প্রকাশ : ১৬ ডিসেম্বর ২০২৫, ০১:৪৭
মুক্তির সূর্য: ১৬ ডিসেম্বর এক শাশ্বত অঙ্গীকার

বিজয় দিবস! এটি বাঙালির জাতীয় জীবনের সবচেয়ে আলোকিত দিন, যেদিন দীর্ঘ চব্বিশ বছরের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক শোষণ এবং নয় মাসের সশস্ত্র সংগ্রাম-এর চূড়ান্ত পরিণতি লাভ করেছিল। ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর, একটি জাতির সীমাহীন ত্যাগ ও রক্তের বিনিময়ে পৃথিবীর মানচিত্রে বাংলাদেশ নামের একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্রের অভ্যুদ্বয় ঘটেছিল। এই দিনটি আমাদের হারানো আত্মমর্যাদা পুনরুদ্ধারের দিন, লাখো শহীদের রক্তের ঋণ স্বীকারের এক পবিত্র অঙ্গীকার। বিজয় দিবস কেবল একটি উৎসব নয়, এটি গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার, সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা এবং জনগণের মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করার শপথ গ্রহণের দিন। এই দিনটি বাঙালির আত্মোপলব্ধি, গৌরব, আর বীরত্বের প্রতীক।
|আরো খবর
১. ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট: শোষণের বিরুদ্ধে দ্রোহের অগ্নিশিখা
১৯৪৭ সালে ধর্মের ভিত্তিতে পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্ম হলেও, পূর্ব পাকিস্তানের (আজকের বাংলাদেশ) জনগণ শুরু থেকেই পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর বৈষম্য ও শোষণ-এর শিকার হন। ভাষা, সংস্কৃতি, অর্থনীতি এবং রাজনীতি—জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই এই শোষণ ছিল প্রকট। বাঙালি জাতি তখনই অনুধাবন করেছিল যে, তাদের জাতীয় অস্তিত্ব ও ভাগ্য উন্নয়নের জন্য সংগ্রাম অপরিহার্য।
বাঙালি জাতিসত্তা বিকাশের মূলে ছিল অনন্য মাইলফলক মহান ভাষা আন্দোলন (১৯৫২)। মাতৃভাষা বাংলার মর্যাদা রক্ষার জন্য তরুণ প্রজন্ম রাজপথে রক্ত দিয়ে প্রমাণ করেছিল যে, সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্যই তাদের জাতীয় জীবনের ভিত্তি। এরপর শিক্ষা আন্দোলন, ঐতিহাসিক ছয় দফা আন্দোলন (১৯৬৬), যা ছিল বাঙালির মুক্তির সনদ এবং ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান—প্রতিটি ধাপেই বাঙালি জাতি স্বৈরাচারী শাসকদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিল।
এই আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তৎকালীন প্রধান নেতৃবৃন্দ। তাঁদের দূরদর্শী নেতৃত্ব ও রাজনৈতিক প্রজ্ঞা জাতিকে স্বাধীনতা অর্জনের পথে ধাপে ধাপে এগিয়ে নিয়ে যায়। এরই প্রেক্ষাপটে ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আহ্বানে স্বাধিকার আন্দোলন চরম শক্তি অর্জন করে। সেই ঐতিহাসিক ভাষণে তিনি পরোক্ষভাবে সশস্ত্র সংগ্রামের প্রস্তুতি নেওয়ার দিকনির্দেশনা দেন, যা ছিল জাতিকে যুদ্ধের জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত করার এক সুস্পষ্ট বার্তা।
২. ২৫শে মার্চের কালরাত ও স্বাধীনতার ঘোষণা: নেতৃত্বের সঙ্কট নিরসন
বাঙালির স্বাধীনতা চেতনাকে চিরতরে নস্যাৎ করার হীন প্রয়াসে ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ কাল রাতে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী ‘অপারেশন সার্চলাইট’-এর নামে ইতিহাসের অন্যতম বর্বর গণহত্যা শুরু করে। এই জঘন্য গণহত্যার মধ্য দিয়েই শুরু হয় সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ।
সেই চরম অনিশ্চয়তা ও দিশাহীনতার মধ্যে, চট্টগ্রামে প্রতিরোধ সংগ্রাম যখন দানা বাঁধছে, তখন কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে তত্কালীন মেজর জিয়াউর রহমান-এর ঐতিহাসিক ঘোষণাই যুদ্ধকে সাংগঠনিক ভিত্তি দেয় এবং জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করে।
তিনি বলেছিলেন—
“I, Major Ziaur Rahman, Provisional President and Commander-in-Chief of Liberation Army do hereby proclaim independence of Bangladesh and appeal for joining our liberation struggle...”
[ছবি ক্যাপশন: ঐতিহাসিক ঘোষণা: কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে ২৬শে মার্চ মেজর জিয়াউর রহমান স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠ করছেন। (ঐতিহাসিক আর্কাইভ ছবি)]
৩. রণাঙ্গনের ৯ মাস: বীরত্বের অগ্নিপরীক্ষা ও ত্যাগ
মার্চ থেকে ডিসেম্বর এই ৯ মাস ধরে চলেছিল মরণপণ যুদ্ধ। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসররা এদেশে লুটতরাজ, হত্যাকাণ্ড ও ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছে। ত্রিশ লাখ শহীদ ও দুই লাখ মা-বোনের সম্ভ্রম-এর বিনিময়ে অর্জিত হয় আমাদের স্বাধীনতা।
৪. আন্তর্জাতিক পটভূমি: বিশ্ব জনমতের প্রভাব
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন আন্তর্জাতিক পর্যায়েও ছিল এক জটিল কূটনৈতিক প্রেক্ষাপট। কিন্তু বিশ্ব জনমত ধীরে ধীরে বাংলাদেশের পক্ষে দাঁড়ায়।
৫. চূড়ান্ত বিজয় ও সার্বভৌমত্বের প্রতিষ্ঠা
১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর ঢাকার ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণের মাধ্যমে বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়।
৬. বিজয় দিবসের গুরুত্ব ও তাৎপর্য: হারানো গণতন্ত্রের পুনরুদ্ধার
বিজয় দিবস আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় গণতন্ত্র, ন্যায়বিচার ও মানবাধিকারের অঙ্গীকার।
৭. সুবর্ণ জয়ের অঙ্গীকার: জনগণের প্রত্যাশা
দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষা এবং হারানো গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার—এই দুই মূল মন্ত্রে উজ্জীবিত হয়েই শহীদদের স্বপ্ন বাস্তবায়ন সম্ভব।
লেখক পরিচিতি: মো. জাকির হোসেন, তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক, চাঁদপুর জেলা বিএনপি।
ডিসিকে/এমজেডএইচ








