প্রকাশ : ১৭ মে ২০২৫, ০৯:৩০
সাক্ষাৎকার : মাইনুল ইসলাম মানিক
কবিতা আমাদের অনুভবের উন্মোচন

কবি ও অনুবাদক মাইনুল ইসলাম মানিকের জন্ম ১৯৮৪ সালে, চাঁদপুরে। ইংরেজি সাহিত্যে স্নাতক (সম্মান) ও স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করে বর্তমানে সহকারী অধ্যাপক (ইংরেজি) পদে কর্মরত আছেন। পাঞ্জেরী পাবলিকেশন্স, মাওলা ব্রাদার্স, চৈতন্যসহ দেশের খ্যাতনামা প্রতিষ্ঠান থেকে এ পর্যন্ত নয়টি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। এছাড়া ইউনিসেফের অর্থায়নে দুটি প্রকল্পে রুম টু রিড থেকে চল্লিশটি শিশুতোষ গ্রন্থ ইংরেজিতে ভাষান্তর ও সম্পাদনা করেছেন। তিনি রাজা রামমোহন রায়ের জন্ম দ্বিসার্ধশতবর্ষে ত্রিপুরায় বাংলা সংস্কৃতি বলয়ের সম্মেলনে স্মারক প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন। এছাড়া ২০১৯ সালে দিল্লিতে অনুষ্ঠিত সার্ক সাহিত্য উৎসবে যোগদান করেছেন। সাহিত্য সংগঠন সাহিত্য মঞ্চ, চাঁদপুর-এর প্রতিষ্ঠাকালীন সভাপতি। লেখালেখির স্বীকৃতিস্বরূপ নতুন কুঁড়ি লেখক সম্মাননা, দেশ পাণ্ডুলিপি পুরস্কার, ইলিশ উৎসব লেখক সম্মাননা, মাহমুদুল বাসার সাহিত্য সম্মাননাসহ অসংখ্য পুরস্কার ও সম্মাননা পেয়েছেন।
তার সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মুহাম্মদ ফরিদ হাসান।
আপনার ভেতরে কবিতা কীভাবে আসে? শব্দ কি আগে আসে, না অনুভব?
মাইনুল ইসলাম মানিক : কবিতা মূলত আমাদের অনুভবের উন্মোচন, অনুভব দ্বারা তাড়িত হয়েই আমি লিখতে বসি, অনুভূতিকে শব্দচিত্রে আঁকতে গিয়েই উপলব্ধ হয় নন্দন, এবং বোধের নান্দনিক উপস্থাপনের প্রয়োজনেই শব্দের অবতারণা হয়। সুতরাং বোধের পিছু পিছু শব্দরা আমার কাছে শিকারি বেড়ালের মতো ছুটে আসে। আমার ক্ষেত্রে, বোধ বা অনুভব যদি রাজকুমারী হন, তবে শব্দ হচ্ছে তার রাজকীয় অলংকরণ।
আপনি যখন লেখেন, তখন লেখার মাধ্যমে আপনি কি নিজেকেই প্রকাশ করেন?
মাইনুল ইসলাম মানিক : আমার লেখার জগতে আমি একটি চরিত্রমাত্র। চারপাশের এরকম অসংখ্য চরিত্র নিয়েই আমার লেখার জগত। যে চরিত্র নিয়েই লিখি না কেন, সে চরিত্রের ভেতর নিজেকে প্রোথিত করতে হয়, সে চরিত্রের ভেতর দিয়ে নিজের উপলব্ধিকে প্রকাশ করতে হয়, এবং নিজেকে সে চরিত্র হয়ে ওঠতে হয়। মূলত আমার প্রতিটি চরিত্রই আমার ভাবনাকে প্রতিফলিত করে।
আপনার প্রথম বইটি কবে হলো? বই প্রকাশের অনুভূতি কেমন?
