বুধবার, ০৮ অক্টোবর, ২০২৫  |   ৩১ °সে
জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয় অন্যান্য

প্রকাশ : ০৮ অক্টোবর ২০২৫, ০৯:১৭

খাগড়াছড়ির রক্তক্ষরণ

এক যুগেও শেষ হয়নি রামু-ক্ষত, সম্প্রীতি ফেরাতে করণীয় কী?

অসীম বিকাশ বড়ুয়া
এক যুগেও শেষ হয়নি রামু-ক্ষত, সম্প্রীতি ফেরাতে করণীয় কী?

পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড় আজ আবার উত্তপ্ত। খাগড়াছড়ির সাম্প্রতিক সংঘাত ও সহিংসতা কেবল একটি স্থানীয় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি নয়Ñএটি বাংলাদেশের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির ভিত্তিকে দুর্বল করার এক গভীর ষড়যন্ত্রের অংশ, যা ১২ বছর আগে ঘটে যাওয়া রামু ট্র্যাজেডির ক্ষতকে আবারও উসকে দিচ্ছে।

প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, ২০১৯ সালে মোটরসাইকেল চালক মামুন হত্যা, এবং সম্প্রতি (২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৫) এক স্কুলছাত্রী ধর্ষণের অভিযোগকে কেন্দ্র করে পরিস্থিতি দ্রুত ঘোলাটে হয়েছে। ইউপিডিএফ (ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট) ও এর অঙ্গসংগঠনগুলোর বিক্ষোভ, অবরোধ এবং এরপর সেনাবাহিনী ও বিজিবির ওপর হামলার ঘটনায় খাগড়াছড়ি ও গুইমারা এলাকায় কার্যত গৃহযুদ্ধের মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে, যা থামাতে জারি করতে হয়েছে ১৪৪ ধারা।

রামু থেকে খাগড়াছড়ি : দীর্ঘসূত্রিতার অভিশাপ

২০১২ সালের ২৯ সেপ্টেম্বরের রামু সহিংসতা এবং ২০২৫ সালের খাগড়াছড়ির ঘটনা, দুটোই দেশের অভ্যন্তরে সাম্প্রদায়িক অস্থিরতার উদাহরণ। তবে উভয়ের মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ সংযোগ রয়েছে : ন্যায়বিচারের দীর্ঘসূত্রিতা।

রামু ট্র্যাজেডির ১২ বছর পেরিয়ে গেলেও ১৮টি মামলার একটিরও নিষ্পত্তি হয়নি। সাক্ষীদের অনীহা এবং মামলার চার্জশিট নিয়ে বিতর্কের কারণে বিচার প্রক্রিয়া থমকে আছে। বৌদ্ধ ভিক্ষু প্রজ্ঞানন্দ যেমনটি বলেছিলেন, গুজব রটনাকারীদের বিরুদ্ধে ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি না নিলে এই ধরনের ঘটনা বারবার ঘটবে।

খাগড়াছড়ির ঘটনা প্রমাণ করে, অতীতে এ ধরনের সহিংসতার বিচার না হওয়ায় অপরাধীরা সাহস পাচ্ছে। সেনাবাহিনী তাদের বিবৃতিতে ইউপিডিএফ ও তাদের সহযোগী সংগঠনগুলোকে সুপরিকল্পিতভাবে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টির জন্য দায়ী করেছে। অন্যদিকে, পাহাড়ের আদিবাসীদের পক্ষ থেকে সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে দীর্ঘদিনের বিদ্বেষ ও নির্যাতনের অভিযোগও উঠে এসেছে, যেমনটি কলামে উল্লেখ করা হয়েছে। এই পারস্পরিক অবিশ্বাস ও বিদ্বেষ পার্বত্য চুক্তির শর্ত পূরণ না হওয়ার ফলÑযা শান্তি ফিরিয়ে আনার প্রধান বাধা।

সেনা-বিদ্বেষ ও অবিশ্বাস : চুক্তির ব্যর্থতা?

বৌদ্ধ সন্ন্যাসীর স্মৃতিচারণায় পাহাড়ের মানুষ ও সেনাবাহিনীর সম্পর্কের যে চিত্র ফুটে উঠেছে, তা উদ্বেগজনক। শৈশবে মহিষকে গুলি করে মারার ঘটনায় যে ভীতির সৃষ্টি হয়েছিল, তা আজও কাটেনি। পার্বত্য চুক্তিতে সেনাবাহিনী সেনানিবাসে ফিরে যাওয়ার কথা থাকলেও, একজন পাহাড়ি বলছেন, ‘সেনাবাহিনী তো সেনানিবাসে ফিরেনি।’

মূল সমস্যাটি হলো : সেনাবাহিনী কি এখনও ‘নির্দিষ্ট কারোর সেনাবাহিনী’ নাকি সকলের?

