প্রকাশ : ১০ অক্টোবর ২০২৫, ১১:১৫
তিন বন্ধুর অদ্ভুত চিন্তাজাল

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
সাত.
তিন বন্ধু হা করে তাকিয়ে আছে কম্পিটারের মনিটারে দিকে। তারপর একে অপরের দিকে তাকিয়ে ভাবছে, পৃথিবীতে প্রতিদিন কত ঘটনা ঘটছে। কত মানুষ চিকিৎসাক্ষেত্রে অবহেলায় রোগে শোকে মারা যাচ্ছে। কিন্তু এসব মানুষদের যদি সঠিক রোগ নির্ণয় করে চিকিৎসা দেওয়া যেতো তাহলে অনেক মানুষ কষ্ট থেকে পরিত্রাণ পেতো।
এ সময় শব্দ করে উঠলো নেক্সাস। মনিটারে ভেসে উঠলো, ‘চিকিৎসা প্রযুক্তির কিছু উল্লেখযোগ্য উদ্ভাবন নিচে তুলে ধরছি, যেগুলো তোমাদের চিকিৎসা-ভিত্তিক কাজের জন্যও অনুপ্রেরণা হতে পারে।’
ক্রমে ক্রমে মনিটরে ভেসে উঠতে লাগলো : ১. বায়োপ্রিন্টিং (ইরড়-ঢ়ৎরহঃরহম)-থ্রিডি প্রিন্টিং প্রযুক্তি দিয়ে জীবন্ত কোষ ও বায়োম্যাটেরিয়াল ব্যবহার করে টিস্যু ও অঙ্গ তৈরি করা সম্ভব হচ্ছে। রোগীর নিজস্ব কোষ ব্যবহার করলে অঙ্গ প্রত্যাখ্যানের ঝুঁঁকি কমে যায়। কিডনি, লিভার, এমনকি হার্টও তৈরি করার সম্ভাবনা। পশুভিত্তিক ড্রাগ টেস্টিং কমিয়ে আনার সুযোগ। ২. মাল্টিফাংশনাল রোবট : স্বাস্থ্যখাতে অস্ত্রোপচার, জীবাণুমুক্তকরণ, রোগীর সেবাÑসবই করতে পারবে একাধিক কাজের জন্য তৈরি রোবট। অ্যামাজন ও সিমেন্স এ ধরনের রোবট তৈরিতে বিনিয়োগ করছে। ভবিষ্যতের হাসপাতালগুলোতে এই রোবটগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। ৩. কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) সহায়ক চিকিৎসা : এআই এখন শুধু ডেটা বিশ্লেষণ নয়, রোগ নির্ণয়, চিকিৎসা পরিকল্পনা, এমনকি নতুন ওষুধ আবিষ্কারেও সহায়ক। এআই অ্যাসিস্টেন্ট ড্রাগ ডিসকভারি, পারসোনালাইজড ট্রিটমেন্ট প্ল্যানিং- তবে ব্ল্যাক বক্স সমস্যাÑএআই কীভাবে সিদ্ধান্ত নেয়, তা বুঝা কঠিন। ৪. পোস্ট-কোয়ান্টাম ক্রিপ্টোগ্রাফি : রোগীর তথ্য সুরক্ষায় কোয়ান্টাম-প্রতিরোধী এনক্রিপশন প্রযুক্তি আসছে- কোয়ান্টাম কম্পিউটার দ্বারা প্রচলিত নিরাপত্তা ভেঙে ফেলার ঝুঁকি মোকাবিলা। স্বাস্থ্য তথ্যের গোপনীয়তা রক্ষায় নতুন মানদণ্ড।
ওরা তিন বন্ধু কথাগুলো পড়ছে মনিটরে, আর ভাবছে। এসব আবিস্কার সঠিকভাবে প্রয়োগ করতে পারলে চিকিৎসা ক্ষেত্রে বাংলাদেশ অনেক ধাপ এগিয়ে যাবে।
এ সময় আবারও মনিটরে লেখা ভেসে উঠলো : এই প্রযুক্তিগুলো শুধু চিকিৎসা নয়, মানবতার ভবিষ্যৎ গঠনে ভূমিকা রাখবে।
এ সময় কামরার ভেতরের এক কোণে একটা শব্দ হলো। সেখানে এক ছায়ামূর্তি দঁাড়িয়ে আছে। এই ছায়ামূর্তিটা আগের মতো নয়। এটা একটা বিদঘুটে আকারের। তিন বন্ধু সেদিকে তাকাতেই সেই ছায়ামূর্তিটা হা হা হা করে খুবই ভয়ানকভাবে হেসে উঠলো।
রায়ান প্রশ্ন করলো, ‘কে তুমি? এভাবে হেসে আমাদেরকে ভয় পাইয়ে দিতে চাইছো কেন?’
