সোমবার, ২০ মে ২০২৪, ৬ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১, ১১ জিলকদ ১৪৪৫  |   ২৮ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   এসএসসি সমমানের পরীক্ষার ফল প্রকাশ

প্রকাশ : ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ০০:০০

খণ্ডে খণ্ডে অখণ্ড জীবন

পীযূষ কান্তি বড়ুয়া
খণ্ডে খণ্ডে অখণ্ড জীবন

(চতুর্দশ পর্ব) মিডল্যান্ড ক্লিনিকে একটানা প্রায় বছর দেড়েক কাজ করলাম। শুরুতে মোটামুটি রোগী হলেও একসময় পুরো হাসপাতালে রোগী ভরে যেতো। এমনও হয়েছে, রোগীর ভিড়ের জন্যে আমার রুমও ছেড়ে দিয়েছি কখনও কখনও। তখন ইমার্জেন্সি রুমের চেয়ারে বসেই আমার রাত কাটতো। রাত দুটো থেকে রাত চারটার মধ্যেই ক্রিটিক্যাল কন্ডিশনের রোগীরা দূর দূরান্তের গ্রামগুলো থেকে ক্লিনিকে ভিড় করতো। তখনও গ্রামে গ্রামে কমিউনিটি ক্লিনিক হয়নি। বিশেষত ফুল টার্ম প্রেগন্যান্সির রোগীগুলো আসতো গ্রামের অশিক্ষিত দাই এবং পল্লি চিকিৎসকদের হাতে নির্যাতিত হয়ে। সিজার অপারেশন সম্পর্কে হবু শ্বশুরবাড়ির লোকেদের ভুল ধারণার কারণে সবাই একে এড়াতে চাইতো। ফলে গ্রামের শিক্ষাহীন ও প্রশিক্ষণহীন ধাত্রীরা ছিলো এদের বৈতরণী পার হওয়ার নাইয়া। বুঝুক বা না বুঝুক, হেঁচকাণ্ডহেঁচকি দিয়ে প্রসূতি ও তার গর্ভস্থ ভ্রূণের বারোটা বাজিয়ে দেয়। যে প্রসূতির প্রসব বেদনা শুরু হয় সকাল আটটায় তাকে নিয়ে টানাটানি করতে করতে বাজায় রাত দুটো। তারপর অকূল কিনারা হয়ে ওঁৎপেতে থাকা পল্লি চিকিৎসকদের খপ্পরে পড়ে। রাতের দুটো তিনটেয় হাসপাতালের গেটে বাড়ি দেওয়া মানেই ধরে নিতাম, এইসব গ্রামীণ মায়েদের আর্ত চিৎকার। প্রায় শতকরা নব্বই ভাগ ক্ষেত্রেই অনুমান সত্যি হতো। দেখতাম, পল্লি চিকিৎসক একগাল পান খাওয়া হাসি দিয়ে অভ্যর্থনা জানাতো। শিকার উপস্থিত করে নগদ নারায়ণের লোভে তার দুচোখ চকচক করতো। তখন মনে হতো, রাত গভীরে সারা গায়ে সরিষার তেল মেখে পিছলা করে সিঁদ কাটতে যাওয়া চোর আর এসব পল্লি চিকিৎসকের মধ্যে কোনো ভেদ নেই। সকাল আটটায় প্রসব বেদনা ওঠা প্রথম মাতৃত্বের কিশোরী মেয়েটাকে ক্লিনিকে এনে তারা ফেলে রাতের দুটোয়। ফলে তখন আর সত্যিকারের চিকিৎসকদের কিচ্ছু করার থাকে না। রাতের সঙ্কটাপন্ন রোগীদের বেসরকারি ক্লিনিকে চিকিৎসা সেবা দেওয়ার ক্ষেত্রে যেটা সবচেয়ে বড় ঝক্কি তা হলো সার্জন ও অ্যানেস্থেশিয়ার ডাক্তারের জুটি মেলানো। মহিলা ডাক্তারের ক্ষেত্রে একটা বড় সঙ্কোচ কাজ করতো। আদৌ তিনি আসতে পারবেন কি না। কখনো কখনো একসাথে দুটো-তিনটা এরকম রাতের রোগী আসতো। তখন ওটি করতে করতে সকাল হয়ে যেতো। আঁধারের ঘন আস্তরণ ভেদ করে নবরাগে স্নাত শিশু সূূর্যকে ভূমিষ্ঠ হতে দেখে মনে হতো, বিশ্বপিতার কী অপার মায়া নিয়ে অরুণের আদৃত ক্রন্দনে দিকচক্রবাল আরক্ত হয়ে উঠেছে। স্নিগ্ধ মলয়ের মমতায় তখন রাতের সাথে যুঝে যাওয়ার ক্লান্তি নিমিষেই কেটে যেতো। মিডল্যান্ডে কাজ করতে করতেই হাতের পাঁচ আঙুল সমান না হওয়ার সুবিধা ভোগ করেছি অকুণ্ঠ। গরীবের সার্জন ডাঃ মোবারক ভাইকে সাথে নিয়ে তৃতীয় কোনো অ্যাসিস্ট্যান্ট সাথে না নিয়ে আমরা কাজ করেছি। ওটির সময় মোবারক ভাইয়ের নেতৃত্ব গুণ অসাধারণ। হিমালয়ের বরফের মতো শীতল মাথা, উদ্দীপ্ত পরমাণুর ইলেকট্রনের মতো সক্রিয় ছিলো দক্ষতা। তাকে এক সময় প্যান সার্জন উপাধিতে ভূষিত করেছিলাম আমি আর শাহীন।

