সোমবার, ২০ মে ২০২৪, ৬ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১, ১১ জিলকদ ১৪৪৫  |   ২৮ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   এসএসসি সমমানের পরীক্ষার ফল প্রকাশ

প্রকাশ : ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০০:০০

শৈশবের ঈদ স্মৃতি

মেহেরাব হোসেন
শৈশবের ঈদ স্মৃতি

আমাদের শৈশবে চাঁদপুরের মতো শহরতলি এলাকায় ঈদের দিনগুলো ছিলো এখনকার চেয়ে অনেক আলাদা। আজ থেকে প্রায় দেড়যুগ আগের সেই দিনগুলোতে সাধারণ মানুষজন এতোটা আত্মকেন্দ্রিক ছিলো না। এতো উঁচু উঁচু দালান ছিলো না সবার বাসায় গেট বন্ধ ছিলো না। সামাজিকভাবে মানুষজন একে-অপরের সাথে পরিচিত ছিলো। সামাজিক আচার অনুষ্ঠানে সক্রিয় ছিলো। বিশেষ করে ঈদ আসার কিছুদিন আগে থেকেই সমাজের মানুষজনের মাঝে একটা অন্যরকম আনন্দের আমেজ তৈরী হতো। সেই আমেজ ঠিক এখনকার সময়ের মতো নয়। আগেকার দিনগুলোতে কেবল ঈদ নয় ছোট খাটো পারিবারিক অনুষ্ঠান উপলক্ষে প্রতিবেশী মানুষজন সহ সমাজের আগ্রহ ও অংশগ্রহণ করাটা চোখে পরার মতো ছিলো।

মানুষজনের হাতে তখন এন্ড্রয়েড মোবাইল ফোন ছিলো না তাই নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত থাকার উপায় ছিলো না বললেই চলে। তাই ছুটি আর অবসরে সময় কাটানোর সবচেয়ে ভালো উপায় ছিলো বন্ধুবান্ধব ও আত্মীয়-স্বজনদের সাথে দেখা-সাক্ষাৎ করে সময় কাটানো।

আমাদের সময়ে ঈদের আগের রাতের আনন্দ ছিলো ঈদের দিনের তুলনায় অনেক বেশি। প্রতিটি পাড়ায় শিশুরা তাদের সমবয়সী বন্ধুদের সাথে বের করতো আনন্দ মিছিল সেখানে স্লোগান হতো, রাত পোহালে কিসের দিন? ঈদের দিন ঈদের দিন। বড়দের ব্যবস্থাপনায় আলোকসজ্জায় সজ্জিত হয়ে উঠতো পাড়া মহল্লা। উঠতি বয়সের ছেলেরা শোরগোল আর আতশবাজি নিয়ে ব্যস্ত থাকতো। মেয়েরা একে অপরের হাতে বাহারি ডিজাইন করে মেহেদি পরিয়ে দিতে ব্যস্ত হয়ে পড়তো। ঈদের আগে একে অপরের ঈদের পোশাক দেখতে চাওয়াটা ছিলো ঈদের আগে বড় আনন্দের বিষয়। ছোট ছেলে মেয়েরা তাদের ঈদের জামা লুকিয়ে রাখতো সযত্নে যেন কোন বন্ধু বান্ধবী তাদের নতুন জামা জুতো দেখে না ফেলে। এখনকার সময়ে অধিকাংশ মানুষই ঈদের জামাটাও পড়ে ফেসবুকে বা ইনস্টাগ্রামে একটি ছবি আপলোড করার জন্য। যেহেতু তখনকার দিনে আমাদের হাতে হাতে মোবাইল ছিলো না ফেসবুক-ইন্সটাগ্রাম ছিলো না আমরা নতুন জামা গায়ে দিয়ে পুরো এলাকায় ঘুরে বেড়াতাম সকল বন্ধু-বান্ধবদেরকে দেখানোর জন্য।

সে সময়ে ঈদের দিনে আসেপাশের প্রতিবেশীদের বাসায় যাওয়াটা ছিল বাধ্যতামূলক ব্যাপার। ঈদের দিনের সকালে সেমাই রান্না করে আশেপাশের প্রতিবেশীদের ঘরে পৌঁছে দেয়াটা ছিল ঈদের আনন্দের বড়ো একটা অংশ। ছেলেরা সবাই মিলে খুব সকালে দল বেঁধে পুকুরে বা নদীতে গোসল করে নতুন পাঞ্জাবি গায়ে দিয়ে ঈদের জামাতে অংশগ্রহণ করা এখনকার তুলনায় অনেক বেশি আনন্দের ছিলো। ঈদের নামাজ শেষে এলাকার প্রতিবেশী সহ আশেপাশের পরিচিত অপরিচিত সবার সাথে কোলাকুলি করা। ঈদের নামাজ শেষ করে আশেপাশের মানুষদের বাসায় গিয়ে তাদের সাথে কুশল বিনিময় করা। তাদের সাথে হালকা নাস্তা করা মানেই ছিল ঈদের আনন্দ। আশেপাশে প্রতিবেশী কারো বাসায় না গেলে তারা খুবই কষ্ট পেতো। এখনকার সময়ে কারো বাসায় যাওয়া তো হয়ইনা বরং ঈদের জামাত শেষ করে কে কত তাড়াতাড়ি বাসার গেট বন্ধ করে ফেসবুকে ঈদের পোশাক সহ একটি ছবি আপলোড করে নিজের মোবাইল নিয়ে ব্যস্ত হবে ছোটোবড়ো সবাই সেই চিন্তায় চিন্তিত। তখনকার দিনগুলোতে কেউ এভাবে বাসায় একাণ্ডএকা সময় কাটানোর কথা ভাবতে পারতো না।

