মঙ্গলবার, ০১ জুলাই, ২০২৫  |   ৩৪ °সে
জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয় অন্যান্য

প্রকাশ : ০১ জুলাই ২০২৫, ০৩:২৮

প্রযুক্তি উদ্ভাবনের এই বৈষম্য কেন?

বুয়েটের ল্যাব বনাম গ্রামের গোয়ালঘর!

যেখানে কোটি টাকার গবেষণা ব্যর্থ, সেখানেই কেজি স্কুলপড়ুয়া বানায় প্লেন!

অনুসন্ধানী প্রতিবেদক :মো. জাকির হোসেন
বুয়েটের ল্যাব বনাম গ্রামের গোয়ালঘর!
ছবি :উপরে বুয়েটের তৈরি অটো রিক্সা, নিচে কৃষকের ছেলের তৈরি বিমান।

বাংলাদেশে প্রযুক্তি নিয়ে যতটা আলোচনা, বাস্তব উদ্ভাবন ততটাই সীমিত। “প্রযুক্তির রাজধানী” বলা হয় যে প্রতিষ্ঠানকে — বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট), সেই প্রতিষ্ঠান থেকে শেষবার কবে জনগণ বাস্তব উদ্ভাবনের ফল পেয়েছে, তা খুঁজে পাওয়া মুশকিল। অথচ এই প্রতিষ্ঠানকে ঘিরেই গড়ে ওঠে প্রকৌশল শিক্ষার আরাধনা, জাতীয় বাজেট থেকে কাটা হয় কোটি কোটি টাকা।

একই সময়ে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের এক দরিদ্র কৃষকের ছেলে, যার কাছে নেই আধুনিক ল্যাব, নেই বিদেশি প্রশিক্ষণ, কেবল ইউটিউব আর ধ্বংসপ্রাপ্ত ইলেকট্রনিক্সের যন্ত্রাংশে ভর করে বানিয়ে ফেলছে ড্রোন, ইলেকট্রিক গাড়ি, এমনকি জেনারেটর চালিত জাহাজের ক্ষুদ্র প্রোটোটাইপ!

তাহলে প্রশ্ন জাগে: কে আসল উদ্ভাবক? কাকে জাতীয় বিনিয়োগের যোগ্য বলা যাবে?

বুয়েটের ‘মেধা’ কি শুধু কনভোকেশন আর বিদেশযাত্রায় সীমাবদ্ধ?

বুয়েটের প্রতিটি শিক্ষার্থী দেশের সেরা মেধাবীদের তালিকায় থাকেন। প্রতি বছর HSC ফলাফলের ভিত্তিতে দেশের সবচেয়ে প্রতিযোগিতাপূর্ণ পরীক্ষার মাধ্যমে তারা ভর্তির সুযোগ পান। অথচ এই মেধাবীরা চার বছর পড়াশোনার পর উদ্ভাবকের বদলে চাকরিপ্রার্থী হয়ে যান। বিসিএস, মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির চাকরি কিংবা বিদেশে উচ্চশিক্ষা — এটাই গন্তব্য। তাদের উদ্ভাবনের কথা আর কখনো শোনা যায় না।

প্রশ্ন ওঠে, তাহলে এতদিন ধরে কোটি কোটি টাকা খরচ করে দেশের সেরা মেধাকে কী শেখানো হলো? দেশের জন্য তারা কী রেখে গেল?

ক্লাসরুম বনাম কারবার: গবেষণার নামে লিমিটেড কোম্পানি?

একটি নিরীক্ষা প্রতিবেদনে দেখা গেছে, বুয়েটের অন্তত ৩৪টি গবেষণা প্রজেক্ট ২০২০-২০২৩ সালের মধ্যে কোনোরূপ বাস্তবিক প্রয়োগ ছাড়াই ‘সম্পন্ন’ হয়েছে — কেবল রিপোর্ট দাখিল করেই। এসব প্রজেক্টে ব্যয় হয়েছে গড়ে ৮.৭ কোটি টাকা। এমনকি বেশ কিছু গবেষণার খাতে অর্থ গেছে অপ্রয়োজনীয় সফটওয়্যার লাইসেন্স, সেমিনার ভাতা, হোটেল বিল ও প্রিন্টিং খরচে।

এই গবেষণাগুলোর ৯৭%-ই ছিল কনফারেন্স কাগজে ব্যবহারের জন্য। জনজীবনের সাথে এর কোনো সংযোগ নেই।

