সোমবার, ০৪ আগস্ট, ২০২৫  |   ২৮ °সে
জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয় অন্যান্য

প্রকাশ : ০৪ আগস্ট ২০২৫, ০৮:৩৭

খণ্ডে খণ্ডে অখণ্ড জীবন

পীযূষ কান্তি বড়ুয়া
খণ্ডে খণ্ডে অখণ্ড জীবন

(সঁাইত্রিশতম পর্ব)

আমার পাঠবিশ্ব ও জীবনের মধু : তখনকার আমলে একটা রীতি ছিলো নবজাতককে মধু খাওয়ানোর। এখনও দুয়েকটা জায়গায় দেখা যায়। এতে দুটো উদ্দেশ্য থাকতো। প্রথমত তাকে মিষ্টিমুখ করিয়ে ধূলিধূসরিত জীবনে বরণ করে নেওয়া আর দ্বিতীয়ত অনেকেরই মতে মাতৃজঠরে গিলে নেওয়া ময়লাগুলো মধু-মাধুর্যে পরিষ্কার করার প্রয়াস। এর বাইরে আরও একটা আকাঙ্ক্ষা ছিলো এতে। যাতে নবজাতকের মুখের কথা কর্কশ না নয়, মধুর মতো মিষ্টি হয়। এ কারণে বড়ো বেলায় কেউ ঝগড়া-ঝাটিতে লিপ্ত হয়ে কড়া বা কর্কশ কথা বললে তার প্রতিপক্ষকে বলতে শোনা যায়, ‘ জন্মের সময় তোকে মধু খাওয়ায়নি?’ আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞান কিন্তু নবজাতকের মুখে মধুর রীতিকে সমর্থন করে না। এই পৃথিবীতে নবজাতকের প্রথম আহারই হবে মায়ের বুকের শাল দুধ। কারণ এতে আছে অশক্ত অবল শিশুর জন্যে জীবাণুর বিরুদ্ধে লড়ে যাওয়ার রোগ প্রতিরোধকারী অ্যান্টিবডি এবং প্রয়োজনীয় উপাদান। শাল দুধ বা কোলোস্ট্রামের একটা বিরেচনকারী প্রভাবও আছে যা শিশুর মল ত্যাগকে সহজ করে দেয়। অবশ্যই জন্মের অব্যবহিত পরেই মাতৃস্তন্যে আমাকে স্বাগত জানানো হয়েছিলো, তাতে কোনো ভুল নেই। কিন্তু আমাকে মধু খাওয়ানো হয়েছিলো কি না সে বিষয়ে আমি অবগত নই। তবে সত্যিকারের মধু আমি পেয়েছি আমার পাঠবিশ্ব থেকে। আমার শৈশবে এখনকার মতো বই পাওয়া সহজ ছিলো না। তারপরও কোনো বই পেলে তার পাঠোত্তর মধু আস্বাদন করা আমার জন্যে অগ্রাধিকারের কাজ ছিলো। বাসায় পত্রিকা বানান করে করে পড়তে পড়তে তৈরি হয় আমার পাঠবিশ্ব। স্কুল ফেরত ক্ষুধার্ত অলস দুপুর কাটতো বড়ো বা ছোট ভাইবোনদের ক্লাসের বাংলা ও ইংরেজি সহপাঠ বই পড়ে পড়ে। আদু ভাই কিংবা আবু বেন আদমের কথা আমার পাঠ্য বইয়ে আমি পাইনি। এগুলো পড়েছি বড়ো ভাইবোনদের বই থেকে। তেমনি ইদু মিয়ার মোরগ, কাজল রেখা বা হীরামন নামের গল্পগুলোও পড়া হয়েছে বড়ো ভাইবোনদের ক্লাসের বই থেকে। বার বার একই ক্লাসে ফেল করা আদু ভাই নিজের ছেলের সাথে পাস করে সেভেন থেকে এইটে ওঠার পর মারা গেলো। তঁার কবরে রচিত হলো এপিটাফ। ‘এখানে ঘুমায় আদুভাই, যে ক্লাস সেভেন থেকে ক্লাস এইটে উত্তীর্ণ হয়েছিলো।’ আবুল মনসুর আহমদের এই গল্পটা আমার মনে বিশেষ এক জায়গা করে নিয়েছে। নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের লেখার বদৌলতে এখনও কোনো মোরগকে ককরেঁা কক করে ডাকতে শুনলে ইদু মিয়ার মোরগের কথা মনে পড়ে যায়। তার বউয়ের ভাষায় এ মোরগের ওপর যমেরও অরুচি ছিলো। স্কুলে পৃথ্বীজিতের কাছে পেতাম ইন্দ্রজাল কমিকসের বইগুলো। বেতাল এবং ম্যানড্রেক পড়ে পড়ে মনের মধ্যে তৈরি হয়েছিলো ফ্যান্টাসির এক আশ্চর্য জগত। শরৎ চন্দ্রের ‘দত্তা’ এসে আমাকে পাকিয়ে তুললো ভাবনায়। নিজেকে নরেন ভাবতে ভাবতেই বড়ো