মিডল্যান্ডে কাজ করতে করতে দুই পাতার সাদাকালো স্থানীয় পত্রিকাগুলো দেখে কষ্ট হতো। বনেদী আজাদী আর আধুনিক পূর্বকোণ হাতে নেওয়ার স্পর্শ সুখ নিমিষেই ম্লান হয়ে যেতো। একটানা দেখতে দেখতে ধীরে ধীরে তা চোখ সওয়া হয়ে যায়। ঈদে ও উৎসবে কিংবা জাতীয় দিবসে ছবিসহ ছাপানো শুভেচ্ছার হিড়িক পড়তো। তখন এগুলোকে পত্রিকা না ভেবে দরিদ্র প্রচার প্রয়াসী নেতা যশোপ্রার্থীদের পোস্টার বলে ভ্রম হতো। মাঝে মাঝে আমিও এরকম দুয়েকবার শুভেচ্ছা শিকারীদের কবলে পড়েছিলাম। একটা ছোট শহরে এতোগুলো পত্রিকা মানেই শুভেচ্ছা শিকারীদের স্বর্গরাজ্য তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। প্রতিদিন সকালে পাতলা ডাল, আলুভর্তা আর গরম নরম তেলে ভাজা পরোটাকে সর্বান্তঃকরণে আপন করে নিতে নিতে স্থানীয় পত্রিকাগুলো হাতে নিতাম। একদিন কর্তৃপক্ষ আগের পত্রিকা পাল্টিয়ে দৈনিক চাঁদপুর কণ্ঠ রাখতে শুরু করে। পত্রিকাটি হাতে নিয়ে মন ভালো হয়ে গেলো। পত্রিকার নামলিপি থেকে সংবাদের শিরোনামে সর্বত্র স্বস্তি খুঁজে পেলাম। তখনো স্থানীয় পত্রিকাগুলোর সাহিত্য মান চোখে পড়েনি। নিজের পাঠকসত্তাকে নিবৃত্ত করতে সাথে আনা বইয়ের রসদের দ্বারস্থ হতাম। হুমায়ূন আজাদের 'দ্বিতীয় লিঙ্গ' বইটি তখন বেশ আলোচিত হতে শুরু করেছে। একজন মেডিক্যাল রিপ্রেজেন্টেটিভকে দিয়ে বইটি আনিয়ে নিলাম ঢাকা থেকে। সন্ধ্যার পর থেকে ভাত খাওয়ার রাত পর্যন্ত সময় পেতাম নিজের মতো করে। ফলে 'দ্বিতীয় লিঙ্গ' একাধিকবার নেড়ে শেষ করে ফেললাম। মনের জমিতে তার বীজ উপ্ত হলো ভালো ভাবেই। নিজ তাগিদে সিমোন দ্য বেভোয়ারকে নাড়াচাড়া শুরু করলাম। বেভোয়ার ধরা দিলেন সহজেই। তবে একা নন। সাথে তসলিমা নাসরিনও। তাঁর লজ্জাকে সাথে নিয়ে পড়ায় সবটা একসাথে হৃদয়ঙ্গম হলো। এই পাঠ আমাকে পরবর্তী সময়ে ঈভ টিজিং বিরোধী কবিতাপত্র লিখতে প্রেরণা যোগায়।

