সোমবার, ২০ মে ২০২৪, ৬ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১, ১১ জিলকদ ১৪৪৫  |   ২৮ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   এসএসসি সমমানের পরীক্ষার ফল প্রকাশ

প্রকাশ : ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ০০:০০

মিজানুর রহমান রানার মুক্তিযুদ্ধের ধারাবাহিক উপন্যাস

এই জনমে

অনলাইন ডেস্ক
এই জনমে

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)

আট.

ক্যাম্পটা একটা টিলার ওপাশের আড়ালে। পাশে অসংখ্য বড় বড় গাছ। জঙ্গল চারপাশে। নিঝুম রাতের বুক চিরে জোনাকি পোকাদের মিটি মিটি আলো জ্বলছে। ক্যাম্পের ১৫ জন মুক্তিযোদ্ধার মধ্যে ৫ জন ঘুমাচ্ছে। আর বাকিরা রাত জেগে সক্রিয় রাইফেল হাতে চারদিকে পাহারা দিচ্ছে।

রাত প্রায় তিনটা। হঠাৎ ঘুম থেকে জেগে উঠলো অনন্যা। পাশে রূপালি ও আমিরসহ অন্য মুক্তিযোদ্ধারা ঘুমাচ্ছে।

এ সময় অনন্যার প্রচণ্ড পানির তেষ্টা পেলো। পাশে রাখা জগ থেকে গ্লাসে ঢেলে ঢকঢক করে দু’ গ্লাস পানি পান করলো সে। তারপর মনে মনে ভাবলো, ঘুমিয়ে কী যেনো একটা স্বপ্ন দেখেছে সে। হ্যাঁ, হঠাৎ মনে পড়লো তার স্বামীর মুখটা। কী নিষ্কলুষ মুখ। তারপাশে তিনটা ছোট ছোট মাথা, ছয়টা চোখ। মুখগুলো চেনা যাচ্ছিল না। কারা তারা? মনে মনে ভাবলো সে।

ভাবতে ভাবতে দেখলো রূপালি ও আমির উঠে বসেছে। ঘুম ঘুম চোখে রূপালি প্রশ্ন করলো, ‘কি ব্যাপার আপনার ঘুম ভেঙ্গে গেল নাকি? কী ভাবছেন?’

‘না। আসলে পানির তেষ্টা পেয়েছিল।’ উত্তর দিলো অনন্যা।

এবার কথা বললো আমির, ‘হয়তো কোনো দুঃস্বপ্ন তাড়া করছে তোমাকে’।

আমিরের দিকে তাকিয়ে আছে অনন্যা। এই লোকটা চোখণ্ডমুখ দেখে মানুষের হৃদয়ের কথা বুঝে। সংস্কৃতিপরায়ণ লোকের হৃদয় প্রশস্ত হয়। অনেক কিছুই ভেবে নিতে পারে। ভাবতে ভাবতে আবার দেখলো আমির ঘুমিয়ে পড়ছে।

রূপালি আর ঘুমালো না। অনন্যার পাশে এসে বসলো। বললো, ‘শক্ত হও। হৃদয়ের আবেগ নিয়ন্ত্রণ করো। অনেক শত্রু ঘায়েল করতে হবে। আমাদের পথ রয়েছে এখনো অনেক বাকি।’

রূপালির দিকে অপলক চেয়ে আছে অনন্যা। সে বুঝতে পারে, মানুষ যখন চারদিক থেকে আঘাত পায় এবং সব হারিয়ে বসে তখন সে আসলে জীবনকে সূক্ষ্মভাবে চেনে। জীবনের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ভুল-শুদ্ধ সব কিছু খুঁজে পায়। তারপর সে আঘাতের পর আঘাত সইতে সইতে জীবনকে চিনে নেয়, জীবনের সাদাকালো পথগুলো চিনতে চিনতে জ্ঞানী হয়ে যায়। সেই জ্ঞানকে কাজে লাগাতে পারলেই পরবর্তীতে সফল হতে পারে।

সে ভাবে, সমুদ্রের উত্তাল তরঙ্গমালা দেখে আসলেই ভয় পাওয়া উচিত নয়। এই তরঙ্গমালা বিক্ষিপ্ত দোলা দিয়ে মানুষকে বুঝিয়ে দেয় উঁচু-নিচু বন্ধুর পথ চলতে চলতে মানুষ সাহসী হয়ে সত্যিকার পথ চিনে নিতে পারে। একবার পথ চিনতে পারলে সেই পথে গমন করা যায় ভয়হীনভাবে।

