প্রকাশ : ০২ জুলাই ২০২৫, ১৭:৩৪
রায়পুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে সমস্যা-সঙ্কট চরমে
বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকই নেই, ৯৮টি পদ শূন্য, অস্ত্রোপচার বন্ধ তিন বছর

লক্ষ্মীপুরের রায়পুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স তীব্র জনবল সংকটে ভুগছে। কোনো বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক নেই। এছাড়াও চিকিৎসক, নার্স, কর্মকর্তা, কর্মচারী ও পরিচ্ছন্নতাকর্মীর ৯৮টি পদ শূন্য। এক্স-রে কক্ষ তালাবদ্ধ গত দু মাস। চিকিৎসক সঙ্কট থাকায় হাসপাতালটিতে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীরা যথাযথ সেবা পাচ্ছেন না। অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষা বাইরে তিনগুণ বেশি টাকায় করাতে হচ্ছে রোগীদের।
|আরো খবর
আধুনিক সব সরঞ্জামসহ রয়েছে সুসজ্জিত অস্ত্রোপচার কক্ষ। কিন্তু চিকিৎসক ও চরম জালানি-সংকটের কারণে গরীব রোগীদের অস্ত্রোপচার করা যাচ্ছে না গত তিন বছর। জরুরি প্রয়োজনে রোগীদের বেশি টাকা খরচ করে জেলা শহরের বেসরকারি হাসপাতাল বা ক্লিনিকে গিয়ে অস্ত্রোপচার করাতে হচ্ছে।
রায়পুর স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স সূত্র জানায়, ২০০৬ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর বিএনপির চেয়ারপার্সন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া রায়পুর পৌরসভার দেনায়েতপুর এলাকায় স্থাপিত উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ৩১ শয্যা থেকে ৫০ শয্যায় উন্নীত করেন। তার কয়েক বছর পরই জনবল সংকটের মধ্য দিয়ে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছে এই হাসপাতালটি। উপজেলার ১০টি ইউনিয়নের প্রায় চার লাখ মানুষ এখান থেকে স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে থাকেন।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, অস্ত্রোপচার বন্ধ থাকায় ভবন, চিকিৎসক ও জনবল সংকটে হাসপাতালের সেবা কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। প্রসূতিদের অস্ত্রোপচারের জন্যে একজন গাইনি সার্জনসহ জনবল খুবই প্রয়োজন। হাসপাতালে অবেদনবিদ থাকলেও স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ নেই। দু বছর আগে স্বাস্থ্য সুরক্ষা কর্মসূচির নামে একটি প্রকল্পের অধীনে বিশাল একটি জেনারেটরসহ কোটি টাকার যন্ত্রপাতি আনা হলেও তা ব্যবহার না করায় অচল পড়ে আছে। নষ্ট হচ্ছে যন্ত্রপাতি। অন্য অস্ত্রোপচারের জন্যে হাসপাতালটিতে সার্জারি-বিশেষজ্ঞও নেই।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, এ স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসক, নার্স, তৃতীয়-চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীসহ মোট পদ রয়েছে ২০৩টি। এর মধ্যে ৯৭টি পদ শূন্য। স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসকের পদ রয়েছে ৩১টি। এর বিপরীতে কর্মরত রয়েছেন ১৮ জন। চিকিৎসা কর্মকর্তাদের আটটি পদের চারটি শূন্য। জুনিয়র কনসালট্যান্ট পদের ১০টি পদের বিপরীতে কর্মরত আছেন ৫ জন। বিশেষজ্ঞের পদে কোনো চিকিৎসক নেই। একজন ডেন্টাল সার্জন আছেন। হাসপাতালে প্রতি মাসে প্রচুর শিশু রোগী চিকিৎসা নিতে এলেও এই হাসপাতালে শিশু বিশেষজ্ঞ আছেন দুজন।