দেড় বছরের প্রথম দফার অবস্থানে স্থানীয় কোনো সুধীজনের সাথে আমার তেমন কোনো পরিচয় তৈরি হয়নি। তবে চাঁদপুর কলেজ শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি জাহাঙ্গীর বেপারী এ সময় গৌতমের মাধ্যমে আমার সাথে পরিচিত হয়। আমার বাসায় জাহাঙ্গীর তার জীবনের পবিত্র অংশের প্রথম ভাগ সম্পন্ন করে। এ কারণে তার প্রতি আমার প্রীতি গভীর। এ প্রসঙ্গে কয়েকজনের কথা আমি না বললেই নয়। গৌতম ছিলো একজন জন্ম হতেই ভাগ্য বিড়ম্বিত মানুষ। বুদ্ধের নামের সাথে তার নামের মিল ছিলো বলেই তার প্রতি আমার স্নেহ হিমালয় হতে পতিত গঙ্গার ধারার মতোই পবিত্র ও অবারিত ছিল। স্ট্রোক আক্রান্ত বাবা আর সরল সিধা মায়ের কারণে সে শৃঙ্খলায় না থাকলেও বখে যায়নি। কিন্তু অসচ্ছলতা আর আত্ম নিয়ন্ত্রণের অভাব তাকে পর্যাপ্ত সনদে শিক্ষিত করে তুলতে পারেনি। আড্ডাবাজ আর 'যে কয় রাম তার সঙ্গে যাম' এই স্বভাবের কারণে গৌতম নিজেকে গুছিয়ে ফুটিয়ে তুলতে পারেনি। তার মধ্যেও ছিলো এক প্রণয়ী যুবক। উচ্ছল মায়াবতী এক তরুণীর সাথে তার নিয়মিত ডেট হতো। মাঝে মাঝে আমাকে গৌরি সেন হওয়া লাগতো। অল্পকিছু টাকা হলেই তার এক একটা দিন হয়ে যেতো মহাকাব্যিক। এই সম্পর্কের জ্বালানী যোগাতে গৌতম হয়ে যায় ঔষধ কোম্পানির বিক্রয় প্রতিনিধি। তবে তার কোম্পানির বোতল ছিলো বেশি, কাগজের খাপ ছিল কম। খুব করে ধরলো লিখে দিতে হবে। আমার পাশাপাশি নোভা এইডের মিজান ভাইও লিখে দিতেন তাকে। কী লেখা যায়, কী লেখা যায় ভাবতে ভাবতে বের করলাম, তার একটা রুচি বর্ধক বোতল আছে। ব্যস। ওই একটা বোতলের বদৌলতে গৌতম তার ডেটের দিনগুলো বীরত্বের সাথে পার করতো। কিন্তু সুখ যদি মানুষের চিরস্থায়ী হতো তবে তো স্রষ্টাকেই ভুলে থাকতো মানুষ। তাই গৌতমও তার ব্যতিক্রমের আওতায় ছিলো না। মেয়ের পরিবারের চাপাচাপিতে গৌতমের সুখ গেলো তাসের ঘরের মতো ভেসে। তখনও গৌতম আর্থিক সচ্ছলতায় ও শিক্ষায় সুপাত্র ছিলো না। তাই দিনশেষে গৌতম হলো দেবদাস আর আর পাখিহীন খাঁচা নিয়ে বুকে, কোনো এক চুনীলালের ফাঁদে পড়ে কলজেয় জ্বালিয়ে তোলে ক্ষয়ের আগুন। আহা! গৌতম! কখনো কখনো কলজেয় জ্বালানী সরবরাহ করতে গিয়ে সে ভেঙে ফেলে কর্মস্থলের আমানত। ফলে কর্ম হতে ছুটি পেয়ে হয়ে যায় নিজেই নিজের জীবনের রাজা।

