প্রকাশ : ১৬ মে ২০২৫, ২১:০৯
বোতলকাণ্ডের হুসাইন এখন তথ্য উপদেষ্টার গৃহে

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্দোলনে নতুন মোড়: উপদেষ্টার বাসায় হুসাইনের উপস্থিতি
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের (জবি) শিক্ষার্থীদের চলমান আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দুতে উঠে আসা সেই ছাত্র মোহাম্মদ হুসাইন, যিনি সম্প্রতি এক বিক্ষোভে পানি ভর্তি বোতল ছুড়ে আলোচনায় এসেছিলেন, এবার তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মো. মাহফুজ আলমের আমন্ত্রণে তার বাসভবনে যান। শুক্রবার (১৬ মে) সন্ধ্যায় উপদেষ্টা তার ব্যক্তিগত ফেসবুক পেজে হুসাইন ও তার মায়ের সঙ্গে একটি ছবি পোস্ট করে এই অপ্রত্যাশিত সাক্ষাতের কথা জানান।
মাহফুজ আলম তার পোস্টে উল্লেখ করেন, “আজ মোহাম্মদ হুসাইন ও তাঁর মা আমার বাসায় এসেছিলেন। আমরা আন্তরিক পরিবেশে কথা বলেছি। শিক্ষা উপদেষ্টা আমাকে নিশ্চিত করেছেন যে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের চলমান সংকটের দ্রুত সমাধানে আর মাত্র কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই একটি সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ ঘোষণা করা হবে। জবির শিক্ষার্থীদের দীর্ঘদিনের আবাসন সমস্যার সমাধান আমাদের প্রধান অগ্রাধিকার।”
ঘটনার নেপথ্যে: কাকরাইলের সেই রাত
উল্লেখ্য, গত বুধবার (১৪ মে) রাতে কাকরাইল মসজিদের সামনে অবস্থানরত জবি শিক্ষার্থীদের সঙ্গে মতবিনিময় করতে গিয়েছিলেন উপদেষ্টা মাহফুজ আলম। শিক্ষার্থীদের তীব্র ক্ষোভের মুখে পড়ে তিনি বেশ কিছু কঠিন প্রশ্নের সম্মুখীন হন। সেই উত্তপ্ত পরিস্থিতিতেই হঠাৎ করে ভিড়ের মধ্য থেকে এক যুবক উপদেষ্টার দিকে একটি প্লাস্টিকের পানির বোতল ছুড়ে মারেন। এই ঘটনাটি তাৎক্ষণিকভাবে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপক আলোচনার জন্ম দেয়।
ভাইরাল হওয়া ভিডিও ফুটেজে দেখা যায়, বোতল নিক্ষেপকারী যুবকটির মাথায় একটি কালো টুপি ছিল এবং তার আশেপাশে বেশ কয়েকজন পুলিশ সদস্য উপস্থিত ছিলেন। ঘটনার পরপরই পুলিশ সদস্যদের তাকে কিছু জিজ্ঞাসাবাদ করতেও দেখা যায়।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, এই ঘটনাটি কেবল একজন ক্ষুব্ধ ছাত্রের স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিক্রিয়া ছিল না, বরং এটি সরকারের উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে সাধারণ শিক্ষার্থীদের মধ্যে ক্রমবর্ধমান দূরত্ব এবং আস্থার অভাবেরই বহিঃপ্রকাশ।
কে এই মোহাম্মদ হুসাইন?
