বুধবার, ১৭ ডিসেম্বর, ২০২৫
জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয় অন্যান্য

প্রকাশ : ১৬ ডিসেম্বর ২০২৫, ০১:৪৭

রক্তস্নাত মুক্তির সূর্য: ১৬ ডিসেম্বর এক শাশ্বত অঙ্গীকার

মো. জাকির হোসেন
রক্তস্নাত মুক্তির সূর্য: ১৬ ডিসেম্বর এক শাশ্বত অঙ্গীকার

বিজয় দিবস! এটি বাঙালির জাতীয় জীবনের সবচেয়ে আলোকিত দিন, যেদিন দীর্ঘ চব্বিশ বছরের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক শোষণ এবং নয় মাসের সশস্ত্র সংগ্রামের চূড়ান্ত পরিণতি লাভ করেছিল। ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর, একটি জাতির সীমাহীন ত্যাগ ও রক্তের বিনিময়ে পৃথিবীর মানচিত্রে ‘বাংলাদেশ’ নামের একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্রের অভ্যুদ্বয় ঘটেছিল। এই দিনটি আমাদের হারানো আত্মমর্যাদা পুনরুদ্ধারের দিন, লাখো শহীদের রক্তের ঋণ স্বীকারের এক পবিত্র অঙ্গীকার। বিজয় দিবস কেবল একটি উৎসব নয়, এটি গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার, সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা এবং জনগণের মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করার শপথ গ্রহণের দিন। এই দিনটি বাঙালির আত্মোপলব্ধি, গৌরব, আর বীরত্বের প্রতীক।

১. ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট: শোষণের বিরুদ্ধে দ্রোহের অগ্নিশিখা

১৯৪৭ সালে ধর্মের ভিত্তিতে পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্ম হলেও, পূর্ব পাকিস্তানের (আজকের বাংলাদেশ) জনগণ শুরু থেকেই পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর বৈষম্য ও শোষণের শিকার হন। ভাষা, সংস্কৃতি, অর্থনীতি এবং রাজনীতি—জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই এই শোষণ ছিল প্রকট। বাঙালি জাতি তখনই অনুধাবন করেছিল যে, তাদের জাতীয় অস্তিত্ব ও ভাগ্য উন্নয়নের জন্য সংগ্রাম অপরিহার্য।

বাঙালি জাতিসত্তা বিকাশের মূলে ছিল অনন্য মাইলফলক মহান ভাষা আন্দোলন (১৯৫২)। মাতৃভাষা বাংলার মর্যাদা রক্ষার জন্য তরুণ প্রজন্ম রাজপথে রক্ত দিয়ে প্রমাণ করেছিল যে, সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্যই তাদের জাতীয় জীবনের ভিত্তি। এরপর শিক্ষা আন্দোলন, ঐতিহাসিক ছয় দফা আন্দোলন (১৯৬৬), যা ছিল বাঙালির মুক্তির সনদ এবং ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান—প্রতিটি ধাপেই বাঙালি জাতি স্বৈরাচারী শাসকদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিল।

এই আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তৎকালীন প্রধান নেতৃবৃন্দ, যেমন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, শেরে বাংলা এ.কে. ফজলুল হক, এবং শেখ মুজিবুর রহমান। তাঁদের দূরদর্শী নেতৃত্ব ও রাজনৈতিক প্রজ্ঞা জাতিকে স্বাধীনতা অর্জনের পথে ধাপে ধাপে এগিয়ে নিয়ে যায়। এরই প্রেক্ষাপটে ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আহ্বানে স্বাধিকার আন্দোলন চরম শক্তি অর্জন করে। সেই ঐতিহাসিক ভাষণে তিনি পরোক্ষভাবে সশস্ত্র সংগ্রামের প্রস্তুতি নেওয়ার দিকনির্দেশনা দেন, যা ছিল জাতিকে যুদ্ধের জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত করার এক সুস্পষ্ট বার্তা।

২. ২৫শে মার্চের কালরাত ও স্বাধীনতার ঘোষণা: নেতৃত্বের সঙ্কট নিরসন

বাঙালির স্বাধীনতা চেতনাকে চিরতরে নস্যাৎ করার হীন প্রয়াসে ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ কাল রাতে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী ‘অপারেশন সার্চলাইট’-এর নামে ইতিহাসের অন্যতম বর্বর গণহত্যা শুরু করে। এই জঘন্য গণহত্যার মধ্য দিয়েই শুরু হয় সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ

২৫শে মার্চ শেষ প্রহরে অর্থাৎ ২৬শে মার্চ প্রথম প্রহরে শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। এই ঘোষণার ভিত্তিতেই পরবর্তীতে স্বাধীনতার সংগ্রাম শুরু হয়। তবে সামরিক বাহিনীর অতর্কিত হামলায় যখন রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও সাংগঠনিক কাঠামোতে সঙ্কট দেখা দেয়, তখন জাতির দিকনির্দেশনার প্রয়োজন ছিল সবচেয়ে বেশি।

