শুক্রবার, ২৩ মে, ২০২৫  |   ২৯ °সে
জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয় অন্যান্য
ব্রেকিং নিউজ
  •   ঢাকা থেকে উড্ডয়নের পরপরই তার্কিশ এয়ারলাইন্সের ইঞ্জিনে আগুন

প্রকাশ : ২৩ মে ২০২৫, ০২:৫৭

ডিজিটাল ভূত

মিজানুর রহমান রানা
ডিজিটাল ভূত

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)

ওসি ইরফান খানও কম যায় না। ১৪ জেলা ঘুরে তিনি এখন পাক্কা খেলোয়াড়। সুনন্দার অন্তর্বাসে জিপিএস ডিভাইস লাগানো ছিলো। রাত অনেক হওয়ায় তিনি বুঝতে পারলেন সুনন্দার বিপদ হয়েছে। ফোর্স নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন। তারপর জিপিএস এর লোকেশন অনুযায়ী কবিরাজের ডেরায় হাজির হলেন।

কবিরাজও সতর্ক মাল। তার ডিজিটাল ভূত তাকে খবর দিয়েছে কিছুক্ষণ আগে। ওসি সাহেব ফোর্স নিয়ে তার ডেরায় হাজির হওয়ার আগেই সে জামশেদকে নিয়ে লাপাত্তা।

কবিরাজের ডেরায় ঢুকে অবাক হয়ে গেলেন ওসি ইরফান খান। এএসআই করিম বখতকে নির্দেশ দিলেন : চিরুনি অভিযান চালাও। ফাঁক দিয়ে একটা মশাও যেনো বেরিয়ে যেতে না পারে।

জিপিএস-এর লোকেশন অনুযায়ী একটি কামরায় অনিক ও সুনন্দাকে পাওয়া গেলো। কিন্তু স্বপ্নীল ও তাসনীমকে পাওয়া গেলো না।

রাতেই ঘুম থেকে উঠিয়ে সুনন্দাসহ অনিককে থানায় নিয়ে আসা হলো।

অনিককে প্রশ্ন করা হলো : তোমার নাম কি?

অনিক : আমার নাম অনিক।

ওসি : তোমার বাবার নাম কি?

অনিক : জানি না।

জীবনে এতো মজার কথা আর শুনেননি ওসি ইরফান খান। কি বলে ছেলেটা? সে তার বাবার নাম জানে না।

ওসি : কী বলো তুমি, তোমার কি বাবা নেই?

জানি না। অনিক উত্তর দেয়।

ওসি : মায়ের নাম কী?

অনিক : জানি না। শুধু কবিরাজ ও জামশেদকে চিনি।

ওই এই কথা। ওসি চিন্তায় মগ্ন। এটা কীভাবে হতে পারে। একটা সতেরো বছরের ছেলে তার বাবা মায়ের নাম জানে না।

তিনি ফোন করলেন বোরহান সাহেবকে। বললেন, অনিকের মাকে নিয়ে থানায় আসুন।

অনিকের মা সুমি বেগম এসেই অনিককে দেখে জড়িয়ে ধরে কান্না শুরু করলেন : বাবাগো তুমি এতো বছর কোথায় ছিলে বাবা?

অনিক কোনো কথা বলছে না। রোবটের মতো দাঁড়িয়ে আছে। পাশে যে তার মা কাঁদছে, সেদিকে তার কোনো ভ্রুক্ষেপও নেই।

তুমি কি আমারে চিনতে পারো নাই বাবা অনিক। আমি তোমার মা সুমি বেগম। তোমার বাবা তো বিদেশে থাকে। তোমার খবর না পাইয়া খুবই পেরেশান আছে। তুমি আমাগোরে ছাইড়া কেমনে ছিলো এতোদিন?