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক নির্ভরযোগ্য সূত্র নিশ্চিত করেছে যে মোহাম্মদ হুসাইন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের একজন মেধাবী ছাত্র। তার বাবা একজন দিনমজুর এবং মা গৃহিণী। দারিদ্র্য তার ছোটবেলা থেকেই নিত্যসঙ্গী হলেও, তিনি বরাবরই অত্যন্ত মেধাবী হিসেবে পরিচিত।
হুসাইনের একজন সহপাঠী বলেন, “হুসাইন আসলে কারও উপর ব্যক্তিগত বিদ্বেষ থেকে আক্রমণ করতে চায়নি। সে মূলত তার এবং অন্যান্য সাধারণ শিক্ষার্থীদের পুঞ্জীভূত ক্ষোভের একটি প্রতীকী বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছে ওই পানির বোতল নিক্ষেপের মাধ্যমে।”
নতুন বাঁক: উপদেষ্টার বাসায় আমন্ত্রণ ও সমঝোতার ইঙ্গিত
শুক্রবার সন্ধ্যায় তথ্য উপদেষ্টা মাহফুজ আলম কর্তৃক মোহাম্মদ হুসাইনকে তার বাসভবনে আমন্ত্রণ জানানো এবং তাদের একসঙ্গে ছবি সামাজিক মাধ্যমে পোস্ট করার ঘটনাটি মিশ্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছে। কেউ এটিকে সরকারের ইতিবাচক পদক্ষেপ হিসেবে দেখছেন, আবার কারও মতে এটি চলমান আন্দোলনকে প্রশমিত করার একটি কৌশলমাত্র।
সাবেক ছাত্রনেতা এবং রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড. তাজউদ্দীন আহমেদ এই প্রসঙ্গে বলেন, “যখন কোনো আন্দোলন একটি গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়ে উপনীত হয়, তখন সরকার সাধারণত কিছু পরিচিত মুখকে বিশেষভাবে আমন্ত্রণ জানিয়ে সাধারণ শিক্ষার্থীদের মধ্যে একটি শান্ত ভাব ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করে। তবে এটিকে দীর্ঘমেয়াদি কোনো সমাধান না বলে একটি সাময়িক কৌশল হিসেবেই বিবেচনা করা যায়।”
শিক্ষা উপদেষ্টার আশ্বাস: দ্রুত আসছে রোডম্যাপ
তথ্য উপদেষ্টা মাহফুজ আলমের ভাষ্য অনুযায়ী, শিক্ষা উপদেষ্টা (সম্ভবত ড. কৌশিক আহমেদ) জবির চলমান সংকটের আশু সমাধানে একটি "স্পষ্ট এবং সময়সীমাসিদ্ধ রোডম্যাপ" ঘোষণার বিষয়ে নিশ্চিত করেছেন। যদিও এই রোডম্যাপের কোনো লিখিত খসড়া বা সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা এখনও পর্যন্ত গণমাধ্যমে প্রকাশ করা হয়নি।
বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের একজন প্রভাবশালী নেতা বলেন, “আমরা শুধু মৌখিক আশ্বাসে আর বিশ্বাস রাখতে পারছি না। আমরা একটি সুস্পষ্ট লিখিত রোডম্যাপ দেখতে চাই। সেই রোডম্যাপে স্পষ্টভাবে উল্লেখ থাকতে হবে কবে নাগাদ আমাদের আবাসন সমস্যার সমাধান হবে এবং কবে আমরা হলে উঠতে পারব—আমাদের এই নির্দিষ্ট তারিখ জানতে হবে।”
আন্দোলনের প্রেক্ষাপট: প্রকট আবাসন সংকট ও প্রশাসনের নীরবতা
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রায় বাইশ হাজার শিক্ষার্থী অধ্যয়নরত থাকলেও, তাদের আবাসনের জন্য পর্যাপ্ত হল নেই বললেই চলে। বর্তমানে মাত্র দুটি ছোট আকারের হল রয়েছে, যা মোট শিক্ষার্থীর তুলনায় একেবারেই অপ্রতুল। এর ফলে বিপুল সংখ্যক শিক্ষার্থী রাজধানীর পুরান ঢাকা, গেণ্ডারিয়া, সূত্রাপুর ও ওয়ারীর বিভিন্ন মেসে অত্যন্ত চড়া ভাড়ায় বসবাস করতে বাধ্য হচ্ছে।
একজন অসহায় শিক্ষার্থী ক্ষোভের সঙ্গে বলেন, “জগন্নাথের মতো একটি স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠানে চার বছর ধরে পড়াশোনা করেও আমরা সত্যিকারের ‘ক্যাম্পাস লাইফ’ থেকে বঞ্চিত। অথচ অন্যান্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে হলে থাকা মানেই সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র জীবনের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ।”
আন্দোলনের ভবিষ্যৎ: সাময়িক বিরতি, নাকি স্থায়ী সমাধানের পথে?
তথ্য উপদেষ্টা মাহফুজ আলমের সঙ্গে মোহাম্মদ হুসাইনের সাক্ষাৎ এবং শিক্ষা উপদেষ্টার আসন্ন রোডম্যাপ ঘোষণার খবরে অনেকেই মনে করছেন যে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন হয়তো আপাতত স্থগিত করা হতে পারে। তবে আন্দোলনকারী নেতারা স্পষ্ট ভাষায় জানিয়েছেন যে তাদের দাবি পূরণ এবং প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়ন না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন অব্যাহত থাকবে।
আন্দোলনকারী একজন নারী নেত্রী দৃঢ় কণ্ঠে বলেন, “আমাদের কয়েকজন সহযোদ্ধাকে পুলিশ গ্রেফতার করেনি, এটা অবশ্যই ভালো খবর। তবে আমাদের মূল প্রশ্ন এখনও অমীমাংসিত—আগামী বর্ষায় আমরা কোথায় থাকব? আবারও কি আমাদের মেস মালিকদের করুণার পাত্র হতে হবে?”
ডিসিকে/এমজেডএইচ