‘এখানে আমরা যারা আছি, সবাই পরিবার পরিজন ছেড়ে এসেছে।’ অনন্যাকে নীরবে ভাবতে দেখে বলতে লাগলো রূপালি। ‘এখন আমরা আমাদের সর্বোচ্চ ত্যাগ করবো দেশের জন্যে। দেশকে মুক্ত করতে না পারলে আমাদের কারোই নিস্তার মিলবে না।’

কথাটা শেষ না হতেই ক্যাম্পের বাইরে কারো পদশব্দ পাওয়া গেল। রূপালি কিছুক্ষণ চুপ হয়ে থেকে কান পেতে আবারও শব্দ শোনার জন্যে উদ্গ্রীব হয়ে রইলো।

এমন সময় ক্যাম্পের বাইরে থেকে ইরফান, ইমতিয়াজ, তুষার, অধরা, ইরণা ও ঈশাণবালা এসে জানালো, ক্যাম্পের অনতিদূরে ক’জন মানুষ কিছুক্ষণ ক্যাম্পের চারদিকে রেকি করে তারপর চলে গেছে।

আমির ঘুম থেকে আবার জেগে উঠলো। তারপর ইরফানের কাছে জানতে চাইলে, ‘কী হয়েছে?’

ইরফান বললো, ‘আমরা বাইরে পাহারারত ছিলাম। দূরে গাছগাছালির আড়ালে ক’জন মানুষ দেখতে পাই। তারা চারদিক ঘুরে ভেতরে প্রবেশের চেষ্টায় ছিলো। কিন্তু আমাদের ছায়াগুলো দেখে তারা পালিয়েছে।’

আমির কিছুক্ষণ চিন্তা-ভাবনা করলো। তারপর বললো, ‘ওরা সম্ভবত রাজাকারের দল। এখানে খুব কাছেই রাজাকার মেহের জল্লাদের আস্তানা আছে। তারা সম্ভবত রেকি করে যাচ্ছে।’

‘খুব সহসাই কি আক্রমণ করতে পারে?’ উৎকণ্ঠিত হয়ে প্রশ্ন করলো অধরা।

আমির ইমতিয়াজের দিকে তাকালো। ইমতিয়াজ আমিরের চোখের চাহনি বুঝতে পেরে বললো, ‘আমি যেভাবে তাদেরকে দেখেছি, তাতে মনে হয় তারা খুব দ্রুতই ক্যাম্প আক্রমণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে।’

তুষার আর ঈশাণবালা একে অপরের হাত ধরে দাঁড়িয়ে আছে। আমি তাদের দিকে তাকিয়ে বললো, ‘বাহ, তোমাদের তো কোনো ভয় নেই! মরলেও একসাথে বাঁচলেও একসাথে।’

যুদ্ধের এই দুঃসময়েও সবাই হেসে উঠলো।

রূপালি হাসলো না। সে ভাবছে, মানুষের প্রতি মানুষের ভালোবাসা কী জিনিস সে জানতো না। আজ এদের সাথে থেকে থেকে মানুষের প্রতি সহজাত ভালোবাসা কী সে তা বুঝেছে। একটা মেয়েকে ক্যাম্পে রেখে পাক-আর্মিরা সমানতালে ধর্ষণ করেছে, তারপর কী ভেবে তাকে ছেড়ে দিয়েছে। আর সেই নির্যাতিতা নারীকেই নাকি এমন একটি ছেলে বিয়ে করেছে, যে তাকে শুধুই ভালোবেসেছে দেশের খাতিরে। দেশের সম্মান বজায় রাখতে একজন পথহারা নারীকে দিয়েছে সঠিক পথের সন্ধান। এই তো মানুষ, এই তো মানুষের সঠিক শিক্ষা।

‘একটা কথা বলতে পারি?’ রূপালির অন্যমনস্কতাকে লক্ষ্য করে বললো ইমতিয়াজ।

কথাটা শুনে সচকিত হয়ে ধ্যান ভাঙ্গলো রূপালির। তারপর বললো, ‘আমাকে বলছেন?’

‘হ্যাঁ। তোমাকেই বলছি। তোমাকে ছাড়া আর কাকে বলতে পারি?’

