সোমবার, ২০ মে ২০২৪, ৬ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১, ১১ জিলকদ ১৪৪৫  |   ২৮ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   এসএসসি সমমানের পরীক্ষার ফল প্রকাশ

প্রকাশ : ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০০:০০

আঁমার মুঁণ্ডুটা লাঁগিয়েঁ দেঁ বাঁপ

পীযূষ কান্তি বড়ুয়া
আঁমার মুঁণ্ডুটা লাঁগিয়েঁ দেঁ বাঁপ

রবি, দুখু আর জীবন এরা তিন বন্ধু। খুব ঘনিষ্ট বন্ধু। সব কাজে তারা তিনজন একসাথে থাকে। স্কুলে এক বেঞ্চিতেই তারা বসে। পড়া যেদিন পারে সেদিন তিনজনে একসাথেই পারে। যেদিন স্যারের বকা খায় সেদিন তিনজনে একসাথেই বকা খায়। তাদের মা-বাবারাও রবি-দুখু-জীবনকে তিন ভাই বলেই জানে। মাঝে মাঝে তিন বন্ধুর কিছু কিছু উদ্ভট ইচ্ছে হয়। যেমন: সাঁতার দিয়ে নদী পার হওয়া, পাহাড়ে উঠে প্রতিধ্বনি শোনা কিংবা অন্যবন্ধুদের বোকা বানানো। অন্য বন্ধুরা তাদের এ কাজগুলো পছন্দই করে। কেউ বিরক্ত হয় না। কারণ তাদের এসব কাজে বুদ্ধির খেলা থাকে দারুণ। বন্ধুরা বোকা বনলেও আনন্দ পায় খুব। তারা তিনজনে একবার এক দোকানদারকে আচ্ছা বোকা বানিয়েছিলো। একটা গায়ে মাখার সাবান উৎপাদক কোম্পানি একবার ঘোষণা দিলো, কেউ তাদের সাবানের দশটা খালি খোসা বা প্যাকেট দিতে পারলে একটা সাবান ফ্রি। তিনবন্ধু যার যার বাসা থেকে তিনটা করে মোট নয়টা সাবানের খালি বাক্স নিয়ে এলো। তারপর দোকানদারের কাছে গিয়ে ঐ স্পেশাল অফারের সাবান চাইলো একটা। দোকানদার মোড়কসহ নতুন একটা সাবান দিলো ঐ কোম্পানীর। তিনবন্ধু সাবানের মোড়কটা খুলে তার সাথে নিজেদের নয়টা যোগ করে দোকানীকে দিয়ে বললো, এই নিন, আপনার দশটা খালি মোড়ক। এই বলে তিনবন্ধু দোকানদারের কাছ থেকে পয়সা ছাড়া বুদ্ধি খাটিয়ে একটা মোড়কহীন উদোম সাবান নিয়ে এলো। দোকানদার তিনবন্ধুর চাতুর্য দেখে ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে রইলো। মনে হয় জীবনে এর চেয়ে বেশি বোকা সে আর হয়নি।

এই তিন বন্ধু একদিন নিজেদের মধ্যে একটা প্রতিযোগিতা শুরু করল। তিনজনে তিনটা আষাঢ়ে গল্প বলবে। তিনজনের রায়ে যার গল্পটা সেরা হবে তাকে অন্য দুইবন্ধু ভালো ট্রিট দিবে। ট্রিট মানে হলো স্কুলের ক্যান্টিনের চা-পরোটা। তাদের স্কুলের ক্যান্টিনের চা-পরোটা অমৃতময়। যে খায়নি সে পস্তায়। যে খেয়েছে সে সারাদিন খেতে চায়। শুরু হলো তাদের আষাঢ়ে গল্পের আসর। রবি বলতে শুরু করে তার গল্প। রবির গল্পের বিষয় ছিলো এমন; তারা একদিন নৌভ্রমণে গিয়েছিলো। মাঝপথে যেতে যেতে উঠলো তুমুল ঝড়। মাঝি ঝড়ের সাথে পাল্লা দিয়ে পারছে না। একসময় তাদের নৌকা গেল ডুবে। কারো কোন নিশানা নেই। চারদিকে কালো মেঘ। অনেকক্ষণ পর তারা তিনবন্ধু সাঁতরে কূলে এলো। কিন্তু কূলে উঠার পর দেখলো তাদের কারো জামা-কাপড়ই ভিজেনি। কেন ভিজলো না এ প্রশ্ন অন্য দু'বন্ধু জিজ্ঞেস করলো রবিকে। রবি হেসে হেসে বললো, আরে দোস্ত! আমিতো নৌকাডুবির স্বপ্ন দেখেছিলাম মাত্র ! রবির উত্তর শুনে দুখু আর জীবন খল খল করে হেসে দিলো।