অনিকের মুখে কোনো ভাষা নেই। সে রোবটের মতোই দাঁড়িয়ে আছে।

পরদিন অনিককে হাসপাতালে ভর্তি করানো হলো। ডাক্তার মাসুম সাহেব। পুরো বডি চেকআপ করে তার ঘাড়ের পেছনে থাকা ডিভাইস খুঁজে পেলেন। তারপর হাসপাতালে সার্জারি করে তার ঘাড়ের পেছনের ডিভাইসটি বের করে আনা হলো।

প্রায় এক সপ্তাহ পর সুস্থ হলো অনিক। পাশে বসে থাকা তার মা সুমি বেগমকে দেখেই উঠে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলো। তারপর বললো : মা তুমি এতোদিন কোথায় ছিলে?

ওসি ইরফান খান সব শুনলেন। তারপর অনিককে বললেন : তুমি যে গত তিন বছর যাবত কোথায় ছিলে কিছু মনে করতে পারো?

অনিক : না ওসি সাহেব। আমার মনে নেই।

ডাক্তার বললেন : ওর তো মনে থাকার কথা নয়। কারণ সে একটা ঘোরের মধ্যে ছিলো। তার শরীরের ডিভাইস অনুযায়ী সে কারও নির্দেশে সব কাজ করতো। নিজের কোনো ইচ্ছাশক্তি তার ছিলো না।

ওসি : ওহ, তাই তো। সে তো তার নাম ছাড়া বাবা মায়ের নামটিও বলতে পারেনি। উত্তর দিলেন ওসি সাহেব।

ডাক্তার : ঠিক বলেছেন। ডিভাইসটিতে শুধু তার নামটিই বসানো ছিলো। তাই সে তার নামটিই উচ্চারণ করতে পারতো।

ডিভাইসটি যে পরিচালনা করতো, নির্দেশনা দিতো তারও তো নাম আছে। বললেন ওসি সাহেব।

ঠিক। তবে সেটা বের করতে একটু সময় লাগবে। উত্তর দিলেন ডাক্তার মাসুম।

হ্যাঁ, আপনি সেটা বের করুন। তারপর আমাকে জানাবেন। অনুরোধ করলেন ওসি সাহেব।

এবার বোরহান সাহেব বললেন : ভাইজান, আমার ছেলেমেয়ে গুলো? তাদেরকে পাওয়া যাবে তো?

ওসি সাহেব এক হাত দিয়ে বাস থামার মতো ইঙ্গিত করে তাকে থামতে বললেন। তারপর বললেন : চিরুনি চিনেন?

বোরহান : হ্যাঁ, চিনি তো?

ওসি : সূক্ষ্ম চিরুনির ভেতর দিয়ে একটা

মাছি বের হতে পারে না? তবে উকুন বের হতে পারে। উত্তর দিলেন বোরহান সাহেব।

ওসি : আমরা উকুন, মাছি কিছুই ধরবো না। এবার রাঘববোয়ালটাকে ধরবো। শুধু একটু সময়ের অপেক্ষা। সুনন্দাকে আবার কাজে লাগাতে হবে।

কবিরাজ জামশেদকে নিয়ে স্বপ্নীল ও তাসনিমসহ একদম সোজা রাজশাহীতে চলে যায়। সেখানে গিয়ে বিশাল আম বাগানের মাঝে একটা বাড়িতে আশ্রয় নেয়। এই বাড়িটা কবিরাজের নিজেরই বাড়ি। এই বাড়ির চারদিকে ঘনজঙ্গলে ভরপুর। দিনের বেলায়ও সেখানে যেতে মানুষ ভয় পায়।

স্বপ্নীল ও তাসনিম বেশিরভাগ আত্মভোলার মতো হয়ে থাকে। তাদের মধ্যে তেমন একটা বোধশক্তি নেই। কবিরাজ এদের দু’জনের ঘাড়েও ইতোমধ্যে চিপ বসিয়েছে। তারপর অট্টহাসি হেসে জামশেদকে বলে : এবার আর আমাগোরে পায় কে? এই দুইটারে দিয়া ভিক্ষা করাইয়া আবার হাজার হাজার টাকা আইবো।

জামশেদ আনন্দে মাথা দোলায়। তারপর বলে : ওস্তাদ, কাল থেকেই এদেরকে কাজে লাগান লাগবো। রাজশাহী রেলস্টেশনে বসাইয়া দিলে মারাত্মক ঘটনা অইবো। টাকা আর টাকা।