হয়ে উঠি। ‘পথের দাবী’র সব্যসাচী নয়, আমার মন টেনেছিলো অপূর্ব। ভারতীর সাথে তার মনের সংযোগ আমার আকর্ষণের মূল কেন্দ্রবিন্দু ছিলো। ‘পথের দাবী’ পড়তে গিয়ে আমার মনে হলো সব্যসাচী যেন সূর্যসেন। অর্থাৎ আমাদের নোয়াপাড়ার মাস্টারদাকে ফুটিয়ে তুলেছেন ‘মহেশ’-এর শরৎ। ভারতীর মধ্যে প্রীতিলতা তথা রানিদিকেই জীবন্ত হতে দেখেছি। স্কুলের পাঠ্যে ‘মেজদিদি’ এবং কলেজের পাঠ্যে ‘বিলাসী’কে পেয়ে শরৎকে পড়ার অভিপ্রায় আরও গাঢ় হলো। বনফুলের ছোটগল্পেই সত্যিকারের মানুষের দেখা পাই। ‘মানুষের মন’ গল্পে নরেশ ও পরেশ দুভাই যেভাবে রুগ্ন ভ্রাতুষ্পুত্র পল্টুর জীবন বঁাচাতে ধর্ম ও বিজ্ঞানকে পাশাপাশি রেখে চলেছে, তাতে মনে হয়েছে ধর্ম এখানে বিভেদ তৈরি করেনি বরং ভক্তি ও বিশ্বাস এখানে তৈরি করেছে মিলনের সেতুবন্ধ। হায়াত মামুদের ‘ছোটদের রবীন্দ্রনাথ ‘ দিয়ে রবীন্দ্রনাথকে জানা শুরু হলেও রবীন্দ্রনাথকে ভালোভাবে জেনেছি ‘আমার ছেলেবেলা’ দিয়ে। গল্পগুচ্ছের গল্পগুলো পড়তে পড়তে একসময় মনে হতো মানুষের মনে মনে ঢুকে রবীন্দ্রনাথ কীভাবে সবার কথা বের করে আনে? নজরুলকে ভালোভাবে জেনেছি তঁার কবিতা বা গানে নয়, বরং অভিভাষণে। প্রথম গোয়েন্দা উপন্যাস পড়া হয়েছিলো শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘ঝিন্দের বন্দী’। নীহার রঞ্জন গুপ্তের গোয়েন্দা বইতে আদ্যাক্ষর বড়ো করে লেখা ‘ বন্দীকে উদ্ধার কর’ চিরকুটে কী রোমাঞ্চই না লেগেছিলো। নাম না জানা এক উপন্যাসের নায়কের নাম ছিলো মলিন মুখোপাধ্যায়, যে কি না নিজে মেধাবী শিক্ষার্থী হওয়ার পরও অর্থ ও কৌতূহলের কারণে পত্রিকায় অশিক্ষিত পাত্র চেয়ে দেওয়া বিজ্ঞাপনে আকৃষ্ট হয়। দিনশেষে তার প্রেমচঁাদ রায়চঁাদ বৃত্তি পাওয়ার মাধ্যমে জানা যায়, মলিন আসলে অশিক্ষিত নয় বরং বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চ শিক্ষিত মেধাবী যুবক। এ উপন্যাসটা পড়ার পর কিশোর মনে মলিন হওয়ার সাধ জেগেছিলো বেশ। গ্রীক মিথোলজি নিয়ে একটা বই হাতে পড়েছিলো যার নাম ‘প্রতীচ্য পুরাণ’। লেখক ফরহাদ খান। সব গ্রীক দেবদেবীদের সাথে ভালোই পরিচিত হলাম বইটা পড়ে। হুমায়ূন আজাদের লাল নীল দীপাবলী আমাকে উদ্বুদ্ধ করেছে বাংলা ভাষাকে জানতে। আরও বড়ো হলে পরে তঁারই বই ‘ নারী’ এবং ‘পাক সার জমিন সাদ বাদ’ পড়ার সুযোগ হয়। বইগুলো আমার রুচিতে সমৃদ্ধি এনে দেয়। সমরেশ মজুমদারের সিকুয়েল বই উত্তরাধিকার, কালবেলা ও কালপুরুষ পড়ে অনিমেষকে নিয়ে ভাবিত হই। তবে অর্ক ও মাধুরী তেমন টানেনি আমাকে। ম্যাক্সিম গোর্কির ‘মা’ পড়ার পরে মনে হলো ‘কাল্পুরুষ’ বইটি বোধ হয় ‘মা’ দ্বারা অনুপ্রাণিত। স্থান-কাল-পাত্রের ভিন্নতা ব্যতীত কাহিনী একই। ম্যাক্সিম গোর্কির পাভেল ও তার মা এবং সমরেশের অর্ক ও তার মায়ের মধ্যে কোনো ব্যবধান আমি খুঁজে পাইনি। ‘গর্ভধারিণী’র জয়িতারা আমাকে অতোটা ভাবায়নি যতোটা ভাবিয়েছিলো সমরেশের উপন্যাসিকা ‘শরণাগত’। ‘সাতকাহন’-এর দীপাবলি এক পর্যায়ে আমাকে বিরক্ত করে ছেড়েছে, যেখানে সেখানে অধিকার ও স্বাধীনতার কথা বলে। স্বামী