মাইনুল ইসলাম মানিক : প্রথম বইটি ২০১৪ সালে প্রকাশিত হয়। এটি ছিল একটি কাব্যগ্রন্থ। আমি তখন একফালি শাদামেঘ থেকে ছিটকে গিয়ে বেদনার পাথারে ভাসতে থাকা এক দিকভ্রান্ত পথিক। ডুবতে ডুবতে আমার তীরে ফেরার আকুতি ছিল প্রবল। শেষে শব্দের পাখিরা ঝাঁক বেঁধে আসে, তারা আমাকে নিয়ে আসে আমার আরাধ্য এক দ্বীপে। আমি কোলাহলের ভেতর একা ও একান্তে বাঁচতে শিখি, শব্দের ভেতর ডুবে যেতে শিখি।
বইটি যেদিন হাতে এলো, আমার নিজেকে এক চিরদুঃখী সাইলাস মনে হলো, যে নিজের বিশ বছরের জমানো সম্পদ হারিয়ে ফেলেছে, অতঃপর সে সম্পদ খুঁজতে গিয়ে শুভ্রবরফের ওপর শুয়ে থাকা স্নো-হোয়াইট শিশু এপিকে পেয়ে যায়, এই এপিকে নিজের সন্তানের মতো লালন করে সে সমস্ত জীবনের সবটুকু দুঃখ ভুলে যেতে চায়। আমি আমার জীবনের দুঃখটুকু হয়তো ভুলতে পারিনি, কিন্তু এই বইটি প্রকাশের পর মনে হয়েছিল আমিও এক স্নো-হোয়াইট শিশুকে পেয়ে গেছি, যে আমার অবশিষ্ট জীবনে কোনোদিন ছেড়ে যাবে না। মূলত এই বইটির মধ্য দিয়েই আমি আমার যাবতীয় বেদনাবোধের সাথে একই অন্দরে বসবাস করতে শিখে গেছি।
অন্বুাদ জগতে কীভাবে পদার্পণ করলেন?
মাইনুল ইসলাম মানিক : আমি ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্র। ছাত্রজীবনে বিভিন্ন বইয়ের সুন্দর বাক্যগুলো নিজের মতো করে বাংলায়ণ করে প্রেয়সীকে লিখে পাঠাতাম। এটাকে বলতে পারেন আমার অনানুষ্ঠানিক অনুবাদের পথযাত্রা। আনুষ্ঠানিকভাবে প্রথম অনুবাদ করি ২০১৪ সালে। আশিক বিন রহিম সম্পাদিত তরী নামের একটি কবিতার ছোটকাগজে। কবি ওমর আলীর একটি কবিতাকে ইংরেজিতে অনুবাদ করেছিলাম। এই অনুবাদটি কবি মুহাম্মদ ফরিদ হাসানের উৎসাহেই করেছিলাম। তারপর কবি আলী আহমাদ আদোনিস, কোন উনসহ বেশকিছু কবির কবিতা বাংলায় অনুবাদ করি এবং বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় ও লিটলম্যাগে সেগুলো প্রকাশিত হয়। ২০১৬ সালের দিকে একদিন কবি, প্রাবন্ধিক ও অনুবাদক মাসুদুজ্জামান আমার সাথে যোগাযোগ করেন এবং অনুবাদের প্রশংসা করেন। তিনি তীরন্দাজে আমার অনুবাদ প্রকাশের আগ্রহ পোষণ করেন। এরপর বছরখানেকের মধ্যে তীরন্দাজে সিরিজ আকারে ডেরেক ওয়ালকট, হেমিংওয়ে, গুন্টার গ্রাস, ওরহান পামুকসহ অনেকের সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হয়। ২০১৭ সালে একদিন মাসুদুজ্জামান স্যার একটি সাক্ষাৎকার বিষয়ক বই প্রকাশের ব্যাপারে প্রস্তাব করেন। আমি সানন্দে সাড়া দিই। তার আন্তরিক প্রচেষ্টায় ২০১৮ সালের বইমেলায় পাঞ্জেরী থেকে আমার দশ নোবেলজয়ী লেখকের সাক্ষাৎকার এবং ২০১৯ সালে মাওলা ব্রাদার্স থেকে মধ্যপ্রাচ্যের সমকালীন গল্প প্রকাশিত হয়। এরপর বলতে গেলে পুরোদমেই নিজেকে অনুবাদে সমর্পণ করি।
এ পর্যন্ত কী কী বিষয়/লেখকের লেখা অনুবাদ করেছেন?
মাইনুল ইসলাম মানিক : এ পর্যন্ত অনুবাদ নিয়ে অনেকগুলো কাজই করেছি। ইউনিসেফের অর্থায়নে দুটি প্রকল্পে রুম টু রিড থেকে চল্লিশটি বই ইংরেজিতে ট্রান্সলেশন ও সম্পাদনা করেছি। এছাড়া আমার অনুবাদে বাংলা একাডেমীর প্রকাশনাসহ বিভিন্ন প্রকাশনায় অর্ধশতক সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হয়েছে। পাঞ্জেরী পাবলিকেশন্স থেকে জাকারিয়া তামেরের নির্বাচিত গল্প, জেন অস্টেনের এমাসহ বেশকয়েকটি অনুবাদগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে।
একজন অনুবাদক হিসেবে আপনি যখন অন্যের লেখা অনুবাদ করেন, তখন নিজের স্বাতন্ত্র্যের ছাপ কিভাবে রাখেন?