‘জি¦। বলুন। কী করতে হবে? দেশের জন্য জীবন বাজি রাখতে হবে?’ রূপালি প্রশ্ন করলো

‘সেটা তো অবশ্যই, আমরা আজ সবাই এখানে আছি, যুদ্ধ করছি সবই দেশের জন্যই। কিন্তু এর বাইরেও একটি কথা আছে, যা সবার সমানেই এই সময়েই বলতে চাই।’

‘হুঁ’। রূপালির সংক্ষিপ্ত উত্তর।

খুবই সহজ সুন্দর ভাষায় রূপালির চোখের তারায় তাকিয়ে বললো ইমতিয়াজ, ‘আমি কি তোমাকে তুষারের মতোই ভালোবেসে আমার জীবনে পেতে পারি? পেছনের জীবনের সব ভুলে জীবনের বাকি সময়টা দুজনে একসাথে চলতে পারি?’

সবাই হাততালি দিলো ইমতিয়াজের কথায়। রূপালি ভাবনায় বিভোর। তার ঠোঁট দুটি নড়ছে না, শুধু কাঁপছে।

এবার কথা বললো আমির, ‘ওরে দেশের যুদ্ধের মধ্যে আরেক জীবন যুদ্ধের গল্প শুরু হলো রে! আচ্ছা, হ্যাঁ, ভালোই তো। বিয়ে-শাদী হয়ে যাওয়া ভালো। বলা তো যায় না, কে কখন শত্রুর রাইফেলের বুলেটে চলে যায় শাহাদাতে। তার আগে জীবনের শেষ ইচ্ছাটা অন্তত পূরণ করে নেওয়া ভালো।’

এবার ইরফান অধরার দিকে তাকালো। অধরাও ইরফানের কাছাকাছি এলো।

ইরফান অধরাকে বললো, ‘তুমিও কি রাজি? তাহলে দুটো বিয়ে একসাথেই হয়ে যাক।’

অধরার ঠোঁট দুটি ফাঁক হলো। তার আগেই ইরণা বললো, ‘আপু তো অনেক আগেই ইরফান ভাইয়াকে হ্যাঁ বলে দিয়েছে ভালোবাসার জবাবে। এখন শুধু দুটি হাত এক হওয়া বাকি। এই অপূর্ণতা রেখে লাভ কি? আমরা আগামীকাল থেকে যেহেতু মহান যুদ্ধে অংশীদার হতে যাচ্ছি, তার আগেই আমাদের ভালোবাসার যুদ্ধটা শেষ হয়ে যাক, একটা চিন্তা অন্তত কমে যাবে। ভালোবাসার শক্তিতে আমরা ঝাঁপিয়ে পড়ে শত্রুপক্ষকে ঘায়েল করতে সুবিধা হবে।’

ইরণার কথায় সবাই যেনো আশার আলো খুঁজে পেলো।

এবার কথা বললো অধরা, ‘জীবনের অনেক কঠিন বাঁক পেরিয়ে আজ আমরা সবাই এই রণক্ষেত্রে এসেছি। এই মুহূর্তে আমাদের মনের ভালোবাসার চাইতে দেশের ভালোবাসাটা মুখ্য হয়ে উঠেছে। আমরা যদি দেশকে রক্ষা করতে না পারি, তাহলে আমাদের ব্যক্তিগত চাওয়া-পাওয়া, ভালোবাসা মূল্যহীন। শত্রুরা আমাদেরকে সুযোগ পেলেই রক্তাক্ত করবে, হীন বাসনা পূরণ করবে, দেশের মানুষদেরকে রক্তের বন্যায় ভাসাবে। তাই এখন আমাদের উচিত আমরা কীভাবে দেশের জন্যে নিজেদেরকে প্রস্তুত করবো, কীভাবে হানাদার বাহিনীকে ঘায়েল করবো, সেই পরিকল্পনা করা। কারণ আমাদেরকে জয়ী হতেই হবে।’

তুষার ঈশাণবালার হাতটি ধরে রেখেছিল। একথা শুনেই ঈষাণবালার হাতটি ছাড়লো। তারপর ঈষাণবালাকে বললো, ‘অধরা যেভাবে ভেবেছে আসলে আমাদেরকে এভাবেই ভাবা উচিত। দেশের পরিস্থিতি অনুসারে এখন আমাদের যা করা দরকার তাই করতে হবে। যদি আমরা যুদ্ধে জয়ী হতে পারি তারপর ব্যক্তিগত বিষয় নিয়ে ভাবা যাবে।’

ইমতিয়াজ এবার রূপালির দিকে তাকালো। রূপালির ঠোঁট দুটি নড়ছে। সে রূপালির কাছে এসে তার হাত ধরে বললো, ‘যদি আমরা যুদ্ধে জয়ী হতে পারি তাহলে তোমার সাথে দেখা হবে প্রিয়তমা। এর আগে আর কোনোদিন তোমার কথা ভাববো না।’