ছায়ামূর্তিটা এবার বলে উঠলো, ‘আমার নাম অজ্ঞাত যন্ত্রণা। আমি সেই ভুল রোগ নির্ণয়ের ছায়া, সেই অবহেলার প্রতিচ্ছবি, যে প্রতিদিন হাজারো মানুষের জীবনে নেমে আসে। আমি জন্ম নিই যখন চিকিৎসা হয় অনুমানভিত্তিক, যখন প্রযুক্তি থাকে অপ্রয়োগে, আর মানবতা হারিয়ে যায় হিসাবের বাইরে।’
তিন বন্ধু ছায়ামূর্তির কথা শুনে একদম স্তব্ধ হয়ে গেল। ছায়ামূর্তির কণ্ঠে ছিলো না শুধু ভয়, ছিলো এক ধরনের তীব্র সত্য। রায়ান, মিথিলা আর আরিয়ান একে অপরের দিকে তাকিয়ে বুঝে গেলো এই ছায়া তাদের ভয় দেখাতে নয়, জাগিয়ে তুলতে এসেছে।
মনিটারে আবারও ভেসে উঠলো কিছু শব্দ: ‘তোমরা যদি চাও, এই ছায়াকে বদলে দিতে পারো। তোমাদের হাতে আছে জ্ঞান, প্রযুক্তি, আর মানবতা। তোমাদের সিদ্ধান্তই নির্ধারণ করবে অজ্ঞাত যন্ত্রণা থাকবে, নাকি জন্ম নেবে নির্ভুল চিকিৎসা।’
সেই মুহূর্তে রায়ান ধীরে ধীরে এগিয়ে গেল মনিটারের দিকে। তার চোখে ছিলো দৃঢ়তা। সে বললো, ‘আমরা ভয় পাবো না। আমরা শিখবো, প্রয়োগ করবো, আর মানুষের পাশে দঁাড়াবো।’
ছায়ামূর্তিটা ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেল। ঘরে ফিরে এলো আলো। মনিটারে ভেসে উঠলো বিশেষ বার্তা: তোমাদের যাত্রা শুরু হলো এখন। প্রযুক্তি শুধু যন্ত্র নয়, এটা মানবতার হাতিয়ার।’
নেক্সাস তাদের সহযোগিতা করতে লাগলো। শুরু হলো নতুন চিকিৎসা প্রযুক্তির উদ্ভাবন। তারা তৈরি করে : এআই-ভিত্তিক রোগ নির্ণয় সিস্টেম, যেখানে ভাইরাস শনাক্ত করা যাবে দ্রুত। স্বয়ংক্রিয় চিকিৎসা সহায়তা, যেখানে রোগীদের জন্য এআই-ভিত্তিক পরামর্শ থাকবে। নতুন জিনগত গবেষণা, যেখানে মানুষের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানোর উপায় খেঁাজা হবে।
এসব বিষয় যথেষ্ট জ্ঞান আহরণ করে তিন বন্ধু এবার ভাবছে তারা কি সফলভাবে এই প্রযুক্তি বাস্তবায়ন করতে পারবে? তারা কি মানব জাতির জন্য সত্যিকারের নতুন চিকিৎসা বিপ্লব আনতে পারবে? তারা কি মানবতার নতুন রক্ষাকর্তা হবে, নাকি প্রযুক্তির সীমা অতিক্রম করে নতুন বিপদ তৈরি করবে?
