সোমবার, ১১ নভেম্বর, ২০২৪  |   ২৪ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   দেবর-ভাবীর পরকীয়ায় বলি হলো দেবর
  •   হেরেম শরীফে নামাজ শেষে দুর্ঘটনায় আহত কামরুজ্জামান মারা গেছেন
  •   শাহবাগে অবস্থান ও ঋণ দেয়ার নামে চাঁদা আদায়কালে ফরিদগঞ্জে আটক দুই।। মুচলেকা দিয়ে ছাড়
  •   হাজীগঞ্জে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় আহত যুবকের মৃত্যু
  •   প্রেমে ব্যর্থতায় দু কিশোরের আত্মহত্যা

প্রকাশ : ০৬ মার্চ ২০২৪, ০০:০০

বহুমাত্রিক জ্ঞানচর্চায় মাতৃভাষা

ড. মোঃ নাছিম আখতার
বহুমাত্রিক জ্ঞানচর্চায় মাতৃভাষা

প্রায় ১৩ কোটি মানুষের দেশ জাপান। পৃথিবীর উন্নত দেশগুলোর মধ্যে জাপান অন্যতম। মাতৃভাষাকে জাপানিরা কোন মাত্রায় সম্মান করে তা বোঝা যায় তাদের মনের ভাব প্রকাশের জন্য অক্ষর ও চিহ্নের বিন্যাস থেকে। জাপানি ভাষায় কানজি হলো চিহ্ন বা ছবি।

যে চিহ্ন বা ছবি দ্বারা কোনো কিছু প্রকাশ করা যায়, সেগুলোকে বলে কানজি। কানজি দিয়ে যে বিষয়গুলো প্রকাশ করা যায় না সেগুলো প্রকাশের জন্য জাপানিরা দুই ধরনের বর্ণ ব্যবহার করে- কাতাকানা ও হিরাগানা। মজার বিষয় হলো জাপানি সংস্কৃতি ও ভাষার শব্দগুলো লেখার জন্য তারা হিরাগানা বর্ণ ব্যবহার করে। তাই নিজেদের নাম লেখার জন্য তারা হিরাগানা বর্ণমালা ব্যবহার করে।

আর জাপানি ভাষায় যে শব্দগুলো বিদেশি শব্দ থেকে এসেছে সেগুলো লেখার জন্য তারা কাতাকানা বর্ণমালা ব্যবহার করে। পড়াশোনা বা অন্য কোনো উপলক্ষে জাপানে গেলে বিদেশিদের নাম লিখতে গিয়ে জাপানিরা কাতাকানা বর্ণ ব্যবহার করে। এখান থেকেই ভাষা ও সংস্কৃতির বিষয়ে জাপানিদের সচেতনতা প্রতীয়মান।

জাপানে প্রাকৃতিক সম্পদের কোনো খনি নেই। তবু জাপানের শিল্পায়ন সবাইকে আশ্চর্যান্বিত করে। জাপান ভিনদেশ থেকে লোহার আকরিক আমদানি করে মানসম্মত স্টিল উৎপাদনে পৃথিবীতে তৃতীয়। অন্যান্য ভারী শিল্পেও জাপান পৃথিবীতে অপ্রতিদ্বন্দ্বী। সমৃদ্ধির উচ্চ অবস্থানে উপনীত হতে জাপান মাতৃভাষাকে শুধু মনে ধারণই করেনি, বরং বহুমাত্রিক জ্ঞানচর্চায় এর সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করেছে।

একটি সাংস্কৃতিক সংগঠনের বার্ষিক আলোচনাসভায় আমাদের সঙ্গে উপস্থিত ছিলেন একজন স্বনামধন্য অধ্যাপক, কলামিস্ট ও মিডিয়া ব্যক্তিত্ব।

তিনি তাঁর বক্তব্যে মাতৃভাষা নিয়ে ফ্রান্সের মানুষের সচেতনতার কথা তুলে ধরেন। বক্তব্যে তিনি ফ্রান্সের বিখ্যাত লুভার মিউজিয়াম ঘুরে দেখার অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেন। আমরা সবাই জানি, লুভার মিউজিয়ামটি ভাস্কর্য এবং পেইন্টিংয়ের জন্য পৃথিবী বিখ্যাত। অধ্যাপক মহোদয় গিয়েছিলেন ফ্রান্সের সেই মিউজিয়াম পরিদর্শনে। কিন্তু সেখানে সব দর্শনীয় বস্তুর নিচে লেখা বর্ণনা ফরাসি ভাষায়। ফরাসি ভাষা না জানার কারণে অধ্যাপক মহোদয় ভীষণ অসুবিধায় পড়েছিলেন। এতে তিনি কিছুটা বিরক্তও হয়েছিলেন। অনন্যোপায় হয়ে গুগলের সহায়তায় ইংরেজি করে কিছুটা বুঝলেও তাঁর কাছে বেশির ভাগ বর্ণনাই অজানা থেকে গেল। হোটেলে ফিরে তিনি হোটেলের ম্যানেজারের সঙ্গে তাঁর এই অভিজ্ঞতার কথা ব্যক্ত করলেন এবং বললেন যে ইংরেজিতে লেখা থাকলে ভালো হতো। কথাটি শুনে ম্যানেজার বললেন, ‘এই ভাষাতে জ্ঞানার্জন করেই আমরা এতটা উন্নতি করেছি। তাই আমাদের প্রজন্মকে ভাষা সংস্কৃতি থেকে দূরে রাখতে চাই না’।