অর্থোপেডিক, চক্ষু, চর্ম ও যৌন, নাক কান গলা, হৃদ্রোগ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের মতো গুরুত্বপূর্ণ পদগুলো সৃষ্টি করা হলেও আজও পদায়ন করা হচ্ছে না। এ ছাড়া হাসপাতালে সিনিয়র স্টাফ নার্স ৩০ জনের মধ্যে আছেন ১৫ জন। ওয়ার্ড বয়, আয়া ও পরিচ্ছন্নতাকর্মীর ২৪টি পদের বিপরীতে আছে ১১ জন। আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে নেওয়া কয়েকজন পরিচ্ছন্নতাকর্মী পরিচ্ছন্নতার বিষয়টি দেখেন। চারটি কোয়ার্টার ভবন থাকলেও ঝুঁকিপূর্ণ ও বৃষ্টির পানি পড়ায় কোনো চিকিৎসক থাকেন না।
হাসপাতালটিতে ২০০৭ সালে অপারেশন থিয়েটার (ওটি) চালু হয়। তবে সেই থেকে ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সব ধরনের অস্ত্রোপচারই চালু ছিলো। তিন বছর ধরে চালুর উদ্যোগ নিলেও জেনরেটর ও লোকবলের কারণে হচ্ছে না। বিশেষজ্ঞ অবেদনবিদ না থাকলেও অ্যানেসথেসিয়ায় প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত চিকিৎসা কর্মকর্তা ইয়াসিন মাহমুদ অবেদনবিদের দায়িত্ব পালন করছেন। তিন বছর জেনারেটর না থাকায় অস্ত্রোপচার কার্যক্রম থমকে দাঁড়ায়। বিশেষ প্রয়োজনে মাঝে মাঝে অস্ত্রোপচার হয়ে থাকে। বিদ্যুৎ চলে গেলে মোমবাতির সাহায্যে অস্ত্রোপচার হয়।
হাসপাতালে গত জানুয়ারি থেকে জুন—এই ছয় মাসে ২৫ হাজার ৭৪৫ জন রোগী বহির্বিভাগে সেবা নিয়েছেন। এর মধ্যে ১২ হাজার ৮৮১ জন নারী এবং ১ হাজার ৯৪৯ জন শিশু রোগী; অর্থাৎ মাসে গড়ে এখানে প্রায় সাড়ে ৫ হাজার রোগী বহির্বিভাগে সেবা নেন। গত জুন মাসে প্রতিদিন গড়ে ৫৪ জন রোগী হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন।
২ জুলাই সরেজমিনে সকাল ১০টা থেকে বেলা ১২টা পর্যন্ত এ স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ঘুরে এবং রোগীদের সঙ্গে কথা বলে বিভিন্ন সমস্যার কথা জানা যায়। হাসপাতালটিতে একটি পুরোনো দ্বিতল ভবন ও একটি নতুন দ্বিতল ভবন আছে। পুরোনো দ্বিতল ভবনটিতে রোগী রাখার ব্যবস্থা থাকলেও মেঝেতে চিকিৎসা নিতে হয়। প্রশাসনিক ভবনে উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তার কার্যালয়, ফার্মেসি ও সম্মেলনকক্ষ করা হয়েছে। চিকিৎসা নেওয়ার জন্যে উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তার কক্ষের সামনে রোগীর দীর্ঘ সারি দেখা গেছে। বিভিন্ন ওয়ার্ডের বাইরে বারান্দাতেও শয্যা পাতা হয়েছে। হাসপাতালের অস্ত্রোপচারের কক্ষটি তালাবদ্ধ। ওটি ইনচার্জ সিনিয়র স্টাফ নার্সের সহযোগিতায় তালা খোলা হয়। দেখা যায়, সেখানে অস্ত্রোপচারের জন্যে সব সরঞ্জাম রয়েছে। পাশে পোস্ট অপারেটিভ কক্ষটিও সুসজ্জিত। তবে হাসপাতালে অস্ত্রোপচারের কোনো ব্যবস্থা নেই।
রায়পুরের চরবংশী ইউনিয়নের চরকাছিয়া গ্রামের বাসিন্দা শারমিন আক্তার বুকে-পিঠে ব্যথা নিয়ে আট দিন ধরে হাসপাতালের মহিলা ওয়ার্ডে ভর্তি আছেন। তিনি বলেন, প্রতিদিন চিকিৎসক দেখে যান। খাওয়া দাওয়াও মোটামুটি ভাল। এক্স-রে কক্ষ গত দুই মাস বন্ধ থাকায় তিনগুণ টাকা বেশি দিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা বাইরে থেকে করতে হচ্ছে রোগীদের।
এসব বিষয়ে উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা বাহারুল আলম বলেন, অস্ত্রোপচার কক্ষ চালু করতে পারলে মানুষ উপকৃত হতো। অবেদনবিদ থাকার পরও অস্ত্রোপচার কক্ষ চালু করেছিলাম। গত তিন বছর ধরে তা বন্ধ রয়েছে। বিশেষ প্রয়োজনে তা চালু করা হয়। জনবল সঙ্কটের বিষয়টি প্রতি মাসের প্রতিবেদনেই ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হচ্ছে।’ কোনো লাভ হচ্ছে না