আদিবাসীদের অভিযোগ : তারা মনে করেন, তারা ফিলিস্তিনিদের মতো ‘সেটেলার ও সেনাবাহিনীর’ হাতে নির্যাতিত হচ্ছে। তাদের চোখে দূর দেশের ফিলিস্তিনিদের প্রতি যে সহানুভূতি, তা দেশের ভেতরের আদিবাসীদের প্রতি অনুপস্থিত।

সেনাবাহিনীর দাবি : তারা পার্বত্য অঞ্চলের অখণ্ডতা রক্ষায় প্রতিশ্রুতিবদ্ধ এবং ইউপিডিএফ-এর সশস্ত্র ও নাশকতামূলক কর্মকাণ্ডকে প্রতিরোধ করছে।

সেনাবাহিনী যদি চিরস্থায়ী শান্তি ফেরাতে চায়, তবে কেবল সামরিক পদক্ষেপই যথেষ্ট নয়। তাদের ‘খাকি পোশাকের পুলিশ’ যেমন ‘আমার পুলিশ’ হয়েছে, তেমনি সেনাবাহিনীকে পাহাড়ের সকল জনগোষ্ঠীর আস্থা অর্জন করতে হবে। পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়ন এবং সেনাবাহিনীতে আদিবাসী অন্তর্ভুক্তির দাবিটি এই আস্থার অভাব দূর করার একটি কার্যকর পথ হতে পারে।

শান্তির পথে করণীয় : মৈত্রী ও পদক্ষেপ

একজন বৌদ্ধ ভিক্ষুর ‘মৈত্রীপূর্ণ চিত্তে’ দেওয়া বার্তাটিই আজকের খাগড়াছড়ির জন্য সবচেয়ে জরুরি। ‘জগতের সকল প্রাণী সুখী হোক’Ñএই আদর্শে উপনীত হতে হলে নিম্নলিখিত পদক্ষেপগুলো নিতে হবে :

পক্ষপাতহীন আইনি প্রক্রিয়া : স্কুলছাত্রী ধর্ষণের ঘটনায় গ্রেপ্তারকৃত শয়ন শীলের দ্রুত ও স্বচ্ছ বিচার নিশ্চিত করতে হবে। একই সঙ্গে, খাগড়াছড়ির সংঘাতের ঘটনায় জড়িত সকল পক্ষকে (পাহাড়ি ও বাঙালি) নিরপেক্ষভাবে চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনতে হবে।

পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়ন : দীর্ঘদিনের অবিশ্বাস দূর করতে পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি চুক্তির পূর্ণ ও দ্রুত বাস্তবায়ন অপরিহার্য। এটিই পাহাড়ে ‘চিরস্থায়ী শান্তি’ ফেরানোর মূল ভিত্তি।

গুজব ও উস্কানির বিরুদ্ধে পদক্ষেপ : ইউপিডিএফ এবং প্রবাসী ব্লগারদের উস্কানিমূলক প্রচারণার জবাবে সেনাবাহিনী কর্তৃক কঠোর পদক্ষেপের কথা বলা হলেও, মূল ধারার মিডিয়া ও প্রশাসনের উচিত হবে বিভ্রান্তিমূলক তথ্য ও গুজবের উৎসগুলোকে দ্রুত শনাক্ত করে বন্ধ করা।

নারীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করা : পাহাড়ি মেয়েরা যে ধর্ষণের বিরুদ্ধে সবার সমানভাবে রুখে দাঁড়ানোর আহ্বান জানিয়েছে, তা অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। জাতি-গোষ্ঠী নির্বিশেষে সকল নারীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের প্রথম দায়িত্ব হওয়া উচিত।

খাগড়াছড়ির রক্তক্ষরণ বন্ধ করে সুন্দর, ভয়হীন ও সুশৃঙ্খল সমাজব্যবস্থা ফিরিয়ে আনতে হলে কেবল শক্তি প্রয়োগ নয়, প্রয়োজন ন্যায়বিচার, সততা এবং আত্ম-সম্মানবোধ। রামু ট্র্যাজেডির বিচার দ্রুত শেষ করে এবং পার্বত্য চুক্তির মাধ্যমে পাহাড়ে সকলের আস্থা ফিরিয়ে এনেই কেবল ‘সুন্দর একটা বাংলাদেশ’ গড়া সম্ভব।

অসীম বিকাশ বড়ুয়া : সাংবাদিক, প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়