সেই চরম অনিশ্চয়তা ও দিশাহীনতার মধ্যে, চট্টগ্রামে প্রতিরোধ সংগ্রাম যখন দানা বাঁধছে, তখন কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে তত্কালীন মেজর জিয়াউর রহমানের ঐতিহাসিক ঘোষণাই যুদ্ধকে সাংগঠনিক ভিত্তি দেয় এবং জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করে।

প্রত্যক্ষদর্শী প্রফেসর শায়েস্তা খানের তথ্যমতে, ২৬ মার্চ সকাল ৭টা ৪৫ মিনিট নাগাদ জিয়াউর রহমান তাঁর অবিনশ্বর ঘোষণা দেন। তিনি বলেছিলেন:

"I, Major Ziaur Rahman, Provisional President and Commander-in-Chief of Liberation Army do hereby proclaim independence of Bangladesh and appeal for joining our liberation struggle... We will have to fight and liberate the country from the occupation of Pakistan Army. Inshallah, victory is ours."

মুক্তিযোদ্ধা ও গ্রুপ কমান্ডার শাহাবুদ্দিন আহমেদ চৌধুরী নিশ্চিত করেছেন যে কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত এই বার্তাটি বিশ্বব্যাপী যুদ্ধের বার্তা পৌঁছে দিতে সহায়ক হয়েছিল। মেজর জিয়াউর রহমানের এই ঘোষণাই ছিল সামরিক বাহিনীর একজন সদস্যের কাছ থেকে সরাসরি স্বাধীনতার ঘোষণা, যা যুদ্ধকালীন নেতৃত্বকে সুসংগঠিত করে। এই ঘোষণার মধ্য দিয়েই বাংলার মুক্তিকামী জনগণ একটি বৈধ সামরিক নেতৃত্বর অধীনে ঝাঁপিয়ে পড়ার প্রেরণা খুঁজে পায়। এই ঘোষণার পরপরই শুরু হয় বাঙালির মহাকাব্য—মুক্তিযুদ্ধ

IMG-20251215-WA0007

[ছবি ক্যাপশন: ঐতিহাসিক ঘোষণা: কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে ২৬শে মার্চ মেজর জিয়াউর রহমান স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠ করছেন। (ঐতিহাসিক আর্কাইভ ছবি)]

৩. রণাঙ্গনের ৯ মাস: বীরত্বের অগ্নিপরীক্ষা ও ত্যাগ

মার্চ থেকে ডিসেম্বর এই ৯ মাস ধরে চলেছিল মরণপণ যুদ্ধ। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসররা এদেশে লুটতরাজ, হত্যাকাণ্ড ও ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছে। ত্রিশ লাখ শহীদদুই লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে অর্জিত হয় আমাদের স্বাধীনতা। এই যুদ্ধের মূল চালিকাশক্তি ছিল নিরস্ত্র জনগণের অভূতপূর্ব সাহস, আর তা সম্ভব হয়েছিল শহীদ জিয়ার আহ্বানে সামরিক ও বেসামরিক জনগণের সমন্বিত প্রতিরোধে।

মুক্তিসংগ্রামকে সুসংগঠিত করার জন্য পুরো দেশকে মোট ১১টি সেক্টরে ভাগ করা হয়েছিল, যার প্রথম সূচনা হয়েছিল মেজর জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে। এই সেক্টর কমান্ডাররা নিজ নিজ অঞ্চলের যুদ্ধ পরিচালনায় অসামান্য দক্ষতা ও বীরত্ব দেখিয়েছিলেন। এটি কেবল পুরুষের যুদ্ধ ছিল না, আমাদের নারীরাও এই সংগ্রামে আত্মত্যাগ করেছেন। বীরাঙ্গনাদের আত্মত্যাগ আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে এক চিরন্তন বেদনার অধ্যায়। কৃষক-শ্রমিক, ছাত্র-শিক্ষক, শিল্পী-সাহিত্যিক, ডাক্তার-প্রকৌশলী, ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সমগ্র বাঙালি জাতি সেদিন ঐক্যবদ্ধ হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল মুক্তিসংগ্রামে।

৪. আন্তর্জাতিক পটভূমি: বিশ্ব জনমতের প্রভাব

মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন আন্তর্জাতিক পর্যায়েও ছিল এক জটিল কূটনৈতিক প্রেক্ষাপটযুক্তরাষ্ট্রচীন তখন পাকিস্তানের সামরিক জান্তাকে সমর্থন জানাচ্ছিল, যা ছিল আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্য এক বিশাল চ্যালেঞ্জ। কিন্তু ভারতসোভিয়েত ইউনিয়নের সক্রিয় সমর্থন এবং পশ্চিমা বিশ্বের গণতন্ত্রকামী জনমত আমাদের পক্ষে আসে।

ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে ভারত ও বাংলাদেশের সমন্বয়ে গঠিত যৌথ বাহিনী সামরিক অভিযান শুরু করে। দ্রুতই পাকিস্তানি সামরিক কাঠামো ভেঙে পড়ে। বিশ্বজুড়ে শরণার্থী সংকট, গণহত্যা এবং মানবিক বিপর্যয়ের খবর ছড়িয়ে পড়ায় আন্তর্জাতিক চাপ ক্রমাগত বাড়তে থাকে, যা পাকিস্তানকে আত্মসমর্পণে বাধ্য করে। এই কূটনৈতিক জয় স্বাধীনতা সংগ্রামের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ।

৫. চূড়ান্ত বিজয় ও সার্বভৌমত্বের প্রতিষ্ঠা

দীর্ঘ ৯ মাস যুদ্ধের পরে, ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর ঢাকার ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) এক মহেন্দ্রক্ষণে দখলদার পাকিস্তান সেনাবাহিনীর প্রায় ৯১,৬৩৪ জন সদস্য বাংলাদেশ ও ভারতের সমন্বয়ে গঠিত যৌথ বাহিনীর কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মসমর্পণ করে। এই আত্মসমর্পণের দলিল স্বাক্ষরের মাধ্যমে বিশ্বের মানচিত্রে ‘বাংলাদেশ’ একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে স্থান লাভ করে। এই অনন্য বিজয়ের ফলেই বাঙালি জাতি পরাধীনতার গ্লানি মুছে ফেলে একটি নতুন জাতিসত্তা ও পতাকা লাভ করে।

Screenshot-20251216-131242

[ছবি ক্যাপশন: ১৬ ডিসেম্বরের সেই মুহূর্ত: জেনারেল নিয়াজীর আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে বাঙালির চূড়ান্ত বিজয়, পৃথিবীর মানচিত্রে নতুন রাষ্ট্রের অভ্যুদয়। (আত্মসমর্পণের ঐতিহাসিক ছবি)]

৬. বিজয় দিবসের গুরুত্ব ও তাৎপর্য: হারানো গণতন্ত্রের পুনরুদ্ধার

বিজয় দিবস কেবল একটি উৎসবের দিন নয়, বরং এটি আত্মোপলব্ধি এবং নতুন করে দেশ গড়ার শপথ নেওয়ার দিন। এই দিবসের তাৎপর্য বাঙালির জীবনে অত্যন্ত গভীর:

সার্বভৌমত্ব অর্জন ও জাতীয় পরিচয়: এই দিনে বাঙালি জাতি পরাধীনতার শিকল থেকে মুক্ত হয়ে নিজস্ব আত্মপরিচয় ও মানচিত্র লাভ করে।

শহীদদের আত্মত্যাগ স্মরণ: এই দিনটি আমাদের ত্রিশ লাখ শহীদের অসীম সাহস ও আত্মত্যাগকে স্মরণ করিয়ে দেয়।

গণতন্ত্র ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা: মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনা ছিল গণতন্ত্র, সামাজিক ন্যায়বিচার, মৌলিক মানবাধিকার ও অর্থনৈতিক সমতা প্রতিষ্ঠা করা। বিজয় দিবস এই চেতনাকে ধারণ করে একটি আদর্শ রাষ্ট্র গঠনে আমাদের উৎসাহিত করে।

৭. সুবর্ণ জয়ের অঙ্গীকার: জনগণের প্রত্যাশা

বিজয় অর্জনের অর্ধশতাব্দী পার হয়েছে। যুদ্ধবিধ্বস্ত একটি দেশ থেকে আজকের অবস্থানে আসতে বাংলাদেশের সামনে বহু চ্যালেঞ্জ এসেছে। জাতি আজও সেই গণতান্ত্রিক অধিকার, সামাজিক ন্যায়বিচার এবং বৈষম্যমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে, যা ছিল মুক্তিযুদ্ধের মূল অঙ্গীকার।

আমাদের প্রত্যাশা—মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনাকে সমুন্নত রেখে, সব ধরনের অগণতান্ত্রিক শক্তিস্বৈরাচারী মনোভাবকে পরিহার করে, একটি জনগণের সরকার প্রতিষ্ঠা করাই হোক আজকের দিনের প্রধান অঙ্গীকার। আমাদের এই প্রজন্মকে অবশ্যই দেশের সেবায় নিজেকে নিয়োজিত করতে হবে এবং স্বাধীনতা অর্জনে লাখো মানুষের আত্মত্যাগের ইতিহাসকে বুকে ধারণ করতে হবে। দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষা এবং হারানো গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার—এই দুই মূল মন্ত্রে উজ্জীবিত হয়ে তবেই শহীদদের স্বপ্ন বাস্তবে রূপ নেবে।

লেখক পরিচিতি: মো.জাকির হোসেন, তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক, চাঁদপুর জেলা বিএনপি।

ডিসিকে/এমজেডএইচ

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়