শনিবার, ১২ জুলাই, ২০২৫  |   ৩৩ °সে
জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয় অন্যান্য

প্রকাশ : ১২ জুলাই ২০২৫, ০৯:১২

লাল সাইকেল

মো. তাইয়্যেব হোসাইন
লাল সাইকেল

আমার জীবনের প্রথম প্রতারণা শিকার আমার আপন মামার কাছ থেকেই হলো। ছোটবেলা থেকেই আমি খুব সহজ-সরল ছিলাম। আমার জীবনের সব স্বপ্ন ও আশা ছিল একদিকে, আর আমার বাস্তবতা ছিল একেবারে আলাদা। আমার বয়স তখন খুব কম ছিল, কিন্তু আমার শখের বা পছন্দের জিনিসগুলো খুব ভালো করেই চিনতাম। তেমনি আমার সাইকেল চালানোর খুব শখ ছিল। যখন আমি দেখতে পেতাম, আমার বন্ধুরা তাদের সাইকেল চালাচ্ছে, তাদের মুখে হাসি এবং আনন্দে তারা ঘুরে বেড়াচ্ছে তখন আমার মন চুরমার হয়ে যেত। কিন্তু আমার জীবনে সাইকেল ছিল না। তাও যারা সাইকেল চালায়, তাদের আমি কখনো কাছে যেতেও পারতাম না। তাদের সাইকেল ধরাও আমার পক্ষে ছিল না, তাদের কেউই আমাকে সাইকেলের কাছে আসতে দিত না। তাই, সাইকেল চালানোর জন্য আমি শুধু স্বপ্ন দেখতাম, শুধু দূর থেকে দেখতাম।

একদিন, আমার মামা বিদেশ থেকে ফোন করলেন। আমার সাথে খুব একটা কথা হয়নি। তিনি খুব অল্প সময়ে বিদেশ থেকে বাড়িতে আসবেন, আর আমি প্রায়ই তার সাথে দেখা করার জন্য উদ্গ্রীব হয়ে থাকতাম। মামা বিদেশে থাকতেন, আর আমি জানতাম, মামা যখন দেশে আসবেন, তখন অনেক কিছু আনবেন, সবসময় এমনটা হতো। তিনি ফোনে জানতে চাইলেন, ‘কি লাগবে তোমার?’ আমি এক কথায় বলে দিলাম, ‘লাল রঙের সাইকেল চাই’। মামা হাসলেন এবং আবার প্রশ্ন করলেন, ‘আর কি কিছু লাগবে?’ আমি বললাম, ‘না, শুধু লাল রঙের সাইকেল চাই, আর কিছু চাই না।’

মামা কিছুদিন পরেই বাড়িতে এলেন। তখন আমি খুবই আনন্দিত ছিলাম, কারণ আমি জানতাম, মামা আসছেন, এবং তিনি আমার জন্য সাইকেল নিয়ে আসবেন। আমার সারা শরীর আনন্দে ভরে উঠেছিল। মামা যখন বাড়িতে এলেন, তখন ছোট এবং বড় দুটি কার্টুন দেখতে পেলাম। ছোট কার্টুনে চকলেট চুইংগাম নতুন নতুন জামা কাপড় আরো অনেক কিছু। বড় কার্টুনটি খুলে দেখা হলো, কিন্তু সেখানে আমার সাইকেল ছিল না। আমার মন ভেঙে গিয়েছিল, আমি নিজের কষ্ট ও অশ্রুসিক্ত মুখ লুকানোর জন্য আমার আম্মুর পাশে বসে চোখের জল লুকাতে লাগলাম। মুখটা ওড়নার ভেতরে ঢেকে রাখলাম যাতে কেউ আমার কান্না না দেখতে পায়। চোখের পাতা একটু নড়লেই অশ্রু গড়িয়ে পড়ছিল।

এই সময় মামা বললেন, ‘শিপে করে সাইকেল আসবে, কয়েকদিনের মধ্যে চলে আসবে। ১৭-১৮ দিনের মধ্যে আসবে’। আমার জন্য সেই অপেক্ষা ছিল এক অবিশ্বাস্য সময়। কিন্তু সময় কাটতে কাটতে ১৭ দিন, ১৮ দিন, আরও বেশি সময় পেরিয়ে গেল। তিন মাস হয়ে গেল, কিন্তু সাইকেল আসলো না। আমি আবারও মন খারাপ করে কান্না করতে শুরু করলাম। আমার মন আরও বিষণ্ন হয়ে উঠল, কারণ সাইকেল আসবে বলে মামা আমাকে আশ্বাস দিয়েছিলেন, কিন্তু কিছুই হয়নি।

এমন অবস্থায় ৩ মাস পরে মামা বিদেশে চলে গেলেন, কিন্তু যাওয়ার আগে আবারও আমাকে বললেন, ‘সাইকেল পরের বার নিয়ে আসব’। আমি তবুও পুরোপুরি বিশ্বাস করলাম, কারণ আমি জানতাম, মামা কখনো মিথ্যা বলেন না। যদিও সাইকেল আসেনি, তবুও মামার কাছ থেকে যে ভালোবাসা, সহানুভূতি, এবং স্নেহের বার্তা পেয়েছিলাম, তা আমার জীবনে অবিস্মরণীয়। মামার প্রতি আমার গভীর শ্রদ্ধা ছিল, এবং তিনি আমার নিয়মিত খোঁজখবর নিতেন। তার সেই সাহায্য আমাকে সবসময় আত্মবিশ্বাসী করে রাখত।

আমার জীবনে তখনকার ঘটনাটি একটি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। যদিও সাইকেল আমি তখন পায়নি, তবে শিখেছিলাম, কিছু কিছু জিনিস সবসময় আমাদের জন্য সময়মতো আসে না, কিন্তু মানুষের ভালোবাসা ও সহানুভূতি কখনো ম্লান হয় না। মামার সাহায্য ও আশ্বাস আমাকে সাইকেলের চেয়ে আরও বেশি কিছু শিখিয়েছে। তবে, কিছু সময় পর আমি বুঝতে পারলাম, মামার কষ্ট এবং শ্রম আমাদের জন্য কতটা মূল্যবান ছিল।

এখন, যখন আমি বড় হয়েছি, তখন বুঝতে পারি, সাইকেল না পাওয়া কোনো বড় কথা ছিল না। আমার জীবনে যে অনেক বড় দিকগুলো আছে, তা হল মামার ভালোবাসা, তার কষ্ট, তার প্রতিশ্রুতি, এবং তার শিখানো জীবনদর্শন। আর, সাইকেল পেলে হয়তো আমি আনন্দিত হতাম, কিন্তু মামার কাছ থেকে পাওয়া সেই শিক্ষাগুলি ও মূল্যবোধ, তা আজও আমার জীবনের সবচেয়ে বড় উপহার।

মামা বিদেশে চলে যাওয়ার পরেও, তিনি নিয়মিত আমাদের খোঁজ নিতেন। তার স্নেহ ভালোবাসা এবং সাহসিকতার জন্য আমি আজও তাকে ধন্যবাদ জানাই। মামা, যদিও সে লাল রঙের সাইকেল কখনো আনতে পারেনি, কিন্তু তার অবদান আমাদের জীবনে অনস্বীকার্য।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়