সোমবার, ০৪ আগস্ট, ২০২৫  |   ২৮ °সে
জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয় অন্যান্য

প্রকাশ : ০৪ আগস্ট ২০২৫, ০৮:৪৫

আশ্লিষ্ট অনুভূতি

বিমল কান্তি দাশ
আশ্লিষ্ট অনুভূতি

১৭৫৭ সালের ২৩শে জুন বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার স্বাধীনতা সূর্য ডুবে গিয়েছিল। দুর্ধর্ষ ব্রিটিশ ক্রমে ক্রমে পাক-ভারত উপমহাদেশটি সম্পূর্ণ গিলে ফেললো। তার মধ্যে ছিলো পাকিস্তান, সিংহল (বর্তমান শ্রীলঙ্কা) ও ব্রহ্মদেশ (বর্তমান মিয়ানমার)। পরাধীনতার শৃঙ্খলে পর শাসনের দুর্বিষহ শোষণ-নিপীড়ন ভারতবাসীর মধ্যে উগ্র জাতীয়তাবাদের বীজ বপন করে নির্বিবাদে ব্রিটিশরা। ভারত শাসন করতে চেয়েছিল। প্রবল ঘাত-প্রতিঘাতের দংশনে ১৮ জুলাই ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ পার্লামেন্টে ভারত স্বাধীনতা আইন পাস হয়। এই আইনের ফলে ভারতে ব্রিটিশ শাসনের অবসান হয়ে জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে ভারত এবং পাকিস্তান দুটি স্বাধীন দেশ জন্ম লাভ করে। আবার পাকিস্তানের একটি অংশ পূর্ব-পাকিস্তান (বর্তমানের স্বাধীন বাংলাদেশ) রূপে আত্মপ্রকাশ করে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর, যা ঘোষিত হয়েছিল ২৬ মার্চ ১৯৭১।

যুক্তরাজ্যের বস্ত্রশিল্পকে অত্যন্ত সমৃদ্ধ এবং আকর্ষণীয় করার কাজে নীল রঙের ব্যবহার ছিলো ব্যাপক। বাংলাদেশি জনগণ আদিকাল থেকেই ছিলো কৃষি উপজীব্য। সেই বাংলাকেই তারা বেছে নিয়েছিল ‘নীল’ চাষের উপযুক্ত ক্ষেত্র হিসেবে। তাই ১৭৭৭ সালে ব্রিটিশ সরকার বাংলায় নীল চাষের জন্যে কিছু উদ্যোগ নিয়েছিলো। সেই সময় লুই বোনার্ড নামক একজন ফরাসি বণিকের মাধ্যমে আধুনিক পদ্ধতিতে বাংলায় নীল চাষের প্রচলন ঘটে। নীল চাষের ব্যাপকতায় নিয়মিত খাদ্য উৎপাদনে মারাত্মক ঘাটতি দেখা দেয়ায় ১৮৫৯ সালে সংঘটিত এক কৃষক বিদ্রোহ নীলকর সাহেবদের বিরুদ্ধে রুখে দঁাড়ায়। এটিই ঐতিহাসিক ‘নীল বিদ্রোহ’ নামে পরিচিত। ১৮৫৭ সালের ৮ এপ্রিল ভারতীয় ব্রিটিশ সৈনিক মঙ্গলপান্ডে ব্রিটিশ বিরোধেী যুদ্ধের প্রথম শহিদ। উদগ্র এবং নিখাদ দেশপ্রেমের তাগিদে কলকাতার ব্যারাকপুরের প্যারেড ময়দানে তঁার সহযোগী ঈশ্বরী পান্ডেকে সাথে নিয়ে একজন ইংরেজ অ্যাডজুটেন্ট এবং একজন ইংরেজ সার্জেন্ট মেজরকে তলোয়ারের আঘাতে পরলোকে পাঠিয়ে দেন। পরে এই দুই ভারতবাসী বিপ্লবীকে ফঁাসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছিল। বিদ্যুৎ গতিতে এ খবর বীর প্রসবিনী চট্টলায় পেঁৗছার পরপরই ব্রিটিশ সিপাহীদের মধ্যকার ভারতীয় হাবিলদার রজব আলীর নেতৃত্বে ৩৪নং রেজিমেন্টে সিপাহি বিদ্রোহ ঘোষিত হলো। বেগতিক অবস্থা দেখে ইংরেজ সৈন্যরা নিরাপদ আড়ালে চলে গেলো। কালান্তরে কলতাকায় তরুণ ব্যারিস্টার প্রমথ নাথ মিত্রের উদ্যোগে বাংলায় প্রথম ব্রিটিশ বিরোধী বিপ্লবী দল ‘অনুশীলন সমিতি’ গঠিত হয়। এখানে বিপ্লবীদেরকে লাঠিখেলা-অসিখেলা-ছোরা খেলা-কুস্তি খেলা-মুষ্টিযুদ্ধসহ নৈতিকতার মূল্যবোধেরও শিক্ষা দেওয়া হতো। ক্রমে ক্রমে সমগ্র ভারতবর্ষ এই প্রত্যক্ষ বিপ্লবী মন্ত্রে দীক্ষিত হয়ে অনুরূপ ‘অনুশীলন সমিতি’ গঠন করে ফেলেছিলো। ফলে ভারতে ব্রিটিশ বিরোধী বিপ্লবী আন্দোলনে উল্লেখযোগ্য ত্বরণ সৃষ্টি হয়েছিলো।