এবার দুখুর আষাঢ়ে গল্প। দুখু খক খক করে কেশে গলাটা পরিষ্কার করে নিলো। তারপর বলতে শুরু করে। শোন বন্ধুরা। আমার নানীদের বাড়িতে একটা আজব পুকুর আছে। প্রতি অমাবস্যায় সেই পুকুরে পিতল আর তামার তৈরি থালা-বাটি ভেসে ওঠে। আজ থেকে একশ বছর আগে আমার নানীর বংশের একজন পূর্ব পুরুষ গভীর রাতে শোনেন, তারে যেন কে ডাকছে। আয় আয়। আয় আয়। তার নাম ধরে ডাকার কারণে তিনি প্রথমে ভয় পেয়ে গেলেন। তাকে ভয় পেতে দেখে অদৃশ্য কণ্ঠস্বর বলে উঠলো, তুই ডরাইস না। তোরে আমি পিতলের থালাবাটি দিমু। তুই আয়। তুই পুকুর ঘাটে আয়। নানীর সেই পূর্ব পুরুষ শেষমেষ ডাকের প্রলোভনে সাড়া দিয়ে পুকুর ঘাটে গিয়ে দেখে কেউ কোথাও নেই। কিন্তু ঘাটের কিনারে দেখেন, ঠিক ঠিক অনেক পিতলের থালাবাটি ভাসছে। তিনি থালাবাটি নিতে নিতে অতিরিক্ত লোভগ্রস্ত হয়ে পুকুরের পানিতে নেমে পড়লেন। পিতলের থালাবাটি কুড়োতে কুড়োতে লোকটি যে কখন মাঝ পুকুরে চলে গেলেন টের পেলেন না। এক সময় পানির ভিতর তলিয়ে গেলেন। পিতলের থালাবাটি সব তার মাথার উপর চেপে বসে তাকে আর পানি থেকে উঠতে দেয়নি। পুকুরের জলে তার সলিল সমাধি হয়ে গেল। পরদিন সকালে লাশ ভেসে ওঠে। লাশের চারপাশে পিতলের থালাবাটি ভাসছে। সেই থেকে আজও প্রতি অমাবস্যার গভীর রাতে কেউ কেউ ডাক শোনে, তুই আয় তুই আয়। তুই পুকুর ঘাটে আয়। তোরে আমি পিতলের থালাবাটি দিমু। তুই আয়, তুই পুকুর ঘাটে আয়। রাতের ঘুমে আজও নানীর বাড়িতে অনেকেই পিতলের থালাবাটির ধাতব আওয়াজ শুনতে পায় কানে। দুখুর গল্পে এতোক্ষণ তন্ময় হয়েছিলো অন্য দুইবন্ধু। গল্প শেষ হওয়ার পর তাদের গায়ে রোমে শিহরণ খেলে গেল।

সবশেষে এবার জীবনের আষাঢ়ে গল্প। জীবন বলতে শুরু করে গল্প। তোরা কেউ তো কখনো লাশকাটা ঘর দেখিসনি। আমি দেখেছিলাম। আমার পিসির শ্বশুরবাড়িতে একজন ডোম আছে। তার নাম হলো বিশু ডোম। ডোম হলো তারা যারা মরা মানুষ পোড়ায় কিংবা অপমৃত্যুর লাশগুলো কাটে। পিসির শ্বশুরবাড়িতে একবার ডাকাত পড়লো। ডাকাতেরা অস্ত্রেশস্ত্রে খুব ভারী। তারা সিন্দুকের চাবি চাইলো পিসির শ্বশুরের কাছে। কিন্তু পিসির শ্বশুর চাবি দিতে গড়িমসি করছিলেন। কারণ সিন্দুকে পরিবারের সকল বৌ-ঝিয়ের গয়না জমা আছে। আর আছে ব্যবসার সব নগদ টাকা। একবার যদি ডাকাতেরা সিন্দুক খুলতে পারে আর সব নিয়ে যায় তবে পিসির শ্বশুরকে পথে বসতে হবে। পিসির শ্বশুরকে চাবি দিতে দেরি হচ্ছে দেখে ডাকাতদের সর্দার গেলো ক্ষেপে।

