শুক্রবার, ২০ জুন, ২০২৫  |   ২৮ °সে
জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয় অন্যান্য

প্রকাশ : ২০ জুন ২০২৫, ১২:৪০

আদর্শ মানুষ হতে চাই

মুহা. আবু বকর বিন ফারুক
আদর্শ মানুষ হতে চাই

মানুষ এই বিশ্বজগতের সবচেয়ে সম্মানিত ও শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি। আল্লাহ তায়ালা কুরআনুল কারিমে ঘোষণা করেন,”আর নিশ্চয়ই আমি মানব সন্তানকে মর্যাদা দিয়েছি “ .. (সূরা বনি ইসরাঈল: ৭০)।

এই মর্যাদা শুধু শরীরগত নয়, বরং মানুষকে জ্ঞান, বিবেক ও নৈতিক মূল্যবোধ দিয়ে বিশেষভাবে সজ্জিত করা হয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো—এই মর্যাদার প্রকৃত মানে কী? মানুষ কবে সত্যিকার অর্থে নিজের মর্যাদার মর্যাদা দিতে পারে? এর উত্তর হলো—যখন সে একজন আদর্শ মানুষে পরিণত হয়।

আমি একজন সাধারণ মানুষ। কিন্তু আমি চাই—আমি যেন একজন আদর্শ মানুষ হই। একজন ন্যায়পরায়ণ, নৈতিকতায় দৃঢ়, দ্বীনদার, চরিত্রবান ও মানবতার সেবক মানুষ। আমার এই চাওয়া কোনো রূপকথার গল্প নয়। বরং এ এক বাস্তব লক্ষ্য, যা আমি ইসলামি আদর্শ ও আল্লাহর নির্দেশনার আলোকে অর্জন করতে চাই।

আদর্শ মানুষ কাকে বলে?

“আদর্শ মানুষ” শব্দটি উচ্চারণেই এক ধরনের সৌন্দর্য, এক মহৎ মানসিকতা প্রকাশ পায়। আদর্শ মানুষ সেই ব্যক্তি, যিনি সত্যের পথে অবিচল থাকেন, সৎ কাজের দিকেই ধাবিত হন, আল্লাহকে ভয় করেন এবং রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর আদর্শে জীবন পরিচালনা করেন।

তিনি শুধু নিজের জন্যই জীবন গড়েন না, বরং পরিবারের, সমাজের, এমনকি সমগ্র মানবতার জন্য কল্যাণকর হন। তঁার আচার-আচরণ, ভাষা, পোশাক, চালচলন, চিন্তা, দৃষ্টি—সব কিছুতেই পরিপূর্ণতা ও সৌন্দর্য ফুটে উঠে।

আদর্শ মানুষের কিছু বৈশিষ্ট্য নিম্নরূপ:

★ সত্যবাদী ও বিশ্বস্ত।

★মানুষের কল্যাণে নিরবচ্ছিন্ন কাজ করে।

★আল্লাহকে ভয় করে এবং তঁার সন্তুষ্টির জন্য জীবন পরিচালনা করে।

★অহংকারী নয়, বিনয়ী।

★গোপনে ও প্রকাশ্যে সমানভাবে ন্যায়পরায়ণ।

আমি কেন আদর্শ মানুষ হতে চাই ?

আমি এমন এক সমাজে বাস করছি, যেখানে অশান্তি, অন্যায়, অবিচার, দুর্নীতি, চরিত্রহীনতা, মিথ্যা ও হিংসা প্রতিনিয়ত আমাদের গ্রাস করছে। আমি নিজ চোখে দেখছি, কিভাবে মানুষ মানুষকে প্রতারণা করছে, কিভাবে লোভে পড়ে নিজের আত্মাকে বিকিয়ে দিচ্ছে, কিভাবে মানুষ আল্লাহর আদেশকে উপেক্ষা করে দুনিয়ার স্বার্থকে বড় করে তুলছে।

এই অন্ধকার সমাজে আমি ফুটাতে চাই। আমি চাই, আমার জীবন হোক অন্যের জন্য এক আশীর্বাদ। আমি চাই, আমার কথা, আমার কাজ, আমার চরিত্র ইসলামের আলোতে আলোকিত হোক।

রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন:

“তোমাদের মধ্যে উত্তম সেই, যে চরিত্রে উত্তম।” (বুখারী)

এই হাদীস আমাকে প্রেরণা দেয় নিজেকে উত্তম মানুষে রূপান্তর করার জন্য। আমি চাই, আমার জীবন ও চরিত্র যেন ইসলামের উজ্জ্বল প্রতিচ্ছবি হয়ে উঠে।

আদর্শ মানুষ হওয়ার পথে ইসলামি নির্দেশনা :

আদর্শ মানুষ হতে চাইলে ইসলামি জীবনব্যবস্থার অনুসরণই হলো সর্বোত্তম পথ। আল্লাহ তায়ালা বলেন নিশ্চয়ই তোমাদের জন্য আল্লাহর রাসূলের মধ্যে রয়েছে উত্তম আদর্শ। “ (সূরা আহযাব: ২১)

রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর জীবন ছিল পূর্ণাঙ্গ আদর্শে ভরপুর। তিনি যেমন ছিলেন দয়াবান, তেমনি ন্যায়পরায়ণ। তিনি যেমন ছিলেন বিশ্বস্ত, তেমনি ছিলেন সাহসী ও দৃঢ়চিত্ত। তিনি যেমন আল্লাহভীরু ছিলেন, তেমনি ছিলেন মানুষকে ভালোবাসার প্রতীক। তঁার প্রতিটি পদক্ষেপ একজন আদর্শ মানুষের পরিচয় বহন করে।

আমি রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর জীবন থেকে শিক্ষা নিতে চাই:

★তঁার মতো করে মা-বাবার প্রতি সম্মান প্রদর্শন করতে চাই

★তঁার মতো করে প্রতিবেশীর হক আদায় করতে চাই।

★তঁার মতো করে দুঃস্থ-অসহায়দের পাশে দঁাড়াতে চাই।

★তঁার মতো করে প্রতিটি কথা ও কাজে সততা ও ন্যায়পরায়ণতা বজায় রাখতে চাই।

আদর্শ মানুষ গঠনে ১০ টি মূলনীতি :

১. আল্লাহভীতি ( তাকওয়া) : আদর্শ মানুষের প্রথম বৈশিষ্ট্য আল্লাহভীতি। আল্লাহ বলেন,”নিশ্চয়ই আল্লাহভীরু লোকদের জন্য রয়েছে সফলতা। “ (সূরা আন-নাবা: ৩১)

২. সৎ চরিত্র : রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন,” আমি তো উত্তম চরিত্র সম্পন্ন করতে প্রেরিত হয়েছি। “ (মুয়াত্তা মালিক)

৩. জ্ঞান অন্বেষণ : ইসলাম জ্ঞানার্জনকে ফরয করেছে। একজন আদর্শ মানুষ জ্ঞান অর্জনে আগ্রহী ও উদ্যমী হয়।

৪. পরিশ্রম ও ধৈর্য : আলসেমি নয়, পরিশ্রম ও ধৈর্য একজন আদর্শ ব্যক্তির ভূষণ।

৫. সুন্দর ব্যবহার ও নম্রতা: কারো সাথে রুক্ষতা নয়, ভদ্রতা ও নম্রতা একজন আদর্শ ব্যক্তির চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য।

৬. মানবতার সেবা : অভাবী, অসহায়, পথহারা মানুষকে সাহায্য করা একজন আদর্শ মানুষের পরিচয়।

৭. সততা ও আমানতদারি : ব্যবসা-বাণিজ্য হোক বা সামাজিক দায়িত্ব—সততা একজন আদর্শ ব্যক্তিকে আলাদা করে তুলে।

৮. পরিবারের প্রতি দায়িত্ব : মা-বাবা, স্ত্রী-সন্তান ও আত্মীয়দের প্রতি দায়িত্বশীলতা।

৯. সমাজে শান্তি ও সুবিচার প্রতিষ্ঠা : আদর্শ মানুষ সমাজের কল্যাণে কাজ করে, অন্যায়ের প্রতিবাদ করে।

১০. আখিরাতের ভয় : একজন আদর্শ মানুষ দুনিয়ার ক্ষণস্থায়ী জীবনের মোহে নয়, আখিরাতের সফলতায় বিশ্বাসী।

আদর্শ মানুষ হওয়ার পথে বাধা ও করণীয় :

আদর্শ হওয়ার পথে অনেক বাধা আছে—নফসের প্রলোভন, শয়তানের ধেঁাকা, খারাপ সঙ্গ, মিডিয়ার অপসংস্কৃতি, দুনিয়ামুখী চিন্তা ইত্যাদি। তাই এসব থেকে বেঁচে থাকতে চাইলে করতে হবে:

১. আল্লাহর জিকিরে লিপ্ত থাকা।

২. ভালো বন্ধু নির্বাচন করা।

৩. নফসকে নিয়ন্ত্রণ করা।

৪. কুরআন তিলাওয়াত ও হাদীস চর্চা করা।

৫. নিয়মিত আত্মসমালোচনা করা।

আমার প্রতিজ্ঞা :

আমি আল্লাহর সামনে প্রতিজ্ঞা করছি—আমি আল্লাহকে সন্তুষ্ট করার জন্যই বঁাচতে চাই। আমি অন্যকে ধেঁাকা দিয়ে নয়, বরং সত্য ও ন্যায়ের পথে জীবন গড়তে চাই। আমি চাই, আমার প্রতিটি কাজ হোক মানুষের উপকারে, আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য। আমি চাই, মৃত্যুর পর মানুষ বলুক—“এই মানুষটি সত্যিই একজন আদর্শ মানুষ ছিলেন।”

পরিশেষে বলব, আদর্শ মানুষ হওয়া কোনো অলীক স্বপ্ন নয়, বরং একজন সচেতন মুসলিমের দায়িত্ব। আমাদের সমাজ, দেশ ও পৃথিবীর উন্নতির মূল চাবিকাঠি হলো—প্রতিটি মানুষ যেন নিজেকে আদর্শ মানুষে রূপান্তর করে।

লেখক : ইমাম ও খতিব, বিষ্ণুপুর মনোহরখাদী মদিনা বাজার বাইতুল আমিন জামে মসজিদ, চঁাদপুর সদর, চঁাদপুর।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়