শনিবার, ১৯ জুলাই, ২০২৫  |   ৩২ °সে
জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয় অন্যান্য

প্রকাশ : ১৯ জুলাই ২০২৫, ০১:৫৩

তুলার মতো ভালোবাসা

উজ্জ্বল হোসাইন
তুলার মতো ভালোবাসা

শহরের এক কোণে ছোট্ট একটি ফ্ল্যাটে থাকে হৃদয় ও হৃদিতা। ৪ বছরের দাম্পত্যজীবন পেরিয়েছে তাদের। সংসারটা খুব জমকালো কিছু না, তবে গুছানো। বাইরে থেকে দেখে কেউ বলবে না, এ সংসারে কখনও ঝড় আসে। অথচ, প্রতিটি শান্ত নদীর নিচেই কিছু না কিছু ঢেউ লুকিয়ে থাকে।

হৃদয় একজন সাধারণ বেসরকারি কর্মচারী। প্রতিদিন সকালে উঠে গুছিয়ে অফিসে যায়, ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা হয়ে যায়। হৃদিতা গৃহিণী, সংসারটাই তার জগৎ। কিন্তু তার চোখে-মুখে, হঁাটায়-চলায় একটা স্থিরতা, যেন একটা আশ্রয়ের মতো সে।

সন্ধ্যাবেলা, ঘরে ফেরার পর হৃদয় একটু চুপচাপ হয়ে থাকে আজকাল। হৃদিতা বুঝতে পারে কিছু একটা ভাবছে হৃদয়। কিন্তু সে জোর করে কিছু জিজ্ঞেস করে না। সে জানে, একজন মানুষ তখনই নিজের কথা খুলে বলে, যখন সে নিজেকে নিরাপদ ভাবে।

একদিন রাতের খাবার পর হৃদয় বলল,

Ñহৃদিতা, তোমাকে একটা কথা বলতে চাই।

হৃদিতা থেমে তাকাল,

Ñবলো, মন খারাপ কেন এতদিন ধরে?

হৃদয় একটু মাথা নিচু করে বলল,

Ñঅফিসে বদলি হবে। ঢাকা। অন্তত তিন বছরের জন্য।

হৃদিতা চুপচাপ শুনে বলল,

Ñআমি কি তোমার সঙ্গে যেতে পারি?

হৃদয় অবাক হলো।

Ñতুমি চাইলেই পারো। কিন্তু তোমার বাবা-মা এখানে, তুমি কি ওদের ছেড়ে যেতে পারবে?

হৃদিতা হেসে বলল,

Ñআমি ওদের ছেড়ে যাচ্ছি না, আমি তোমার সঙ্গে যাচ্ছি। ওরাও জানে, আমার ঠিকানা এখন তুমিই।

এই ছোট্ট কথাটার ভেতরে যেন এক পৃথিবী ভালোবাসা ছিল। হৃদয় আর কিছু বলল না। শুধু হৃদিতার হাতটা নিজের হাতে নিলো। সেই রাতে দুজন একসাথে অনেক কথা বলল, অনেক স্বপ্ন অঁাকল।

নতুন শহর, নতুন জীবন

ঢাকা নতুন শহরে এসে তারা আবার সংসার শুরু করল। শুরুতে কিছুটা অচেনা লাগলেও ধীরে ধীরে সেটাই তাদের নতুন ঠিকানা হয়ে গেল।

হৃদিতা নতুন জায়গা মানিয়ে নিতে একটু কষ্ট করলেও কখনো হৃদয়কে বুঝতে দেয়নি। তার চোখে মুখে সবসময় একটা হাসি, যা হৃদয়কে সাহস যোগায়।

একদিন হৃদয় অফিস থেকে ফিরে ক্লান্ত হয়ে এসে দেখল, হৃদিতা আজ একটু বিবর্ণ।

Ñকী হয়েছে তোমার? অসুস্থ নাকি?

