প্রকাশ : ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১২:৩৯
হৃদয়বতী

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
নয়.
ইমতিয়াজকে হোটেল সৈকতের সেই রুমটা খুলে দিলো হরকত। ইমতিয়াজ ভেতরে প্রবেশ করলো। হরকত বললো, ‘দেখেন বস, তিনটা মায়াবতী পরী। একদম উচ্চ মূল্যে বিক্রয় হবে।’
ইমতিয়াজ হরকতকে হাত দিয়ে ইশারা করতেই সে বাইরে চলে গেলো। দরজা বন্ধ করলো ইমতিয়াজ। তারপর অনন্যার দিকে তাকিয়ে বললো, ‘কী নাম তোমার?’
তিন বোন জড়োসড়ো হয়ে বসে আছে। তাদের হাতের বাঁধন ও মুখের স্কচটেপ কিছুক্ষণ আগে এসে হরকত খুলে দিয়েছিলো।
ইমতিয়াজকে দেখে অনন্যা ভয় পেলো না। নির্বিকারভাবে উত্তর দিলো, ‘আমি অনন্যা। আর ওরা আমার ছোট দু বোন--রুবিনা ও তাসফিয়া।’
‘বাহ, বেশ সুন্দর নাম তোমাদের। অনেক মায়াবতী তোমরা-- অনন্যা-রুবিনা-তাসফিয়া। নিশ্চয় তোমাদের বাবা মা অনেক উচ্চ বিত্তবান মানুষ?
‘কেনো আপনার টাকা লাগবে?’ অনন্যা প্রশ্ন করলো।
‘নাহ, টাকা লাগবে না। শুধু ভালোবাসা লাগবে আজকের রাতের জন্যে। আজকের রাতটা আমি তোমাদের সাথে বিনিময় করতে চাই। তোমরা আমাকে তিনজন মিলে একসাথে ভালোবাসবে। একটা মানুষের তিনটা বউ থাকতে পারে না? তেমনি করে?’
ইমতিয়াজের মুখে ক্রুর হাসি।
‘তাই নাকি?’ অনন্যা প্রশ্ন করে। তারপর বলে, ‘শুনুন। আমরা নিরুদ্দেশের পথে যাত্রা করেছি। জানি না আমাদের ভাগ্যে কী আছে? তবে আপনি আমাদেরকে অপহরণ করে ভালো করেননি। আপনারও একদিন কন্যা সন্তান হবে। তখন বুঝতে পারবেন একজন বাবার কাছে কন্যা সন্তানের মূল্য কতোখানি।’
ইমতিয়াজের গালে কষে একটা চড় পড়লো যেনো। সে অনন্যার কথায় মুহূর্তেই নিজের কন্যার কথা মনে করলো। যে কন্যাটি সমুদ্রের জোয়ারে ভেসে গিয়েছিলো ৫ বছর আগে। সেই থেকে তার হৃদয়ে গভীর হাহাকার চলছে তার কন্যার জন্যে।
জীবনে সে অনেক পাপ করেছে। ভাবতে লাগলো। তার কারণেই সে একটি কন্যার পিতা হয়েও এভাবে তাকে সমুদ্রের জোয়ারের মাঝে হারিয়েছে। হ্যাঁ, পাপ। গভীর পাপ।
নিজ কন্যাকে মানুষ বুকের মধ্যে আগলে রাখে। আর অন্যের কন্যাকে আঘাত করতেও ভাবে না কিছুই। এটাও যে অন্যের হৃদয়ের মণি সেটা দুর্বৃত্ত মানুষ কখনোই মনে করে না।
‘কী হলো কী ভাবছেন? আমাদের তিন বোনের ক্ষতি করবেন? নাকি বেচে দেবেন কানাডার পল্লীতে। নাকি আমার বাবা নাদের গুণ্ডার কাছে কল করে বলবেন, তোমার কন্যাকে বাঁচাতে হলে তিন ঘণ্টার মধ্যে ৫০ লাখ টাকা দিতে হবে, না হলে তাদেরকে মেরে সাগরের ঘোলাজলে ভাসিয়ে দেওয়া হবে।’ অনন্যা বেশ সাহসের সাথেই ইমতিয়াজকে বললো কথাগুলো।
ইমতিয়াজ প্রশ্ন করলো, ‘নাদের গুণ্ডা তোমাদের পিতা? ওহ মাই গড। তিনি তো মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। শুনছি এখন ভালো হয়ে গেছেন।
ইমতিয়াজ হরকতকে ডাকলো। হরকত হন্তদন্ত হয়ে ইমতিয়াজের পাশে এসে দাঁড়ালো, ‘বস, আদেশ করুন।’
‘ওদেরকে ছেড়ে দাও।’ এই বলে ইমতিয়াজ চলে যাচ্ছিলো। কিন্তু হরকত বললো, ‘কী বলেন বস? এতো কষ্ট করে ধরে আনছি। বেচলে তো কিছু টাকা পাইতাম।’
ঠাস করে হরকতের গালে একটা চড় পড়লো। হরকত কিছু বোঝার আগেই ইমতিয়াজ পকেট থেকে রিভলবার বের করে হরকতের মাথায় ঠেকালো। তারপর বললো, ‘কথা কম, কাজ বেশি। বুঝতে পারছস্?’