ভালোবেসে আইসক্রিম আনলেও সেখানে নিজের পছন্দ-অপছন্দ জুড়ে দিয়ে দীপাবলী প্রেমকে অফিসিয়াল কর্মে পরিণত করতে চেয়েছে। এ যেন অনেকটা সেই চুটকির মতো : যে ঘরে রং চা খায় সে ঘরকে আমার অফিস অফিস মনে হয়। সমরেশ বসুর ‘বিবর’ কিংবা ‘প্রজাপতি’ বড়োদের হলেও কৈশোরে তার স্বাদ নিতে কেউ বাধা দেয়নি। বিভূতি ভূষণকে ক্লাস এইটে জেনেছি ‘মাঠের পারের দূরের দেশ’ গল্প দিয়ে। এটা ছিলো ‘পথের পঁাচালি’র অংশ বিশেষ। পরে একটানে মূল ‘পথের পঁাচালি’সহ ‘অপরাজিত’ এবং ‘অপুর সংসার’ পড়া হয়ে যায়। পাঠশেষে এটাই বুঝি, ‘পথের পঁাচালি’-তেই সীমাবদ্ধ থাকলে ভালো হতো। বিভূতি ভূষণের ‘আরণ্যক’ আমাকে ভাষার উৎকর্ষ দান করেছে। সাথে ভাবনারও। বুদ্ধদেব গুহর পত্রোপন্যাস ‘সবিনয় নিবেদন’ পড়ে বেশ রোমাঞ্চিত হয়েছি। নায়িকা ঋতিকে নায়ক রাজর্ষির লেখা প্রতিটা পত্র মনে হতো আমিই লিখেছি। বুদ্ধদেব গুহর ‘মাধুকরী’ও খারাপ লাগেনি। শীর্ষেন্দুর ‘দূরবীন’ নয় ‘পার্থিব’ই আমাকে ভাবিয়েছে। একই লেখক কীভাবে তিনটি প্রজন্মকে একই তালে তুলে আনতে পেরেছেন তা ভেবে। সুনীলের ‘ছবির দেশে কবিতার দেশে’ পড়ে ফরাসী সভ্যতার ঘ্রাণ যেন আমিও গায়ে মেখে নিয়েছি। ‘পূর্ব-পশ্চিম’ বা ‘সেই সময়’-এর চেয়ে আমাকে সমৃদ্ধ করেছে ‘প্রথম আলো’ বেশি। ভূমিসূতো আর ভরতকে জানতে জানতে কীভাবে পট পট করে রাজা বীর চন্দ্র মাণিক্য, রবীন্দ্রনাথ, ঈশ্বরচন্দ্র এবং বিবেকানন্দরা এসে পড়ছেন পাঠের আওতায় তা বলবার মতো নয়। শংকরের ‘ছেলেবেলার বন্ধু’ আমাকে শৈশবের অর্ধজানা প্রবাদগুলো পুরোপুরি জানিয়েছে। যেমন : আগে জানতাম শুধু ‘খোদার অজানা পাপ নাই’। পরে শংকরই আমাকে জানালো, পরের লাইনটা : মায়ের অজানা বাপ নাই। তারাশঙ্করের ‘কবি’ আমার পড়া অন্যতম মর্মস্পর্শী উপন্যাস। কবিয়াল ও ঝুমুর দলের কথাগুলো এখনও কানে বাজে। বিমল মিত্রের ‘কড়ি দিয়ে কিনলাম’-এর চেয়ে ‘বেগম মেরি বিশ্বাস’-এ আমার স্বাচ্ছন্দ্য ছিলো বেশি। মানিকের অতসীমামী কিংবা প্রাগৈতিহাসিক আমাকে ভাবিয়েছে অনেকদিন। তঁার ‘পদ্মানদীর মাঝি’ ইলিশের প্রতি আকৃষ্ট করেছে আরও বেশি। হর্ষ দত্তের ‘ময়ূরাক্ষী তুমি দিলে’ পড়ে ঘোরের মধ্যে ছিলাম বেশ কিছুদিন। সুচিত্রা ভট্টাচার্যের ‘কাছের মানুষ’ কিংবা বাণী বসুর ‘ মৈত্রেয় জাতক’ আমার জন্যে বিশেষ পাওয়া। ‘কাছের মানুষ’-এ ইন্দ্রাণীকে ইনু, তনুময় বোসকে তনু বলে ডাক পেড়ে দূরের মানুষকে হৃদয়ে টেনে নেওয়ার কৌশল বেশ যুৎসই। ইন্দ্রাণী নামটাকে ছেঁটে মায়ের ইনু, স্বামীর ইন্দু, প্রেমিকের রাণী, কিংবা ছাত্রীদের ইন্দ্রাণী দিদিমণি ডাকে বুঝা যায় একই ব্যক্তি তার বিভিন্ন স্তরে কীভাবে সম্বোধনে আদৃত হন। শওকত ওসমানের ‘ক্রীতদাসের হাসি’র চেয়ে জননীকে অধিক মর্মজয়ী মনে হয়েছে। তেমনি হুমায়ূন আহমেদের ‘নন্দিত নরকে’র মতন তঁার আর কিছু ওরকম মনে দাগ কাটেনি বলা যায়। আল মাহমুদের ‘জলবেশ্যা’, সৈয়দ শামসুল হকের ‘লাল গোলাপ’, শওকত আলীর ‘উত্তরের খেপ’, আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের ‘খোয়াবনামা’ এবং ‘চিলেকোঠার সেপাই’ আমার কাছে ছিলো অমৃতসম।

