প্রকাশ : ১৯ অক্টোবর ২০২৫, ১৯:৩৯
ঢাকা-চাঁদপুর নৌরুটে যাত্রী ভোগান্তি ও যাত্রী সংখ্যা হ্রাস
অব্যবস্থাপনা ও দুর্বল সেবায় ধুঁকছে লঞ্চ ব্যবসা

ঢাকা-চাঁদপুর নৌরুট একসময় দেশের অন্যতম জনপ্রিয় ও গুরুত্বপূর্ণ নৌরুট হিসেবে বিবেচিত ছিলো। প্রতিদিন হাজারো মানুষ যাতায়াত করতো এই রুটে। বিশেষ করে চাঁদপুর, হাইমচর, মতলব, শরীয়তপুর ও আশপাশের জেলা থেকে ঢাকায় যাতায়াতকারী যাত্রীদের জন্যে এটি ছিল নিরাপদ, সাশ্রয়ী এবং আরামদায়ক মাধ্যম। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে এই রুটের প্রতি যাত্রীদের আগ্রহ আশঙ্কাজনক হারে কমে যাচ্ছে। অনুসন্ধানে উঠে এসেছে এ রুটে চলাচলকারী লঞ্চগুলোর দুর্বল সেবা, নিরাপত্তার অভাব, খাবারের নিম্নমান, ভাড়া বৃদ্ধির দৌরাত্ম্য, সময়মতো গন্তব্যে না পৌঁছানোসহ লঞ্চ মালিক ও চালকদের অব্যবস্থাপনা। এসব কারণে যাত্রীরা এই রুট এড়িয়ে চলছেন।
|আরো খবর
যাত্রীসংখ্যা কমে যাওয়ার পেছনের মূল কারণসমূহ অনুসন্ধানে দেখা যায়, বেশিরভাগ লঞ্চ দীর্ঘদিন ধরে মেরামতহীন অবস্থায় চলছে। যাত্রীদের অভিযোগ : সিটগুলো নোংরা ও অস্বস্তিকর, টয়লেট ব্যবস্থাও অত্যন্ত নাজুক। এমনকি কিছু লঞ্চে জরুরি নিরাপত্তা সরঞ্জামের অভাব রয়েছে, যা যে কোনো সময় বড়ো ধরনের দুর্ঘটনার ঝুঁকি তৈরি করতে পারে।
চাঁদপুর সদরের এক ব্যবসায়ী বলেন, আগে পরিবার নিয়ে লঞ্চে করে ঢাকায় যেতাম। কিন্তু এখন লঞ্চে উঠলেই মনে হয় জীবন হাতে করে যাচ্ছি। টয়লেট ব্যবহার করাই যায় না। শিশুরা কষ্ট পায়।
যাত্রীদের প্রধান অভিযোগগুলোর একটি হলো, সময়মতো লঞ্চ না ছাড়ার প্রবণতা। সকাল ৬টা ৪৫ মিনিটের সময়সূচি থাকলেও লঞ্চ অনেক সময় ৭টা কিংবা সাড়ে সাতটায় ছাড়ে। যাত্রাপথে অনাকাঙ্ক্ষিত ও অপ্রয়োজনীয় স্টপেজ যুক্ত করে যাত্রা দীর্ঘ করা হয়।
ফরিদগঞ্জের যাত্রী রুহুল আমিন জানান, ঢাকায় অফিস ধরতে হলে ভোরে রওনা দিয়ে সকাল ১০টার মধ্যে পৌঁছাতে হয়। কিন্তু লঞ্চ যদি সকাল ৭টায় ছাড়ে, তাহলে সময়মতো পৌঁছানো অসম্ভব। তাই বাধ্য হয়ে সড়কপথে যাচ্ছি, যদিও সেটা বেশি কষ্টকর। এছাড়া সরকার নির্ধারিত ভাড়ার চেয়ে অনেক সময় বেশি ভাড়া নেয়া হয় যাত্রীদের কাছ থেকে। বিশেষ করে ঈদ বা ছুটির সময় এ ভাড়া দ্বিগুণ হয়ে যায়। লঞ্চের কিছু কর্মচারী ‘ভিআইপি কেবিন’ নামে বিশেষ কেবিনে বেশি টাকা না দিলে সাধারণ কেবিনেও ঢুকতে বাধা দেন বলে অভিযোগ রয়েছে। স্টাফ কেবিনের ভাড়াও দ্বিগুণ চাচ্ছে। কারণ, অনেক সময় লঞ্চ স্টাফরা নিজেদের কেবিন ভাড়া দেয়ার জন্যে কেবিন নেই বলে জানিয়ে দেয়।