প্রান্তিক প্রতিভা: যারা আধুনিক প্রযুক্তির বাস্তব চেহারা

বরিশালের আগৈলঝাড়ার আব্দুল্লাহ মাত্র ১৬ বছর বয়সে গবাদিপশুর গোয়ালঘরের পাশেই বসে তৈরি করেছে একটি চার চাকার ইলেকট্রিক গাড়ি। সোলার প্যানেল দিয়ে চার্জ হয়, ২৫ কিমি পর্যন্ত চালানো যায়। এই কাজ করতে গিয়ে সে নিজেই শিখেছে সোলার সার্কিট ডিজাইন, ব্যাটারি কানেকশন, গিয়ার সেটআপ — কিছুই সে বুয়েট থেকে শেখেনি।

কিশোরগঞ্জের মানিক হোসেন মাত্র সপ্তম শ্রেণি পাশ করে চায়ের দোকানে কাজ করতে করতেই রেডিওর যন্ত্রাংশ দিয়ে তৈরি করেছে চালকবিহীন প্লেনের মডেল। এইসব উদ্ভাবকরা হয়ত ইংরেজিতে দক্ষ নয়, কিন্তু উদ্ভাবনী সাহসে তারা বুয়েটের বহু গবেষককে পেছনে ফেলে দিয়েছে।

যারা কেবল স্বপ্ন দেখে না, বাস্তবেও প্রমাণ দেয়, তারাই প্রকৃত উদ্ভাবক।

বুয়েট কি বৃত্তান্তহীন ‘এলিট ক্লাব’ হয়ে উঠছে?

এই প্রশ্নে অনেকেই ব্যথিত হবেন, কিন্তু বাস্তবতা এড়িয়ে যাওয়া যায় না। বুয়েটের অভ্যন্তরে একটি 'এলিটিজম' তৈরি হয়েছে, যেখানে বাস্তব উদ্ভাবনের চেয়ে বেশি গুরুত্ব পায় বিদেশে উচ্চশিক্ষার সার্টিফিকেট, বিদেশি সম্মেলনে উপস্থিতি, আর চাকরির বাজারে উচ্চ বেতনের প্রতিযোগিতা।

যে শিক্ষা ব্যবস্থা বাস্তব উদ্ভাবনের বদলে সার্টিফিকেট অর্জনে উৎসাহ দেয়, তা একটি জাতিকে প্রযুক্তিগতভাবে দেউলিয়া করে দেয়।

সমাধান কোথায়?

  • প্রতিটি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে "উদ্ভাবন পাইলটিং সেল" গঠন করতে হবে — যেখানে গবেষণা হবে বাস্তব প্রোটোটাইপ তৈরির জন্য।
  • প্রান্তিক উদ্ভাবকদের জন্য ‘বিনা শর্তে সরকারি অনুদান’ ও ‘প্রযুক্তি প্রশিক্ষণ’ দিতে হবে।
  • বুয়েটসহ অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণার নিরীক্ষা করতে হবে — গবেষণার সামাজিক প্রভাব, প্রয়োগ ও কার্যকারিতা যাচাইয়ের ভিত্তিতে।
  • বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ২০% কে বাধ্যতামূলকভাবে উদ্যোক্তা প্রজেক্টে সম্পৃক্ত করতে হবে।

শেষ কথাঃ “ডিগ্রি নয়, উদ্ভাবনই হোক মাপকাঠি”

বাংলাদেশকে যদি সত্যিকারের প্রযুক্তিনির্ভর অর্থনীতিতে রূপান্তর করতে হয়, তবে বুয়েটকেন্দ্রিক অলস আত্মতুষ্টির গণ্ডি ভাঙতে হবে। উদ্ভাবনকে ঘরের বাইরে এনে মাঠে নামাতে হবে। সময় এসেছে শিক্ষা ব্যবস্থাকে প্রশ্ন করার — “ডিগ্রিধারী মেধাবী চাই, না বাস্তব উদ্ভাবক?”

বাংলাদেশের প্রকৌশল ভবিষ্যত এখন সেই গ্রামের উঠানে, যেখানে আজো লোহার খাঁচা দিয়ে কিশোররা গাড়ি তৈরি করে। বুয়েট যদি চুপ থাকে, তবে আগামী দিনের ‘বঙ্গবন্ধু টেক ভ্যালি’ তৈরি হবে কোন এক পল্লীর কৃষকের ছেলের হাত ধরে — এই ভবিষ্যৎকে আর অস্বীকার করা যাবে না।

প্রতিবেদন: মো. জাকির হোসেন
বিশেষ প্রতিনিধি, অনুসন্ধান বিভাগ
দৈনিক চাঁদপুর কন্ঠ

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়