বুধবার, ১০ ডিসেম্বর, ২০২৫
জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয় অন্যান্য

প্রকাশ : ১০ ডিসেম্বর ২০২৫, ০৮:৪২

আমাদের দৈনন্দিন প্রয়োজন ও দু কোটি প্রবীণের অধিকার

হাসান আলী
আমাদের দৈনন্দিন প্রয়োজন ও দু কোটি প্রবীণের অধিকার

১০ ডিসেম্বর আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবস। ২০২৫ সালের প্রতিপাদ্য ‘ঊাবৎুফধু ঊংংবহঃরধষং’ — আমাদের দৈনন্দিন প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র। শুনতে সহজ, কিন্তু এর ভেতরে লুকিয়ে আছে মানুষের বেঁচে থাকার মৌলিক অধিকারগুলোর কথা--খাদ্য, বাসস্থান, চিকিৎসা, নিরাপত্তা, সম্মান ও ভালোবাসা। এই প্রতিপাদ্য আমাদের সবচেয়ে বেশি মনে করিয়ে দেয়, যারা আমাদের সমাজের নীরব অথচ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ, সেই প্রবীণ মানুষদের কথা।

বাংলাদেশে বর্তমানে প্রায় দু কোটি প্রবীণ মানুষ বসবাস করছেন। এই সংখ্যাটা কেবল একটি পরিসংখ্যান নয়, এটি দু কোটি জীবনের গল্প, দু কোটি স্মৃতি, ত্যাগ, শ্রম আর অভিজ্ঞতার ইতিহাস। অথচ দুঃখজনক হলেও সত্য হলো, এই দু কোটি প্রবীণের একটি বড়ো অংশ আজ মৌলিক মানবাধিকার থেকে বঞ্চিত। ‘ঙঁৎ ঊাবৎুফধু ঊংংবহঃরধষং’ বলতেই আমরা প্রথমেই বুঝি—ভাত, কাপড়, বাসস্থান আর চিকিৎসার কথা। কিন্তু বাস্তবে কতজন প্রবীণ নিয়মিত পুষ্টিকর খাবার পান? কতজন প্রবীণ নিয়মিত চিকিৎসাসেবা পান? অনেক বৃদ্ধ বাবা-মা শেষ বয়সে দাঁড়িয়ে থাকেন হাসপাতালের বারান্দায়, সন্তানদের অবহেলায়, অর্থের অভাবে কিংবা সিদ্ধান্তহীনতার কারণে চিকিৎসা পান না। এ কি মানবাধিকার নয়?

প্রবীণের অধিকার শুধু খাদ্য বা চিকিৎসা নয়, সম্মানও একটি মৌলিক অধিকার। কিন্তু আজ অনেক ঘরে প্রবীণরা হয়ে উঠছেন ‘বোঝা’। সিদ্ধান্ত গ্রহণে তাঁদের মতামত অপ্রয়োজনীয় মনে করা হয়। ছোট ছোট বিষয়ে তাঁদের কথা উপেক্ষিত থাকে। অথচ এক সময় তাঁরাই ছিলেন সংসারের কর্তা, সমাজের পথপ্রদর্শক।

‘ঙঁৎ ঊাবৎুফধু ঊংংবহঃরধষং’-এর মধ্যে আরও আছে—নিরাপত্তা ও মানসিক শান্তি। কিন্তু কত প্রবীণ আজ ভয়ে ভয়ে বেঁচে থাকেন—এই বুঝি বাড়ি থেকে বের করে দেয়া হলো, এই বুঝি জমিজমা হাতছাড়া হয়ে গেলো, এই বুঝি সন্তান মুখ ফিরিয়ে নিলো! এই ভয়, এই অনিশ্চয়তা কোনো মানুষের জীবনের শেষ অধ্যায়ের জন্যে কখনোই কাম্য হতে পারে না।

গ্রামে বা শহরে দুই জায়গাতেই চিত্র খুব একটা আলাদা নয়। কোথাও প্রবীণ মা দিনভর একাকীত্বে কাঁদেন, কোথাও বৃদ্ধ বাবার চিকিৎসার টাকাকে কেন্দ্র করে ভাই-বোনের মধ্যে ঝগড়া বিবাদ, মামলা-মোকদ্দমা চলে। অথচ এসব মানুষই একদিন পরিবার আর সমাজের জন্যে নিঃস্বার্থভাবে কাজ করে গেছেন।

মানবাধিকার দিবস আমাদের মনে করিয়ে দেয়—মানবাধিকার মানে শুধু আন্তর্জাতিক চুক্তি নয়, এটি ঘরের ভেতরের আচরণও। প্রবীণকে সময় দেয়া, তাঁর কথা মন দিয়ে শোনা, অসুস্থ হলে পাশে দাঁড়ানো—এসবই মানবাধিকারের বাস্তব রূপ। রাষ্ট্রের দায়ও এখানে শেষ নয়। প্রবীণ ভাতা, বিনামূল্যে বা স্বল্পমূল্যে চিকিৎসাসেবা, নিরাপদ আশ্রয়, মানসিক স্বাস্থ্যসেবা—এসব নিশ্চিত করাই রাষ্ট্রের দায়িত্ব। কিন্তু বাস্তবতায় অনেক প্রবীণ এসব সুযোগের কথা জানেন না, আবার অনেকেই পেতে গিয়েও নানা হয়রানির শিকার হন।

‘ঙঁৎ ঊাবৎুফধু ঊংংবহঃরধষং’ আমাদের শেখায়—যেভাবে আমরা নিজেদের দৈনন্দিন প্রয়োজন ছাড়া এক মুহূর্ত চলতে পারি না, ঠিক তেমনি প্রবীণদের দৈনন্দিন চাহিদা উপেক্ষা করে কোনো সভ্য সমাজ টিকে থাকতে পারে না। প্রবীণরা কেবল অতীতের মানুষ নন, তাঁরা আমাদের বর্তমানেরও ভরসা।

আজকের মানবাধিকার দিবসে আসুন, আমরা শপথ নিই—

আমরা আমাদের বাবা-মাকে ‘বোঝা’ নয়, ‘বটবৃক্ষ’ হিসেবে দেখবো।

আমরা প্রবীণের খাদ্য, চিকিৎসা, নিরাপত্তা ও সম্মানকে অধিকার হিসেবে মান্য করবো।

আমরা পরিবারে, সমাজে ও রাষ্ট্রে প্রবীণবান্ধব মনোভাব গড়ে তুলবো।

কারণ যে সমাজ তার প্রবীণদের সম্মান করে না, সেই সমাজ কখনো সত্যিকার অর্থে মানবিক হতে পারে না। মানবাধিকারের আলো তখনই সম্পূর্ণ হয়, যখন সেই আলো দু কোটি প্রবীণের চোখেও নিরাপদ আশার আলো হয়ে জ্বলে উঠে।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়