এক যাত্রী অভিযোগ করেন, লঞ্চের ভাড়া ১৫০ টাকা। প্রথম শ্রেণি ৩৫০, ভিআইপি ৪০০ টাকা। কিন্তু কেবিনে জায়গা পেতে চাইলে সিঙ্গেল ৮০০ টাকা, ডাবল ১২০০-১৬০০ টাকা চায়। যাত্রীসেবার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো খাবার ও পানি। কিন্তু এখানে রয়েছে ভয়াবহ অব্যবস্থপনা। রান্নাঘরের গন্ধে অনেক সময় যাত্রীদের বমি আসে। ফ্রিজের খাবার কয়েক দিন আগের, দুধ বা চায়ের স্বাদ পানিশূন্য। অনেকে বলেন, বাধ্য হয়ে খাওয়া বন্ধ করে দিয়েছেন।
লঞ্চে একবার ভ্রমণকারী এক নারী যাত্রী বলেন, একবার লঞ্চে খিচুড়ি খেয়ে রাতে বমি করতে হয়েছিলো। আর কোনোদিন খাই নি। এখন সাথে খাবার নিয়ে যাই।
রাতে নারী যাত্রীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হয় না। বেশ ক’টি অভিযোগ হচ্ছে এমন-- কর্মচারীরা অশোভন আচরণ করে, কেবিনে অযাচিতভাবে ঢুকে পড়ে। প্রশাসনিক নজরদারির অভাব এ অনিয়মকে প্রশ্রয় দিয়েছে।
এক নারী এনজিওকর্মী বলেন, আমাদের নারীদের জন্যে তো লঞ্চে কোনো ব্যবস্থা নেই। অনেক সময় বয়স্ক লোকজন সিট পায় না। কর্তৃপক্ষের কাছে অভিযোগ করলেও ফল হয় না।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, এই দুরবস্থার পেছনে অন্যতম কারণ লঞ্চ মালিক ও চালকদের দায়িত্বজ্ঞানহীনতা। চাঁদপুর নদী বন্দর বা ঢাকা সদরঘাট কর্তৃপক্ষ নিয়মিত তদারকি করছে না বলেই এসব অনিয়ম বিস্তৃত হচ্ছে। একাধিক যাত্রী দাবি করেছেন, চাঁদপুর নদীবন্দরে ‘বখরা’ দিয়ে শিডিউল পরিবর্তন, যাত্রা বিলম্ব বা অতিরিক্ত যাত্রী বহন সবই সম্ভব।
লঞ্চ স্টাফ পরিচয়ে এক ব্যক্তি জানান, আমাদের লঞ্চের ফিটনেসের মেয়াদ শেষ হলেও চলাচল বন্ধ হয় না। একটু ‘ম্যানেজ’ করলেই চলা যায়।
লঞ্চে নৈরাজ্যের প্রেক্ষিতে অনেক যাত্রী এখন সড়কপথে মাইক্রোবাস, বাস কিংবা প্রাইভেট গাড়ি ব্যবহার করছেন। যদিও তা ব্যয়বহুল ও সময়সাপেক্ষ, তবে অন্তত কিছুটা নিয়ন্ত্রণে ও নিরাপদ। চাঁদপুর-ঢাকা রুটে বাবুরহাট থেকে মাইক্রোর ব্যবহার বেড়েছে কয়েক গুণ।
এক সময়ের নিয়মিত লঞ্চযাত্রী বলেন, লঞ্চের ওপর থেকে আস্থা উঠে গেছে। এখন যতো কষ্টই হোক, ভোরে রওনা দিয়ে মাইক্রো করে ঢাকায় পৌঁছাই।
