই প্রত্যাশাই সবার। কেননা এখানেই প্রমাণ হয়, মাত্র দুই টাকায়ও মানুষ ভালোবাসা কিনতে পারে।

ডিসিকে/এমজেডএইচ

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়