ইতিহাস বলে, মুসলিম চিকিৎসাবিদদের জ্ঞান লাতিন ও ইউরোপের সব ভাষায় তৎকালীন সময়ে অনুবাদ করা হয়েছিল। আবু বকর মুহাম্মদ বিন জাকারিয়া আল রাজি ছিলেন মুসলিম বিশ্বের শ্রেষ্ঠ চিকিৎসাবিদদের অন্যতম। মানুষের কিডনি ও পিত্তথলিতে পাথর কেন হয় সে সম্পর্কে তিনি মৌলিক তথ্যপূর্ণ বই লিখেছিলেন। তাঁর লেখা বই ‘আল জুদরি ওয়াল হাসবাহ’ লাতিন ও ইউরোপের সব ভাষায় অনূদিত হয়। তাঁর সর্বশ্রেষ্ঠ অবদান হচ্ছে ‘আল হাবি’। এতে সব ধরনের রোগ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। বইটিতে তিনি প্রতিটি রোগ সম্পর্কে প্রথমে গ্রিক, সিরীয়, আরবি, ইরানি ও ভারতীয় চিকিৎসা প্রণালীর বিস্তারিত বর্ণনা দেন। তারপর নিজের মতামত ও ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার বর্ণনা দিয়েছেন।

ইউনেসকোর বর্ণনায় মাতৃভাষা ভাবের আদান-প্রদানের মাধ্যমের চেয়েও বেশি কিছু। এটা আমাদের মানবিকতা বিকাশের পূর্বশর্ত। আমাদের বিশ্বাস, মূল্যবোধ ও পরিচয় মাতৃভাষার মধ্যে নিহিত। মাতৃভাষায় কথা বলার সময় মন, মস্তিষ্ক ও জিহ্বার মধ্যে একটি সরাসরি সম্পর্ক ও সমন্বয় তৈরি হয়। সর্বস্তরে মাতৃভাষার ব্যবহার শুধু আবেগ ও অনুভূতির বিষয় নয়। গবেষণা বলছে, মাতৃভাষায় শিক্ষা জ্ঞানের ভিত্তি উন্নয়ন, মানসিক উৎকর্ষ ও ব্যক্তিত্ব গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

রুশ মনোবিজ্ঞানী লিও ভিগোতস্কি শিশুদের মানসিক বিকাশ নিয়ে কাজ করার জন্য বিখ্যাত। তিনি তাঁর গবেষণায় প্রমাণ করেছেন যে শিশুরা মনোযোগ, সংবেদনশীলতা, উপলব্ধি ও স্মৃতি নিয়ে জন্মায়। শিশু মাতৃগর্ভে থাকাবস্থায় শুনতে পায় এবং মাতৃভাষার শ্রুতিমধুরতা উপলব্ধি করে, যা শিশুর ব্যক্তিত্ব, চিন্তা ও জীবন বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। ইতালীয় ইলেকট্রো-ফিজিওলজিস্ট এলিস মাদো প্রোভারিও গবেষণার মাধ্যমে দেখিয়েছেন মাতৃভাষা ও পরবর্তী সময়ে শেখা ভাষা গ্রহণ করা এবং মনে রাখার ক্ষেত্রে মস্তিষ্কে বৈদ্যুতিক তরঙ্গ ভিন্ন ভিন্ন মাত্রায় প্রবাহিত হয়। মাতৃভাষায় কথা বলা ও কিছু ভাবার ক্ষেত্রে মস্তিষ্কের বৈদ্যুতিক তরঙ্গ শক্তিশালী ও বর্ধিত আকারে প্রতিভাত হয়। তিনি বলেন, ‘এ জন্যই আমরা স্বপ্ন দেখি, চিন্তা করি এবং আবেগকে অনুভব করি নিজ মাতৃভাষায়।’ মনোবৈজ্ঞানিক গবেষণা, সামাজিক প্রেক্ষাপট ও শিখন অভিজ্ঞতা প্রমাণ করে মাতৃভাষার মাধ্যমে শিখন গভীরতর, দ্রুত ও কার্যকর হয়। মাতৃভাষার অসম্পূর্ণ শিখন অন্য ভাষা শিক্ষায় বাধা সৃষ্টি করে।

পৃথিবীতে ভাষার সংখ্যা প্রায় সাত হাজার। ১১টি ভাষা সর্বাধিক ব্যবহৃত হয়। চীনা, ইংরেজি, হিন্দি, উর্দু, স্প্যানিশ, আরবি, রুশ, বাংলা, জার্মান, জাপানি, ফরাসি—বিভিন্ন ক্ষুদ্র ও বৃহৎ জাতিগোষ্ঠী এই ভাষাগুলো ব্যবহার করে। বাংলা ভাষাভাষী মানুষের সংখ্যা প্রায় ৩৫ কোটি। এমন বৃহৎ জনগোষ্ঠীর পড়াশোনা প্রাথমিক থেকে উচ্চশিক্ষা পর্যন্ত বাংলায় বাস্তবায়ন না করতে পারাটাই আমাদের সবচেয়ে বড় দুর্বলতা। মাতৃভাষায় শিক্ষা গ্রহণ ছাড়া জাতি কখনো প্রকৃত জ্ঞান অনুরাগী হয়ে গড়ে উঠবে না। উচ্চশিক্ষার মাধ্যম মাতৃভাষা হলে জনগোষ্ঠীর বেশির ভাগের অন্তর্ভুক্তি সম্ভব যেকোনো জ্ঞানচর্চা ও গবেষণায়। গবেষণার উন্নয়ন অর্থ জ্ঞান-বিজ্ঞানের উন্নয়ন। জ্ঞান-বিজ্ঞানের উন্নতি মানে শিল্প ও প্রযুক্তির উন্নয়ন। বিষয়টি গভীরভাবে উপলব্ধি করলেই ঘটবে জাতির অর্থনৈতিক ও নৈতিক উন্নয়ন।

লেখক : উপাচার্য, চাঁদপুর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়