চাঁদপুর নৌবন্দরের কর্মকর্তাদের সাথে যোগাযোগ করে দেখা গেছে, তারা অনেক সময় দোষ স্বীকার করেন না বা দায় এড়ান। সময়সূচি বা ভাড়ার বিষয়ে অভিযোগ জানালে তারা ‘লিখিত অভিযোগ দিন’ বলে দায়সারা কথা বলেন। কিন্তু অধিকাংশ যাত্রীই মনে করেন, প্রশাসনের লোকজনের কেউ কেউ অনেক সময় নিজেরাও সুবিধাভোগী।
একজন লঞ্চচালক বলেন, অনেক সময় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদেরও ‘ম্যানেজ’ করতে হয়। তাহলে তারা আমাদের বিরক্ত করে না। তবে সব লঞ্চ বা মালিকই যে খারাপ তা নয়। কিছু লঞ্চ মালিক আধুনিক লঞ্চ চালু করেছেন, যেখানে এসি কেবিন, সময়মতো ছেড়ে যাওয়া, খাবারের উন্নতি দেখা যায়। এদের প্রতি যাত্রীদের আস্থা বাড়ছে, কিন্তু সংখ্যায় তারা খুব কম।
যাত্রীরা একাধিকবার বিভিন্ন প্রস্তাব দিয়েছেন। যেমন : প্রতিমাসে মান যাচাই করে র্যাংকিং প্রকাশ, একটি যাত্রী অভিযোগ কেন্দ্র চালু করা, সময়সূচি নিয়ন্ত্রণের জন্যে ডিজিটাল ঘড়ি ও জিপিএস ট্র্যাকিং চালু, খাবার ও টয়লেট পরিষ্কার রাখার নিয়মিত মনিটরিং করা, নারী যাত্রীদের জন্যে বিশেষ কেবিন ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা।
লঞ্চ মালিক সমিতির প্রতিনিধি বিপ্লব সরকার জানান, ঢাকা-চাঁদপুর নৌরুটে যাত্রী সংকটের উল্লেখযোগ্য কারণ হলো : মানসম্মত পরিবহন সংকট, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে যাত্রী সাধারণের অপ্রয়োজনীয় ভ্রমণ থেকে বিরত থাকা, আধুনিক নৌবন্দরের কাজে ধীরগতি, যাত্রী চলাচলে ভোগান্তি, সড়কের তুলনায় নৌপথে ভাড়া বেশি, সময়মতো লঞ্চ ছেড়ে না যাওয়া ও গন্তব্যে না পৌঁছা এবং বিআইডব্লিউটিএ’র অব্যবস্থাপনা ও তদারকির অভাব। তিনি আরো জানান, নৌপথে যাত্রী ফিরিয়ে আনতে মানসম্মত খাবার ও সুপেয় পানি, যাত্রীদের সাথে ভালো ব্যবহার, উন্নত পরিবহন ব্যবস্থা ও সড়কপথে অবৈধ যানবাহন চলাচল বন্ধ করতে হবে। এতে করে নৌ ও সড়ক পথে যাত্রী সেবার মান আরো উন্নত হবে।
যাত্রীদের আশঙ্কা, এসব প্রস্তাব যদি বাস্তবায়ন না হয়, তাহলে আগামী পাঁচ বছর পর ঢাকা-চাঁদপুর নৌরুট একেবারে যাত্রীশূন্য হয়ে পড়বে। ঢাকা-চাঁদপুর নৌরুটে এক সময়ের ব্যস্ততা এখন যেনো অতীত স্মৃতি। সময়মতো যাত্রা, নিরাপদ যাতায়াত, মানসম্পন্ন খাবার এবং ন্যায্য ভাড়া এসবই আজ দুর্লভ। অথচ একটু আন্তরিকতা ও প্রশাসনিক সক্রিয়তায় এই রুট আবার প্রাণচাঞ্চল্য ফিরিয়ে আনা সম্ভব। জনস্বার্থে এই রুটে দুর্নীতি ও দৌরাত্ম্যের অবসান ঘটিয়ে আধুনিক, সুশৃঙ্খল ও যাত্রীবান্ধব ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনা সময়ের দাবি।