হৃদিতা মৃদু হেসে বলল,

Ñনা, শরীরটা একটু দুর্বল লাগছে। কিছু নয়।

কিন্তু হৃদয় ঠিক বুঝে ফেলল, কিছু একটা ঠিক নেই।

পরের দিন ডাক্তার দেখিয়ে জানা গেল, হৃদিতা মা হতে চলেছে।

হৃদয় চোখের কোণে জল নিয়ে হৃদিতাকে জড়িয়ে ধরল। সেই মুহূর্তে পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ যেন হৃদয়।

চোখের জলে ভালোবাসা

গর্ভাবস্থায় হৃদিতার শরীর খারাপ হতে লাগল। হরমোনের ওঠানামা, মানসিক চাপ, আর রাজধানীর গরম মিলে হৃদিতা প্রায়শই অসুস্থ হয়ে পড়ত। হৃদয় যতটা পারত, অফিস শেষে যত্ন নিত, রান্নাঘরে ঢুকত, ওষুধ মনে রাখত, রাতে উঠে পানি দিত।

একদিন মাঝরাতে হৃদিতার হঠাৎ ব্যথায় কুঁকড়ে উঠল। হৃদয় কোনো কিছু না ভেবে হৃদিতাকে নিয়ে ছুটল হাসপাতালে। তখন ভোর প্রায় ৩টা।

চিকিৎসকরা বললেন, কিছু জটিলতা দেখা দিয়েছে, হয়তো সময়ের আগে সন্তান জন্ম নিতে পারে।

হদয় সারারাত হাসপাতালের করিডরে বসে ছিল। একটানা প্রার্থনা করে গেছে। তার মাথায় একটাই কথাÑহৃদিতা যেন ঠিক থাকে।

শেষমেশ, সব ঠিকঠাকভাবে তাদের ছেলে সন্তান পৃথিবীতে এলো। ডাক্তার বলল, মা-মেয়ে দুজনই সুস্থ।

হৃদয় প্রথমবার মেয়েকে কোলে নিলো আর একফেঁাটা জল গড়িয়ে পড়ল গাল বেয়ে।

হৃদিতা তাকিয়ে বলল,

Ñহৃদয় আজ তুমি কঁাদছ?

হৃদয় হেসে বলল,

Ñভালোবাসা সবসময় হাসি দিয়ে প্রকাশ পায় না।

ছয় মাস পর একদিন দুপুরে হৃদিতা হঠাৎ বলল,

Ñতুমি কি জানো, আমার মা চাইছিল আমি যেন তোমাকে বিয়ে না করি?

হৃদয় অবাক হয়ে বলল,

Ñসত্যি? কেন?

Ñকারণ তুমি সেই সময় এতটা প্রতিষ্ঠিত ছিলে না। আর বাবা চাইছিল আমি একজন ব্যবসায়ী ছেলেকে বিয়ে করি।

হৃদয় চুপচাপ শুনে বলল,

Ñতাহলে তুমি কেন রাজি হলে আমার সঙ্গে?

হৃদিতা ধীরে বলল,

Ñকারণ ভালোবাসা সুবিধা দেখে না। আমি জানতাম, তুমি আমায় ভালোবাসো। আর আমি জানতাম, তুমি কখনো আমার পাশে থাকা ছেড়ে দেবে না।

হৃদয় তার দিকে তাকিয়ে বলল,

Ñতুমি চাইলে তখনই চলে যেতে পারতে।

হৃদিতা হেসে বলল,

Ñকিন্তু আমি তো তোমার তুলার মতো ভালোবাসা অনুভব করেছিলাম, যা কোথাও না কোথাও নিশ্চয়ই আশ্রয় দেবে।

ছোট্ট ছেলে এখন হঁাটতে শিখেছে। বাবা বলতে শিখেছে প্রথম, “বাবা”।

হৃদিতা একদিন হৃদয়ের গালে হালকা চুমু খেয়ে বলল,

Ñজানো, তুমি বদলে যাওনি একটুও।

হৃদয় হেসে বলল,

Ñবদলালে কি তুমি আমারই থাকতে?

হৃদিতা বলল,

Ñআমরা দুজনই বদলাইনি। কেবল ভালোবাসাটা সময়ের সঙ্গে আরও ঘন হয়েছে।

লেখক পরিচিতি: উজ্জ্বল হোসাইন, চাঁদপুর।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়