কবিরাজ : হ্যাঁ, তুই আগামীকাল সকালেই ওগোরে লইয়া যাইবি। তারপর যায়গা মতোন বসাইয়া দিবি আর চোখ রাখবি যেনো পালাইয়া যাইতে না পারে।

জামশেদ : পালাইতে পারবো না ওস্তাদ। ওগোর ঘাড়ে তো ডিজিটাল ভূত আছে। ওরা এহন আমাগো কথামতোই চলবো একশ’ পার্সেন্ট গ্যারান্টি।

কবিরাজ : ঠিক আছে। ওগোরে খাওয়া আগে। ওগো ভুখ লাগছে মনে হয়। তারপর কবিরাজ তার সেই ডায়ালগ ছাড়ে আর অট্টহাসি হাসে।

রাজশাহী রেলস্টেশন। স্বপ্নীল আর তাসনিম ভিক্ষা করছে : আমার আল্লাহ নবীজির নাম, কেবা আছেন আমাগোরে কইরা যানগো দান, আমার আল্লাহ নবীজির নাম...।

সামনে একটা থালার মধ্যে ঝনঝন করে কিছুক্ষণ পর পর ঢং ঢং করে টাকার কয়েন পড়ছে। আর তারা হাতিয়ে হাতিয়ে কয়েনগুলো দেখছে।

কিছু দূর থেকে এসব লক্ষ্য করছে জামশেদ। সে জানে সন্ধ্যা হলেই মানুষজনের আনাগোনা থেমে যাবে। তখন আর টাকা পাওয়া যাবে না। তখন ছেলে মেয়ে দুটিকে নিয়ে সে চলে যাবে ওস্তাদের ডেরায়।

ওরা ভিক্ষা করে চলছে প্রায় তিন মাস যাবত। একদিন বাসস্ট্যান্ডে, একদিন রেলওয়ে স্টেশনে আবার কখনও কখনও তিন রাস্তার মোড়ে। এভাবেই চলছে তাদের জীবন।

একদিন রাজশাহী রেলস্টেশনে ভিক্ষা করার সময়ই বোরখা পরা সুনন্দার চোখ পড়ে এই দুটি ছেলেমেয়ের উপর। সে কাছে এসে বসে। তারপর তাদেরকে জিজ্ঞাসা করে : তোমাদের মা-বাপ নাই?

তারা উত্তর দেয় না। তারপর সুনন্দা জিজ্ঞাসা করে : তোমাদের বাড়ি কোথায়?

দু’জন কোনো উত্তর দেয় না। শুধু বলে চলে : আমার আল্লাহ নবীজির নাম, কেবা আছেন আমাগোরে কইরা যানগো দান, আমার আল্লাহ নবীজির নাম...।

সুনন্দা : তোমাদের নাম কি?

দু’জন কোনো উত্তর না দিয়ে আবারও বলতে থাকে : আমার আল্লাহ নবীজির নাম, কেবা আছেন আমাগোরে কইরা যানগো দান, আমার আল্লাহ নবীজির নাম...।

সুনন্দা এবার শিউর হয়। এরাই তারা, যাদেরকে সে খুঁজছে। বাচ্চা দুটির কাছে জবাব না পেয়ে সে একটা বুদ্ধি আঁটে। তাদের থালায় কিছু কয়েন ফেলে বেশ কিছুদূর গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। এদিক সেদিক ঘুরে সন্ধ্যার সময় দেখতে পায় একটা মোটা কালো লোক (জামশেদ) এসে তাদেরকে নিয়ে চলে যাচ্ছে।

এ সময় সুনন্দা ওসি সাহেবকে কল করে বিষয়টা জানায়। ওসি সাহেব রাজশাহী থানাতেই ছিলেন। ফোর্স সহ দ্রুত আসতে থাকেন আর সুনন্দাকে বলেন : সুনন্দা আমরা এখন ওদেরকে ধরবো না। তাহলে রাঘাব বোয়ালগুলো পালিয়ে যাবে। তুমি অনেক দূর থেকে তাদেরকে ফলো করতে থাকো। দেখো তারা কোথায় যায়। (চলবে)

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়