গৌতম ছাড়াও আরও দুজনের সাথে আমার ঘনিষ্ঠতা হয়। একজন বাকশিল্পী মুজিবুর রহমান ফরহাদ। তিনি ছিলেন সে সময় ফরিদগঞ্জ আসনের এমপির ব্যক্তিগত রাজনৈতিক সহকারী। যে কোনো অনুষ্ঠানের সঞ্চালনায় তার মুখে ছুটতো কথার ফুলঝুরি। যে কোনো বিষয়ে রস মন্থন করায় তার জুড়ি মেলা ভার। অনুকূল সময় পেয়ে তার বিকাশ ও প্রসার হয়েছিল তরতর করে। প্রকৃতির এটাই নিয়ম। অনুকূল সময়েই ফুল ধরে ফল হয়। মুজিবুর রহমান ফরহাদেরও একই হাল। রস মন্থনে ব্যস্ত হলে তার বাকভঙ্গিতেও তা চুয়ে চুয়ে পড়তো। আর একজন ছিলেন ডাঃ আনোয়ারুল আবেদিন। তিনি আল্ট্রা সনোগ্রাম করতেন। দাম্পত্যে দুর্ঘটনার কারণে ঝামেলা এড়াতে চাঁদপুরে খ্ুঁটি গেঁড়েছিলেন। মুখে কথার তুবড়ি ছিলো। মাঝে মাঝে আমার সাথে কিছু কিছু বিনিময় করতেন, ভাবের, পরিকল্পনার। পরামর্শও চাইতেন। স্নেহ আর সমীহের মিশেল ছিলো তাঁর। হিমসাগর আম তাঁর বড্ড প্রিয় ছিলো।

দুহাজার চার সালের আগস্টে আমার ডাক পড়লো বাড়িতে। মেজদা মার্কিন মুল্লুকে যাবেন। পোস্ট ডক্টরাল ফেলোশিপ শেষে। কোনো এক মার্কিন অধ্যাপকের তত্ত্বাবধানে ক্যান্সারের জিন নিয়ে গবেষণায়। কাজেই বাবা-মা'র কাছাকাছি থাকা দরকার। এটাকেই বলে হয়তো নিয়তি। তখন আমি সকাল হতে দুপুরে বাবুরহাটের চেম্বারে রোগী দেখি দৈনিক গড়ে তিরিশটা। আমার এই জমানো চেম্বার রেখে যাওয়াটা বড্ড কঠিন। কিন্তু উপায় নেই। শেকড়ের পড়েছে ডাক। তবে এই ডাক আসলে ছিলো সময়ের ডাক। এর কিছুদিন পরেই বাবা তীব্র ডায়বেটিস আক্রান্ত হয়ে স্ট্রোকাক্রান্ত হলেন। হাঁটার ওপর কোনো নিয়ন্ত্রণ ছিলো না। যেদিকে কদম বাড়ান সেদিকে আগাতেন না। অর্থাৎ তাঁর গেইট কোঅর্ডিনেশন ছিলো না। মুখের কথাতেও কন্ট্রোল ছিলো না। মা খেয়াল করলেন, তিনি অপরিচিত কেউ এলে তার সাথে বেশি কথা বলছেন। নিয়ে গেলাম আমার স্যার ডাঃ মাহতাবউদ্দিনের কাছে। আমি থাকলাম তদারকিতে। আমি থাকলে তিনি লুঙ্গিটা কষে গিঁট দিয়ে পুলিশের ডাবল মার্চ করার ভঙ্গিতে হাঁটতেন ঘাম ঝরিয়ে। মেহের বিল্ডিংয়ের বাসার নিচে এক চিলতে হাঁটর জায়গায় তিনি হাঁটতেন। আমি না থাকলে বাসায় ছোটভাই পুষ্পের দেওয়া কালো রকিং চেয়ারটাতে দোল খেতেন আর বারান্দা হতে রাস্তায় মানুষের ছোটাছুটি দেখতেন। ফিজিওথেরাপি আর উপযুক্ত চিকিৎসার ফলে বাবাকে বসে থাকতে হলো না। চলৎশক্তি ফিরে পেলেন। মেয়েদের বাসা কাছাকাছি হওয়ায় তারা কেউ সকালে নুডলস্, কেউ চিনি ছাড়া পিঠা বানিয়ে এনে বাবাকে সঙ্গ দিতেন। বড়দি সময় করে বাবার পায়ের নখ কেটে দিতেন সময় হলেই। বাবার বুড়ো আঙুলের পায়ের নখ বেঁকে গিয়ে দেবে যেতো মাংসে। বড়দির রীতিমতো কসরত করতে হতো সেই নখ ছেঁটে বাবাকে স্বাস্থ্যগতভাবে পরিচর্যা করতে। বাবার এই পায়ের নখের ধাত আমার ওপরও বর্তেছে। কখনও কখনও নখও ভেঙে যায়। বাবাকে পরিচর্যাকারী আরেকজন মানুষ হলেন আমার মেজবৌদি। তাঁর হাতে বাবা চা পেলে খুশি হতেন।