এদিকে পরাধীন ভারতে কেন্দ্রীয় নেতৃত্বে থাকা সর্বজনাব জওহেরলাল নেহেরু, সুভাষ চন্দ্র বসু, মাওলানা আবুল কালাম আজাদ প্রমুখ ভারতে জাতীয়তাবাদী আদর্শে বিশ্বাসী ছিলেন। অর্থাৎ ভারতে বিভিন্ন ধর্মীয় সম্প্রদায় থাকা সত্ত্বেও স্বাধীন ভারতে জাতি থাকবে একটাই আর তাহলো : ‘ভারতীয়’। কিন্তু এক পর্যায়ে মতান্তরের কারণে জওহেরলাল নেহেরু এবং মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর দ্বি-জাতি তত্ত্বের সাথে সহমত পোষণ করেন। (সূত্র: বাংলাদেশ প্রতিদিন ৫ জুলাই ২০২৫) এতেই ধর্ম ভিত্তিক দুটি স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনের বীজ উপ্ত হয়ে সৃষ্টি হয়ে গেলো ভারত এবং পাকিস্তান। অমীমাংসিত রয়ে গেলো কাশ্মির এবং ভারত সংলগ্ন পূর্ব পাকিস্তানের সীমান্তের কিয়দংশ, যা বর্তমানের স্বাধীন বাংলাদেশ।

এতেই ভারতে ব্রিটিশ শাসনের মূলভিত্তি ‘জাতিগত বিভাজনে দেশ শাসন’ প্রলম্বিত হয়ে গেলো এবং এদেশের ব্রিটিশ শাসকরাই অতলান্ত সন্তুষ্টিতে সিক্ত হয়েছিলো।

কালান্তরে গান্ধীর অসহযোগ আন্দোলন, অহিংস গণআইন অমান্য আন্দোলন বা ভারত ছাড় আন্দোলনগুলো বাংলায় প্রচলিত প্রবাদ ‘মিষ্টি কথায় চিড়া ভিজে না।’ এসব অবান্তর আবেদন-নিবেদনে অখণ্ড ভারত স্বাধীন করা যাবে না নিশ্চিত জেনে দুর্নিবার বেগে সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলনের পথ বেছে নেন সুবাস চন্দ্র বসু এবং চট্টলার বীর সন্তান মাস্টার দা সূর্য সেন। তারা সবকিছু পুঙ্খানুপুঙ্খ পর্যালোচনায় এই সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে, এই ভারতমাতার মুক্তির পথটি খুবই বন্ধুর অথচ পূর্ব দিগন্তে স্বাধীনতার রক্তিম তপনোদয় উঁকিঝুঁকি মারছে। এদিকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের চলমান গতিতে বিভিন্ন সেক্টরে ব্রিটিশ শাসকেরা বেকায়দায় পতিত হয়েছিল, ঠিক সেই মুহূর্তেই সুবাস চন্দ্র বসুর ‘আযাদ হিন্দ ফোর্সের’ ভারত সীমান্তে আগমন-কলকাতায় বিনয়-বাদল-দীনেশদের রাইটার্স বিল্ডিং আক্রমণ-চট্টগ্রামে ব্রিটিশ অস্ত্রাগার লুণ্ঠন-সমসাময়িক কালের আরো অনেক উল্লেখযোগ্য সশস্ত্র আক্রমণের মধ্যে অন্যতম হলো মহাবিপ্লবী ক্ষুদিরাম বসু এবং প্রফুল্ল চাকী ব্রিটিশ ম্যাজিস্ট্রেট কিংসফোর্ডকে গুপ্ত হত্যার জন্যে বোমা ছুড়েছিলেন। কিন্তু লক্ষ্যভ্রষ্ট হওয়ার কারণে উভয়ে ধরা পড়ে যান। ফলে মাত্র ১৮ বছর বয়সে বিপ্লবী ক্ষুদিরাম বসুকে ফঁাসিতে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়, আর প্রফুল্ল চাকী আত্মহত্যা করেছিলেন। একটা ঐতিহাসিক সত্য হলো যে, চট্টগ্রামের সূর্য সন্তান সূর্যসেন (মাস্টার দা) একজন শীর্ণদেহী স্কুল শিক্ষক তঁার সুযোগ্য সহযোগীদের সহায়তায় ভারতের বিপ্লববাদী আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক হয়ে চট্টগ্রামে ব্রিটিশ অস্ত্রাগার লুণ্ঠন এবং কয়েক দিনের জন্যে হলেও ব্রিটিশ শাসনকে চট্টগ্রাম এলাকা থেকে নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছিলেন। এ কৃতিত্ব খাটো করে দেখার কোনো অবকাশই নেই। অখণ্ড ভারতের স্বাধীনতার জন্যে এ এক অনন্য অবদান। এ বিপ্লবে সর্বমোট ৬৫ জন বিপ্লবী ছিলেন। সেই অখণ্ড ভারত আজ ত্রিখণ্ডিত। এসব বিপ্লবী যথাযোগ্য সম্মানে ভূষিত করার দায়িত্ব এই ত্রিখণ্ডিত দেশগুলোর এর ব্যত্যয় নিশ্চয়ই কৃতঘ্নতার সামিল।