আমাদের শৈশবে ঈদের নামাজ শেষ হলেই শুরু হয়ে যেতো শিশুদের ঈদ সালামি সংগ্রহ করার মিশন। দলবেঁধে রাস্তায় হেঁটে হেঁটে প্রতিবেশীদের বাসায় গিয়ে গিয়ে পরিচিত লোকদের সালাম দিয়ে ঈদ সালামি সংগ্রহ করাটা ছিলো দারুণ আনন্দের। দিনশেষে আবার বন্ধুরা সবাই একত্র হয়ে হিসেব করতো কার কতো বেশি টাকা জমা হয়েছে। ঈদের দিনে বিভিন্ন খেলনা সামগ্রীর দোকান বসতো। সালামীর টাকা দিয়ে প্লাস্টিকের সানগ্লাস, প্লাস্টিকের বন্দুক, খেলনা গাড়ি সহ বিভিন্ন প্রকার বাঁশি কেনাটা ছিলো আরো একটি বড় আনন্দের বিষয়। ঈদের দিন বিকেলে ছোট ছেলেমেয়েরা দলবেঁধে কোন নদীর পাড় বা দর্শনীয় স্থানে ঘুরতে যাওয়াটা খুবই উপভোগ্য ছিলো। সবাই সমান টাকা দিয়ে ঘুরতে যাওয়া। কোন ছেলে বা মেয়ের কাছে সালামির টাকা বেশি জমা হলে সে কিছু একটা কিনে সকল বন্ধুদেরকে খাওয়াতো। ঈদের সালামি পকেটে নিয়ে বাসায় ফিরে এলে টাকা হারিয়ে ফেলার ভয় দেখিয়ে টাকাগুলো জমা রাখার আশ্বাস দিয়ে ঈদের সালামি গুলো নিয়ে নিতেন সবার মা। পরে সেই টাকা ফেরত চাইলে আর পাওয়া যেতো না। এরকম করে ঈদের আনন্দের ঘোরে কেটে যেতো প্রায় সপ্তাহখানেক। তারপর আবার স্কুল খোলার টেনশনে পড়াশোনা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে যেতো সবাই। ঈদের পরে পরীক্ষা থাকলে সেই ঈদ কাটতো বড় দুশ্চিন্তায়। বাবা মা খুব বেশি আনন্দ করতে নিষেধ করতেম কেননা সামনে পরীক্ষা। ঈদের আনন্দের ফাঁকে ফাঁকে পড়াশোনা করাটা বাধ্যতামূলক হয়ে যেতো। তখন সেই ঈদকে আর ঈদের মতো লাগতো না।

ঈদের পরবর্তী সময়ে আত্মীয়-স্বজনদের বাড়িতে বেড়াতে যাওয়াটা ছিল আরো এক দারুন অভিজ্ঞতা ও মজার বিষয়। দীর্ঘদিন পর আত্মীয়দের বাড়িতে বেড়াতে গেলে আত্মীয়-স্বজনদের সাথে দেখা করা, তাদের আদর আপ্যায়ন পাওয়ার পাশাপাশি ছোটদের জন্য ঈদের সালামি পাওয়ার সম্ভাবনাও ছিলো খুব। তাই ঈদের পরে আত্মীয়দের বাড়িতে বেড়াতে গেলে ছোটরা খুশি হত সবচেয়ে বেশি। ঈদের আগে পরে নিজেদের বাড়িতে খালা মামারা আসতো সাথে নিয়ে আসতো বিভিন্ন উপহার। সেই সময়ের মনের আনন্দের অনুভূতি আজ ভাষায় প্রকাশ করা খুব কঠিন। ঈদের আগে পরের সময় গুলো দারুন আনন্দে কাটতো আমাদের শৈশবে। আজ যখন ঈদের দিন ফিরে আসে আসে শৈশবে সেই দিনগুলো ভেবে স্মৃতিকাতর হই। শৈশব-কৈশোরে কাটানো সেই সোনালী সময়ের স্মৃতি অমলিন হয়ে থাকবে চিরকাল।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়