দুহাজার চার সালের সেপ্টেম্বরে চট্টগ্রাম ফিরে গিয়ে আমি অগোছালো হয়ে পড়ি অনেকটাই। দুয়েক জায়গায় চেম্বার করার চেষ্টা করলেও হয়ে উঠেনি। কেননা আমার অতদূরে যেতে মন চাইতো না। মন পড়ে থাকতো বাবুরহাট চেম্বারে। মাঝে মাঝে ফোনে কথা হতো বোরহান-কিশোরদার সাথে। এভারগ্রীনের পুরানো আড্ডায় যাই। নাজিম ভাই আমাকে একদিন ডেকে পরিচয় করিয়ে দিলেন এক এনজিওর কো-অর্ডিনেটরের সাথে। তাদের একটা নতুন প্রজেক্ট এসেছে। ব্র্যাকের সাথে কনসোর্টিয়াম। অভ্যন্তরীণ অভিবাসীদের মধ্যে ছড়িয়ে যাওয়া এইডস্ রোগের বিস্তার রোধ ও যৌন রোগের নিয়ন্ত্রণ বিষয়ে প্রকল্প। কিন্তু খণ্ডকালীন হলেও তা ছিলো দূরে হালিশহর এবং খুব একটা আহামরিও নয়। আমার মতো মানুষের জন্যে তো নয়ই। কিন্তু নিয়তি আমাকে টেনে নিয়ে গেলো সেখানেই। এতো নগণ্য বিষয়ের জন্যে নাজিম ভাই আমাকে ডেকে নিয়ে না গেলেও পারতেন। তখন আসলে আমার আবারও পড়ায় ঢুকে যাওয়া উচিত ছিলো। যাই হোক, আর্থিকভাবে অলাভজনক, পেশাগতভাবে তুচ্ছ একটা খণ্ডকালীন কাজে আমি শুরু করলাম আসা-যাওয়া। এই এনজিওর যিনি প্রধান তিনি মোটামুটি একজন অত্যন্ত জটিল চরিত্র। এনজিওতে গিয়ে যেটা বুঝলাম, তা হলো কথা বেশি কাজ কম। কাজ না করলেও অসুবিধা নেই, কিন্তু শো করো বেশি। যা নয় তা দেখাও। দুইকে দশ করো। বাস্তবে কাজ না হলেও চলবে কিন্তু ছবি থাকা চাই। টাকা দিয়ে র‌্যালিতে লোক আনতে হবে। র‌্যালিতে লোক যতবেশি দেখানো যাবে ততবেশি প্রজেক্টের অনুদান। এই কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে আসলে অভ্যন্তরীণ অভিবাসীদের মধ্যে তেমন কোনো সাড়া তৈরি হয়নি। ফলে প্রতি র‌্যালিতেই টাকা দিয়ে টার্গেট পপুলেশনকে জমায়েত করতে হতো। যিনি এনজিওটির কো-অর্ডিনেশন করতেন তিনি যোগাযোগ দক্ষতা ভালোই রপ্ত করেছিলেন। তার নেতৃত্ব গুণের কারণে কম দক্ষতার কর্মীগুলো খেয়েপরে বেঁচেছিলো। তবে কর্মীদের খুঁত ধরতে ও গালাগাল দিতে তিনি কার্পণ্য করতেন না। চট্টগ্রাম জেলা পরিষদে এবং জেলা সিভিল সার্জন কার্যালয়ে এসময় দুটো এইডস্ রোগের বিস্তার ও প্রতিরোধ বিষয়ে সেমিনার হয়। আমি ছিলাম কী-নোট স্পিকার। জেলা সিভিল সার্জন মহোদয় আমার প্রবন্ধ উপস্থাপন নিয়ে অত্যন্ত সন্তুষ্ট ছিলেন এবং সরাসরি আমার প্রশংসা করেছেন। জেলা পরিষদের মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত সেমিনারে উপস্থিত