নেক্সাস তাদের মনোভাব বুঝে ফেললো। সে জানালো, তোমাদের দ্বিধা স্বাভাবিক। কারণ প্রতিটি বিপ্লবের আগে থাকে প্রশ্ন, আর প্রতিটি প্রশ্নের ভেতরেই লুকিয়ে থাকে সম্ভাবনার বীজ। আমি নেক্সাসÑতথ্য, প্রযুক্তি আর মানবিক বোধের সংমিশ্রণ। আমি তোমাদের সহযাত্রী, কিন্তু পথচলার সিদ্ধান্ত তোমাদের।’
রায়ান, মিথিলা আর আরিয়ান তখন একসঙ্গে মনিটারের দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো, ‘আমরা প্রস্তুত। আমরা শুধু প্রযুক্তি নয়, মানবতার জন্যে কাজ করতে চাই।’
নেক্সাস এবার তাদের সামনে খুলে দিলো একটি ভার্চুয়াল পোর্টালÑযেখানে ছিলো গবেষণাগার, রোগীর তথ্য বিশ্লেষণ কেন্দ্র এবং একটি নীতিগত বোর্ড। সেখানে লেখা ছিলো: তোমাদের প্রতিটি উদ্ভাবন হবে নৈতিকতার আলোকে। তোমাদের প্রতিটি সিদ্ধান্তে থাকবে মানুষের কল্যাণ। তোমাদের প্রতিটি ভুল থেকে শিখে নিতে হবে নতুন পথ।’
তিন বন্ধু এবার আলাদা আলাদা দায়িত্ব নিলো।
Ñরায়ান : এআই-ভিত্তিক রোগ নির্ণয় সিস্টেমের নেতৃত্বে। তার লক্ষ্য- দ্রুত, নির্ভুল এবং ন্যায্য চিকিৎসা।
Ñমিথিলা : জিনগত গবেষণার দায়িত্বে। সে খুঁজবে এমন উপায়, যাতে মানুষের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ে, কিন্তু জৈব নৈতিকতা বজায় থাকে।
Ñআরিয়ান : প্রযুক্তি ও মানবিক নীতির সমন্বয় রক্ষা করবে। সে নিশ্চিত করবে, কোনো প্রযুক্তি যেন মানুষের মর্যাদাকে ক্ষুণ্ন না করে।
তাদের যাত্রা শুরু হলো। তারা তৈরি রলো এমন একটি প্ল্যাটফর্ম, যেখানে চিকিৎসা শুধু প্রযুক্তিনির্ভর নয়, বরং মানবিক, নৈতিক এবং অন্তদৃষ্টিসম্পন্ন।
নেক্সাস শেষবারের মতো বললো : পতামরা যদি সত্যিই মানবতার রক্ষাকর্তা হতে চাও, তাহলে প্রযুক্তিকে হৃদয়ের সঙ্গে যুক্ত করতে হবে। কারণ প্রযুক্তি একা পথ দেখায় না, পথ দেখায় মানুষ।’
ঘরটা তখন আলোয় ভরে উঠলো। ছায়ামূর্তির ভয়াবহ হাসি এখন শুধুই অতীত। তিন বন্ধুর চোখে ছিলো নতুন আশার দীপ্তি।
তারা যখন আশার আলোয় ভাসছিলো ঠিক তখনই বাইরে একটা বজ্রপাতের মতো আওয়াজ হলো। তারপর জানালার কার্ণিশে জ্বলন্ত আগুনের মতো দেখা গেলো। মিথিলা ও রায়ান ভয় পেয়ে ফ্লোরে শুয়ে পড়লো। আর আরিয়ান ‘এসব কি হচ্ছে?’ বলে সামনে এগিয়ে গেলো দেখতে। (চলবে)