সে তার হাতে ধরে থাকা তলোয়ার দিয়ে দিলো এক ঘা। পিসির শ্বশুরের দেহ থেকে মুণ্ডু আলাদা হয়ে গেল। গল গল করে প্রবাহিত রক্তে সারা বাড়ি ভিজে গেল। ডাকাতেরা বোঁচকা বেঁধে সব টাকা পয়সা নিয়ে গেল। যাওয়ার সময় তারা পিসির শ্বশুরের মুন্ডুটা কাপড়ে বেঁধে নিয়ে গেলো। পরদিন খবর পেয়ে পুলিশ এলো। পুলিশ সবাইকে জেরা শুরু করল। তারপর আলামত সংগ্রহ করে মুণ্ডুকাটা দেহ নিয়ে ফরেনসিক রিপোর্টের জন্যে মর্গে নিয়ে গেল।জীবন তার বাবার সাথে মর্গ থেকে লাশ আনতে গিয়েছিল। সেখানে সে দেখল, অনেক পঁচা লাশ পরীক্ষার জন্যে পড়ে আছে যাদের দেহ থেকে নাড়ি উল্টানো গন্ধ বেরুচ্ছে। বিশু ডোম পিসিদের গ্রামের লোক বলে পিসির শ্বশুরের মুণ্ডুকাটা লাশটি খুব তাড়াতাড়ি ব্যবচ্ছেদ করে পরীক্ষা সম্পন্ন হলো। তারপর মুণ্ডুকাটা লাশ নিয়ে পুলিশের ছাড়পত্রসহ গ্রামে এনে তাকে দাহ করা হল। কিন্তু দাহ করলে কী হবে, সেদিন রাত্রি থেকেই পিসির শ্বশুরের উৎপাত শুরু হলো। গ্রামের মানুষ যখন তখন রাত-বিরাতে মুণ্ডুকাটা দেহকে ঘোরাঘুরি করতে দেখে। মাঝে মাঝে নাকি সুরে কথা শোনা যায়, ওঁরে বিঁশু, আঁমার মুঁণ্ডুটা লাঁগিয়েঁ দেঁ বাঁপ। আঁমার মুঁণ্ডুটা লাঁগিয়েঁ দেঁ বাঁপ।

গল্পের এ পর্যায়ে এসে বিদ্যুৎ গেল চলে। ইদানিং বিদ্যুৎ আর যায় না খুব একটা। কিন্তু আজ হঠাৎ বিদ্যুৎ যেতে দেখে সবার গা ছমছম করে উঠলো। ঘরে একটা মোম ছিলো অনেক পুরানো। মোমটা আধেক জ্বালানো। মনে হয় কেউ মোম জ্বালিয়ে পটকা ফাটিয়েছিল কখনো। জীবন মোমটা খুঁজে নিলো হাতে। রবির জানা ছিলো ঘরে ম্যাচ কোথায় থাকে। সে হাতড়াতে হাতড়াতে ম্যাচ বের করল। দুখু খুঁজে পেতে অন্ধকারে বাতিদানটা বের করলো। জীবন বাতিটা জ্বালিয়ে বাতিদানে রাখলো। আধা আলোয় পরিষ্কার শুনতে পেলো তারা তিনজনেই, বিঁশুঁ, আঁমার মুঁণ্ডুটা লাঁগিয়েঁ দেঁ বাঁপ। আঁমার মুঁণ্ডুটা লাঁগিয়েঁ দেঁ বাঁপ। তারা তাদের কানকে বিশ্বাস করতে পারছে না। মনে হলো ভুল শুনছে। একে অন্যের দিকে চাইতেই দেখলো দরজার কাছে মুণ্ডুহীন একটা দেহ দাঁঁড়িয়ে আছে। মুখ নেই তবু কথা বলছে, আঁমার মুঁণ্ডুটা লাঁগিয়েঁ দেঁ বাঁপ। আঁমার মুঁণ্ডুটা লাঁগিয়ে দেঁ বাঁপ। মুণ্ডুহীন দেহটা দেখেই রবি,দুখু আর জীবনের চেতনা গেলো লোপ হয়ে। তাদের মুখ দিয়ে গড়িয়ে পড়ছে লালা। তারা গোঙাচ্ছে। মোমের আবছা আলোয় মনে হচ্ছে ঘরটাতে প্যান্টোমাইমের অভিনয় চলছে। ঘরজুড়ে থেকে থেকে নাকি সুরের কথা ঘুরছে, বিঁশু, আঁমার মুঁণ্ডুটা লাঁগিয়েঁ দেঁ বাঁপ। আঁমার মুঁণ্ডুটা লাঁগিয়েঁ দেঁ বাঁপ।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়