মুখ্য আলোচক ছিলেন স্থানীয় প্রেসক্লাবের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক। তিনি আপত্তি তুললেন, সেমিনারের কী-নোটের ভাষা কেন ইংরেজি হবে, বিশেষত সেটা যখন ফেব্রুয়ারিতে আয়োজিত হয়েছিলো। আমি নিয়মমাফিক একবার সুযোগ পাওয়ার কথা, এর উত্তর দিতে। কিন্তু আমার উত্তরে ঐ সাংবাদিক ভাই আবার কী প্রতিক্রিয়া দেখান তা ভেবে সংস্থার নির্বাহী পরিচালক মহোদয় আমাকে নিবৃত্ত করেন। নির্বাহী পরিচালক মহোদয় একজন প্রাণিবিজ্ঞানের ছাত্রী ছিলেন। তিনি জানেন, বিজ্ঞানের বিষয় বিশেষ করে চিকিৎসা বিজ্ঞান ও রোগতত্ত্ব চাইলেও বাংলায় পূর্ণাঙ্গ সাবলীলভাবে উপস্থাপন করা সম্ভব নয়। তাছাড়া বৈজ্ঞানিক সকল পরিভাষারও শ্রুতিশুদ্ধ বাংলায়ন সম্ভব নয়। উপরন্তু এইডস্ প্রতিরোধ বিষয়টি একটা আন্তর্জাতিক জাজ্বল্যমান বিষয় ছিলো তখন। কাজেই ইংরেজিই ছিলো এর উপযুক্ত মাধ্যম। যাই হোক, আমি কিছু বলার সুযোগ না পেলেও উপস্থিত অধিকাংশ শ্রোতাই এর সাথে একমত ছিলেন না এবং চিকিৎসা বিজ্ঞান বিষয়ে তার অজ্ঞতা ও দীনতায় হাসাহাসি করেছিলেন। এনজিওতে সংক্ষিপ্ত সময়ের দায়িত্ব পালনকালে ব্র্যাকের সদর দপ্তরে রেকর্ড কিপিং ও প্রকিউরমেন্ট বিষয়ে ট্রেনিং করতে যাই। ঐ ট্রেনিংয়ে আমি যেভাবে আমার কার্যালয়ে রেকর্ড কিপিং করতাম তা বিশদ বিশ্লেষণ করে কর্তৃপক্ষ আমার পদ্ধতিটাই প্রাতিষ্ঠানিকভাবে গ্রহণ ও অনুমোদন করে। একবার ফয়'স লেকে এনজিওর পক্ষ থেকে পথনাটক 'লিলি বানুর সংসার ' মঞ্চস্থ হয়। নাটকটি রচনা করেন নির্বাহী পরিচালকের জীবনসঙ্গী ও কবি ড. সুলতান মুহাম্মদ রাজ্জাক। এতে সংলাপ রচনায় সহযোগিতা করেন এনজিওর প্রজেক্ট কো-অর্ডিনেটর শেখ আমেনা আহম্মেদ। আমি ছিলাম নির্দেশনায়। তবে নির্দেশনা আসলে নয়, সার্বিক তত্ত্বাবধান করেছিলাম। পথচারী ও দর্শনার্থীদের মন জয় করেছিলো আমাদের পরিবেশনা। এতে যে গানগুলো ছিলো ওগুলো মূলত প্যারোডি করা সুর। গীত রচনা করেছিলেন নির্বাহী পরিচালক আফরোজা পারভীন।

এনজিওতে কাজ করাকালীন একটা মজার ব্যাপার ছিলো। একবার কর্মীরা সবাই ভ্রমণে কক্সবাজার যাই। রিকশা যোগে সমুদ্রের নিকটবর্তী হলে আমার পাশে থাকা কালাম ভাই বিস্ময়ে চিৎকার করে উঠে, দাদা! এ যে দেখি আমাদের কুষ্টিয়ার পদ্মার থেকেও বড়! আমি কথা শুনে হাসতে ভুলে গিয়েছিলাম। (চলবে)

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়