ইতিহাস এর জ্বলন্ত সাক্ষী। ব্রিটিশ ভারতে যে সমস্ত পাশবিক অত্যাচার এবং নিপীড়ন হয়েছিল তাদের মধ্যে প্রথমত জালিয়ানওয়ালা বাগের হত্যাকাণ্ড, যেখানে তাৎক্ষণিক দু সহস্রাধিক গণহত্যা এবং ছিয়াত্তরের কৃত্রিম মন্বন্তরে এক তৃতীয়াংশ ভারতবাসীর মর্মান্তিক মৃত্যুর ঝংকারে আজও ভারতের আকাশ বিষাদে ভারী হয়ে যায়। তন্মধ্যে আমাদের এই স্বাধীন বাংলাদেশটি অন্যতম। এখানে মুক্ত জ্ঞান চর্চায় মূলোৎপন্ন জাত অভিব্যক্তি অপরিহার্য। অন্যথায় বাংলাদেশের শুভাশুভ অনিশ্চিত। নীতিগত জাতীয়তাবাদে দুটি ধারাই স্পষ্ট, প্রথমটি রাষ্ট্রীয় পরিচিতি আর দ্বিতীয়টি ধর্মীয় পরিচিতি। প্রথমোক্তটি সমধর্মী অর্থাৎ সরকার কোনো ধর্মকেই সমর্থন করে না এবং ধর্ম পালনে স্বাধীনতা অবাধ। আবার দ্বিতীয়টিতে শুধুই রক্তারক্তির হানাহানি। যে-সব দেশে শান্তির চির বসন্ত বিরাজমান তাদের মধ্যে নিশীথ সূর্যের দেশ নরওয়ে-ইউরোপের ক্রীড়া ভূমি সুইজারল্যান্ড-অপার সৌন্দর্য মণ্ডিত ‘নায়াগ্রা জলপ্রপাত’ বেষ্টিত রয়েছে কানাডা ও যুক্তরাষ্ট্রের সীমান্তে। আবার পৃথিবীতে প্রথম সূর্যোদয়ের দেশ ‘জাপান’ প্রচলিত আছে ‘শিন্তৌ ধর্ম’, যার মর্মবাণী হলো বর্তমান এবং অতীতের মধ্যে নৈতিক যোগসূত্র স্থাপন করা, ইত্যাদি।

এই বঙ্গীয় সন্তানরা অসম সাহস-তড়িত হয়ে দু শ’ বছরের ব্রিটিশ অপশাসনের করাল গ্রাস থেকে মুক্ত এবং তেইশ বছরের পাক গোলামির হাত থেকে বাংলাদেশকে মুক্ত করার দুর্দমনীয় প্রয়াস, আবার ১৬ বছরের দ্বি-চারিতা যুক্ত শাসন থেকে মুক্ত করেছে ঠিকই। কিন্তু একটা কুচক্রীমহল চূড়ান্ত লক্ষ্যে পেঁৗছার পথে দুর্ভেদ্য পিচ্ছিলতা এনে দিয়েছে সর্বস্তরে সৃষ্টিশীল শিক্ষার অপূর্ণতার অভিশাপ। এটা বাংলার দুরন্ত যুবকদের কাছে অবশ্যই সহজবোধ্য। যাহা অবশ্যই অহিংস পথে প্রতিবিধানযোগ্য। পলি উর্বর এই বাংলায় সাম্প্রদায়িকতা চাষাবাদ নিপাত যাক।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়