নিসর্গ মেরাজ চৌধুরীর পাল যুগের নালন্দাকে নিয়ে ইতিহাস আশ্রয়ী উপন্যাস ‘মাৎস্যন্যায় ‘ বইটিও আমার মনে জমা আছে একটি উৎকৃষ্ট সৃজনশস্য হিসেবে। একই ধঁাচের বই হলো সন্মাত্রানন্দের ‘নাস্তিক পণ্ডিতের ভিটা।’ এর পাশাপাশি বিক্রম শেঠের ‘অ্যা সুইটেবল বয়,’ অরুন্ধতী রায়ের ‘গড অব স্মল থিংস’ বইগুলোও কিছুটা মন কেড়েছে।

ডোমিনিক লাপিয়েরের ‘সিটি অব জয়’ যা অনুবাদে হয়েছে ‘আনন্দ নগরী’, চার্লস ডিকেন্সের ‘টেল অব টু সিটিজ’ বইগুলোর পাঠ আমাকে তিল তিলে গড়ে তুলেছে। ‘ভিঞ্চি কোড’ উপন্যাসটি যেমন ভয়ঙ্কর তেমনি রোমাঞ্চকর। হ্যারিয়েট বিচারের ‘আঙ্কল টম’স কেবিন’ বইটি পড়েই মূলত মার্কিনীদের দাসপ্রথাকে জানি, যা অ্যালেক্স হ্যালির ‘দ্য রুটস্’-এর মাধ্যমে আরও পোক্ত হয়। রাহুল সাংকৃত্যায়নের ‘গঙ্গা থেকে ভোল্গা’, হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর ‘বৌদ্ধ যুগের ভারত’, কারেন আমস্ট্রংয়ের ‘বুদ্ধ’ বইগুলো মননকে গড়ে তুলেছে অবিসংবাদিতভাবে।