রূপালির ঠোঁট দুটি এবার কথা বলে উঠলো। তারপর সে বললো, ‘আমারে পাক বাহিনী খুবলে খুবলে খেয়েছে, আমার যৌবন নিয়ে খেলেছে, আমি তাদের ক্যাম্প থেকে বের হবার আগে রওনাক হাসান নামের একটা পাক কুকুরের বুকে ছুরি বসিয়ে দিয়ে রক্তাক্ত করে এসেছি। আমার সামনের পথচলা হবে আগুনের রাস্তায়। যদি বেঁচে থাকি তাহলে তোমাকে আমি ভালোবাসবো। আর যদি মরে যাই, তাহলে দেশের জন্যেই লড়তে লড়তে মরবো। এতো কিছু জানার পরও তুমি আমাকে ভালোবেসেছো, এটাই আমার দুনিয়ার শ্রেষ্ঠ পাওয়া, তোমাকে ধন্যবাদ হে শ্রেষ্ঠ মানব। আমাকে তুমি স্ত্রীর আসনে বসিয়ে আমার মনের কষ্টগুলোকে চাপা দিয়ে রেখেছো। বাকি কষ্টগুলো দূর হবে, যদি আমরা আমাদের সামনের যুদ্ধে জয়ী হতে পারি। যদি দেশকে এই বর্বরদের হাত থেকে রক্ষা করতে পারি। এই জানোয়ারদের এই দেশ থেকে তাড়াতে হবেই...।

রূপালির শেষ কথাটা উপস্থিত সবার বুকে এমন জোরে প্রতিফলিত হলো, যেনো একটা অদেখা ছুরি এসে বিঁধেছে সবার অন্তরে। সবার মাঝে একটা কঠিন প্রতিক্রিয়া দেখা গেলো। এরা শপথ নিলো, হয় দেশের শত্রুদের মেরে বাঁচবো, না হয় যুদ্ধ করতে করতে মরবো।

মানুষের মাঝে মহামিলন এমনিতেই আসে না। মহামিলনের জন্যে বুকভরা কষ্ট বয়ে নিয়ে জীবনকে সামনের দিকে অগ্রসর করে নিতে হয়। জীবনযুদ্ধে জয়লাভ করতে হলে কষ্ট করতে হয়। কারণ নিশ্চয় কষ্টের সাথে স্বস্তি আছে। এটা প্রমাণিত সত্য। এসব কথা ভাবছে আমির। সে তার জীবনকে অনেকভাবেই দেখেছে। উল্টেপাল্টে। কিন্তু জীবন এক সময় একেকরূপে ধরা দেয়। কখনও সুখ আর কখনও দুঃখ। এটা একটার সাথে আরেকটা জড়িত। যদি দুঃখ না আসে তবে সুখের দেখা যাওয়া যায় না। আর যখন সুখ আসবে তখন বুঝে নিতে হবে দুঃখটাও খুবই নিকটে।

এপর আমিরের হৃদয়ে কিসের যেনো একটা হাহাকার উথলে উঠলো। তার মনে হলো বুকের মাঝে কিছু একটা শূন্যতা তাকে যেনো সপ্তম মেজাজের শূলে তুলে দিচ্ছে। হ্যাঁ, এবার মনে হলো--সুজানা। সুজানার ভাবনা তার হৃদয়ে প্রোথিত হয়ে আছে। কী করছে সুজানা? ভাবছে আমির। তাকে কি পাক বাহিনী তুলে নিয়ে গেছে?

এসব ভাবতে ভাবতে হঠাৎই তার মনে হলো, আরে আমি এসব কী ভাবছি? আমার কাছে তো সুজানার চাইতে দেশ বড়। এই দেশে এমন লাখ লাখ সুজানা ভালোবাসার মানুষের অপেক্ষায় রয়েছে। তাদের অপেক্ষার অবসান ঘটাতে এই দেশটাকে পাক-বাহিনীর থাবা থেকে রক্ষা করতে হবে। তাহলে আমি শুধু একজন সুজানার কথা ভাবছি কেনো? নিজকে নিজে সান্ত¡না দিয়ে উঠে বসলো আমির। যে করেই হোক, আগামীকালই সবাইকে নিয়ে চূড়ান্ত যুদ্ধে অবতীর্ণ হতে হবে, পাকবাহিনী ও রাজাকার বাহিনীকে এই দেশ থেকে চিরতরে নিমূর্ল করতেই হবে। (চলবে)

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়