মাইনুল ইসলাম মানিক : অনুবাদের ক্ষেত্রে আমি প্রথমেই লেখকের বোধটুকু উপলব্ধির চেষ্টা করি, তার শৈলীটুকু অনুভবের চেষ্টা করি, এবং তার ভাবনার ভেতর নিজেকে প্রোথিত করার মধ্য দিয়ে তার স্থানে নিজেকে দাঁড় করাই। যে ভাষাটিতে অনুবাদ করছি, সে ভাষার সবচেয়ে উপযোগী শব্দগুচ্ছকে বাছাইয়ের চেষ্টা করি, এবং প্রতিটি বাক্যের কাজ সম্পন্ন হলেই আবার নতুন করে পড়ি এবং চেতনার অন্তঃশীল প্রবাহকে ঠিক রাখার চেষ্টা করি। আমি চেষ্টা করি, যতোটা সম্ভব মূলের কাছাকাছি রেখে অনূদিত ভাষার পাঠকের জন্যে পরিচিত আবহ তৈরি করা যায়। এক্ষেত্রে আমার শব্দ ও শৈলীর ব্যবহারে একটা স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখার চেষ্টা করি।
আপনি কি মনে করেন, সাহিত্য দিয়ে সমাজে কিছু বদলানো সম্ভব?
মাইনুল ইসলাম মানিক : ভলতেয়ারকে পতিতালয়ে সমাধিস্থ করা হয়েছিল। কিন্তু কেন? কারণ তার রচনায় বিপ্লবের স্ফূরণ ছিল। একটি সমাজের রুচিবোধ, চিন্তা ও মননশীলতা তৈরিতে সাহিত্যেরঙ ভূমিকা অগ্রগণ্য যদিও সমাজকে, সমাজের রুচিবোধকে বদলে দেওয়া লেখকের কাজ নয়। কোনো মরাল রোল প্লে করাও তার কাজ নয়। বরং তার লেখার মধ্য দিয়ে সমাজ পরিবর্তনের আবহ ও উপলক্ষ তৈরি হয়। কোকিল তার কথা বলে যায়, মানুষের কাছে তা গান হয়ে ওঠে।
লেখক জীবনে আপনার প্রাপ্তি/অর্জন সম্পর্কে জানতে চাই।
মাইনুল ইসলাম মানিক : লেখালেখির কারণে চারপাশের মানুষেরা আমাকে ভালোবাসেন, এটা আমার একটা বড় প্রাপ্তি বলতে পারেন। আক্ষরিক অর্থে বলতে গেলে, দিল্লিতে সার্ক ফেস্টিভ্যাল যোগদান করেছি, ত্রিপুরায় রাজা রামমোহন রায়ের জন্ম দ্বিসার্ধশতবর্ষে স্মারক প্রবন্ধ উপস্থাপন করেছি, অনেকগুলো পুরস্কার ও সম্মাননা পেয়েছি।
বর্তমানে কী নিয়ে লিখছেন?
মাইনুল ইসলাম মানিক : ফিলিস্তিনি লেখক অ্যাডওয়ার্ড সাঈদের রিফ্লেকশন অন এক্সাইল নিয়ে কাজ করছি। একটি কিশোর ক্লাসিক নিয়েও কাজের প্রস্তাব হাতে রয়েছে। পাশাপাশি কবিতাও লিখছি। বছর শেষে যে কোনো একটি পাণ্ডুলিপি প্রকাশকের হাতে তুলে দেবো ভাবছি।
ভবিষ্যতে লেখালেখি নিয়ে কী পরিকল্পনা রয়েছে?
মাইনুল ইসলাম মানিক : লেখালেখি নিয়ে তেমন কোনো পরিকল্পনা নেই। কিছু ভালো কবিতা লিখতে চাই। ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট নিয়ে একটি উপন্যাস লিখেছি। এ জনরার উপন্যাসের প্রতি আগ্রহ আছে। সম্ভব হলে আরও দুয়েকটি লিখবো। কিছু ভালো সাহিত্যকর্মের অনুবাদ করবো। সাহিত্য রক্তের সাথে মিশে গেছে। এটিই এখন অনিবার্য নিয়তি। তাই সাহিত্যের সাথে পরিকল্পনাহীন একটি জীবন অনায়াসে কাটিয়ে দিতে চাই।