আবুল মনসুর আহমদের ‘আয়না’, সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর ‘নিরাশ্রয়ী গৃহী ও অন্যান্য প্রবন্ধ’ বই দুটি চিন্তার গভীরতা এনে দিয়েছে। গণিত নিয়ে ইয়ো প্যারেলম্যানের বই কিংবা স্টিফেন হকিংসের ‘অ্যা ব্রিফ হিস্টরি অব টাইম’ আমার বিজ্ঞান মনস্কতাকে উস্কে দুয়েছে আরও বেশি। এই ভাবনার শেকড় যিনি গেঁড়ে দিয়েছেন তিনি আরজ আলী মাতুব্বর। তঁার ‘সত্যের সন্ধান লৌকিক দর্শন’ সত্যিকার অর্থেই সাধারণকে বিজ্ঞানপন্থী হয়ে উঠতে প্রভাবিত করে। আমার মায়ের দেওয়া ‘ত্রিপিটক’ গ্রন্থটি আমাকে শুধু জ্ঞানচর্চায় উদ্বুদ্ধই রাখেনি বরং তথাগতকে জানার জন্যে আরও আয়াস সহ্য করার শক্তি দিয়েছে। নাগার্জুনের ‘মিলিন্দ প্রশ্ন’ পড়তে পড়তে তৎকালীন মানুষের জ্ঞান সাধনার স্তরের একটা সুস্পষ্ট পরিমাপ করার সুযোগ পেয়েছি।

‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ বইটিও আমার পড়া সেরা বইয়ের অন্যতম। পুরো একটা সময়কে একজন রাজনীতিকের দৃষ্টিতে দেখার সুযোগ হয়েছে। বাংলাদেশের জন্মপূর্ব সময়ের যে মহাকাব্যিক পর্যায়কে এ বইটাতে ধরা হয়েছে তা অনন্য ও অসাধারণ। বইটির বড়ো বিশেষত্ব হলো লেখক নিজেকে মহান করার জন্যে বইটি রচনা করেননি। বরং ঘটনার পরম্পরাকে তিনি ইতিহাস ও রাজনীতির মিশেলে লিপিবদ্ধ করে গেছেন একজন নিয়তি নির্ধারিত কথক হিসেবে। বইটিতে প্রবাদ ও বাগধারার ব্যবহার লক্ষণীয়, যা ভাষার সাবলীলতাকে অটুট ও বিস্তৃত করেছে। এছাড়াও বিতর্ক কিংবা লেখালেখি, প্রাতিষ্ঠানিক কিংবা পেশাগত অধ্যয়নের প্রয়োজনে যেসব বইয়ের পাঠ আমার মনে-শোণিতে মিশে আছে তাদের কথা নাইবা বললাম।

যত বই পড়েছি, সকল বইয়ের সেরা বই আমার কাছে রাম সুন্দর বসাকের ‘আদি বাল্যশিক্ষা’। প্রতিটি বাক্য যেন হাজার বছর গবেষণা করে লেখা। এ বইটা যতোটা না পাঠ্য হিসেবে পড়েছি তার চেয়ে বেশি পড়েছি আবিষ্কারের নেশায়। পরের পাতার কী আছে, তার পরের পাতায় কী আছে তা জানতে। আরেকটা বই আমার মননকে পুষ্ট করে আছে সেই কৈশোরত্তীর্ণ তারুণ্য হতে। বইটির নাম ‘শেষের কবিতা’। দুজন মননশীল মানুষের জীবনধারা কেমন হওয়া উচিত তার একটা আকরগ্রন্থ হচ্ছে ‘শেষের কবিতা।’

জীবনজুড়ে পাঠক আমি, আমার পাঠবিশ্বে কোনো বিশেষ লেখক বা কোনো বিশেষ বই নেই। গোগ্রাসে গিলতে গিলতে যেটাকে মনের মধ্যে আটকাতে পেরেছি সেটাই কলমে উঠে এসেছে। জীবনের এই মধুর সরোবর আমার মননের সমৃদ্ধিতে বৃদ্ধি ও বিকাশের হরমোনের মতো। পাঠ্যের জগত কতো বিশাল ও ব্যাপক! এই মধুময় গাঙে কত জীবন পার হলে সমস্ত অমৃত মন্থন করা যাবে তা কে আর বলতে পারে! (চলবে)

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়