‘হ, বস। মাইরেন না। ওদেরকে ছাইড়া দিতাছি।’
তিনবোনের দিকে তাকিয়ে ইমতিয়াজ বললো, ‘যাও, তোমরা স্বাধীন, মুক্ত। যেখানে খুশি চলে যাও। তোমার বাবাকে আমার সালাম দিও।’
‘কিন্তু আমরা এতো রাতে কই যাবো? এখন তো বাইরে আমাদের জন্যে নিরাপদ নয়।’ অনন্যা উত্তর দিলো।
বাইরে থেকে হ্যান্ড মাইকের আওয়াজ। ‘ইমতিয়াজ বেরিয়ে এসো। তোমার জন্যে আমরা অপেক্ষা করছি। আর মেয়েদেরকে ছেড়ে দাও।’
জানালা দিয়ে অনন্যা দেখলো একদল আর্মি। সাথে রয়েছে ইরফান ও তুষার আহমেদ। যাকে সে ভার্সিটিতে একজন রিপোর্টার হিসেবে ভালোভাবেই চিনতো। এই সাংবাদিকই তার বাবার অজানা বিষয়গুলো পত্রিকায় পাতায় প্রকাশ করছিলো, যা মানুষ জানতো না।
ইমতিয়াজও জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আর্মির দলকে দেখতে পেলো। তবে ইরফানকে দেখে সে চমকে উঠলো। ভাবলো, ওর তো থানার গারদখানায় থাকার কথা, সে ছাড়া পেলো কীভাবে? তাহলে কি ওসি প্রদীপ বেঈমানি করলো?
এসব ভাবনার মাঝেই আবারও ঘোষণা হলো-- ইমতিয়াজ যদি ধরা না দাও, তাহলে আমরা অ্যাকশনে যেতে বাধ্য হবো।
এ সময় কথা বললো অনন্যা, ‘কী ভাবছেন? ধরা দেবেন, নাকি পেছনের পথ দিয়ে পালিয়ে যাবেন?’
‘আন্ডারওয়ার্ল্ডের একজন ডন কখনো পালিয়ে যায় না।’ অনন্যার প্রশ্নের উত্তরে জবাব দিলো ইমতিয়াজ। ‘শোনো আমার পাপই আমাকে ধরিয়ে দিবে। যত পাপ, তত কালসাপ। সুতরাং হাজার কালসাপের ছোবল খাওয়া থেকে আর্মির হাতে ধরা দেওয়াই উত্তম ও গর্বের বিষয়। ঠিক না।’
‘হতে পারে, তবে আপনাকে আমি একজন নতুন মানুষ হিসেবে আবিষ্কার করলাম, যে কি-না আমার একটিমাত্র কথাতেই আমূল বদলে গেছেন। আপনি আমাদের ক্ষতি করতে পারতেন, সে সুযোগ ছিলো। কিন্তু তারপরও আপনি আমার কথাগুলো ভেবে দেখেছেন এবং আমাদেরকে ছেড়ে দিতে বলেছেন। তাই আমি আপনার একটি উপকার করবো। আপনার জন্যে ওই রাস্তাটি খোলা আছে, যে রাস্তাটি দিয়ে আমাদেরকে হোটেলে তারা নিয়ে এসেছিলো। আমরা আস্তে আস্তে আর্মির সামনে যাবো, আর আপনি সেই সুযোগে পেছন দিয়ে চলে যাবেন।’
‘একজন ডন কখনো পালায় না, মেয়েরা। বুকের পাটা সাগরের সমান হলেই সে ডন হতে পারে। আমি অবশ্যই ধরা দেবো, কিন্তু তারা আমাকে ধরে রাখতে পারবে না।’
‘যা-ই হোক। আমি চাই না আপনি এই মুহূর্তে ধরা পড়েন। তাহলে আপনি ভালো হয়ে যাওয়া থেকে বিচ্যুত হয়ে যাবেন। আমরা চাই আপনি যাতে ভালো হয়ে যেতে পারেন।
‘একজন আন্ডারওয়ার্ল্ডের ডন কখনো চাইলেই ভালো হয়ে যেতে পারে না। মাফিয়ার উপরও আরেক মাফিয়া থাকে, সেই মাফিয়ার নাম জামশেদ। আমার ওপর তার নির্দেশ ছিলো তোমাদেরকে তুলে নিয়ে যেতে অন্য দেশে। কিন্তু আমি তা পারছি না। শূন্য হাতেই চলে যেতে হবে আমাকে। তবে, জেনে রেখো, আমি কোনো দিনও তোমাদের মতো নিষ্পাপ হয়ে যেতে পারবো না। কারণ আমার হাতটা বহু মানুষের রক্তে রঞ্জিত। ভালো হওয়া এতো সহজ নয়।’
‘হয়তো কেউ কেউ তা পারে।’ অনন্যা যেনো তলিয়ে যাওয়া জাহাজের যাত্রীর মতো সাহস যোগালো ইমতিয়াজকে, ‘ভালো হওয়ার জন্যে অনুতপ্ত মন থাকা চাই।’ (চলবে)