প্রকাশ : ২৩ মে ২০২৫, ০২:৫৫
রাখালের লাল গরু

গ্রীষ্মের ক্লান্তিকর দুপুর চারপাশ জ্বলছে রোদের তাপে। মাঠের শুকনো মাটি যেন ছ্যাঁকা দিচ্ছে।ধুলো বালির উপর পা ফেললেই মনে হয় কেউ যেন আগুন ছুঁইয়ে দিচ্ছে। রাস্তার বালু পর্যন্ত যেন ছোট ছোট কয়লার মত ঝলসে উঠছে। বাতাস নেই শীর্ণ গাছগুলোর পাতা স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। প্রকৃতির এমন নির্জীব মুহূর্তে রাখাল ছেলেটি গরুগুলো মাঠে চড়তে দিয়ে বিশ্রাম নিচ্ছে এক বিশাল বটগাছের ছায়ায়।
বয়স তার বেশি না তবু ও মুখে চিন্তার রেখা। এই বয়সেই জীবনকে চিনেছে দায়িত্বকে বুঝেছে। বাবা মারা গেছেন বছরখানেক আগে সংসারের ভার এখন তার কাঁধে। দুইটা গরু—তার পরিবারের মূল সম্পদ, জীবিকার একমাত্র অবলম্বন। এই গরুগুলো দিয়েই হাল চাষ করে সে। এর মধ্যে লাল রঙের গরুটি একটু শক্তিশালী ও শান্তশিষ্ট, হালের কাজেও ভীষণ উপকারী।
রোদ্দুরের তাপে ক্লান্ত রাখাল হেলান দিয়ে বসতেই একটু পরেই ঘুমিয়ে পড়ে। গাছের ছায়ায় হালকা কাঁপা পাতার শব্দ—সব মিলিয়ে চোখে নেমে আসে স্বপ্নের পর্দা। স্বপ্নে রাখাল দেখে, তার পিঠে স্কুল ব্যাগ, সে ক্লাসে যাচ্ছে, বন্ধুদের সঙ্গে খেলছে। পড়াশোনা শেষ করে সে হয়ে উঠছে একজন প্রতিষ্ঠিত সমাজসেবক। দরিদ্র মানুষের পাশে দাঁড়াচ্ছে। কাউকে রিক্সা, গরু ,ছাগল, কাউকে পুঁজি দিচ্ছে ক্ষুদ্র ব্যবসার জন্য। গ্রামের মানুষ তাকে ভালোবাসছে, শ্রদ্ধা করছে। একটুখানি ঘুমে রাখালের সমস্ত জীবনের স্বপ্ন জড়িয়ে পড়ে।কিন্তু স্বপ্ন বেশি দীর্ঘ হয় না। হঠাৎ গাছের ডালে একটি পাখির চিৎকারে ঘুম ভেঙে যায়। চোখ মেলেই দেখে, মাঠে তার প্রিয় লাল রঙের গরুটি নেই। সে আঁতকে উঠে দাঁড়ায়। মাঠের এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত ছুটে বেড়ায় গরুটিকে খুঁজতে। রোদ এত তীব্র যে, মাথা ঘুরে পড়ে যাবার উপক্রম হয়। ক্লান্ত হয়ে এক সময় বসে পড়ে চোখে জল আসে। গরুটার কথা ভাবতে ভাবতেই গলার সুরে ভেসে আসে একটুখানি স্নিগ্ধ কান্না।
“গরুটা যদি হারিয়ে যায়, তাহলে আমি কীভাবে সংসার চালাবো?” মনে মনে ফিসফিস করে।
রাখালের চোখের পানি ঝরে পড়ে শুকনো মাটিতে। সে জানে, এই গরুটি হারালে তার জীবন থেকে হারিয়ে যাবে স্বপ্ন, সম্ভাবনা ও বেঁচে থাকার রসদ।
পশ্চিম আকাশে তখন রক্তিম সূর্য অস্ত যেতে চলেছে। ঠিক তখনই দূরে কিছুটা মাটি সরে যাওয়া অংশ থেকে লাল গরুটিকে দেখা যায়। গরুটি নিজেই ফিরে আসছে মুখটা ধুলোয় ভরা, কিন্তু চোখে এক অদ্ভুত কোমলতা। যেন গরুটিও খুঁজছিল রাখালকে। দৌড়ে গিয়ে গরুটিকে জড়িয়ে ধরে রাখাল। কাঁদতে কাঁদতে বলে, “তোকে হারালে আমি আর বাঁচতাম না।”
গরুটিও যেন চোখের কোণে জল নিয়ে তাকিয়ে থাকে রাখালের দিকে। যেন দুজনের মধ্যে এক গভীর অনুভব জমে উঠেছে—যার নাম নির্ভরতা, ভালবাসা আর সহানুভূতি। এরপর গ্রামের এক বৃদ্ধ কৃষক এগিয়ে এসে বলল, “বাবা, রাগ করো না। তোমার গরুটাকে দুপুরে আমার খেতের ধারে পেয়েছি। আমার বীজতলা খেত নষ্ট করে দিবে সেই ভয় আমি ধরে রাখি, ভাবছিলাম বিকেলে তোমাকে বলব। এই গরু তো দান খায় না, চুপচাপ ছিল। বুঝতেই পারিনি তোমার এতো টান!” রাখাল কিছু বলল না, শুধু মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকল। এরপর ধীরে ধীরে বলল, “ধন্যবাদ কাকা, গরুটা অনেক আপন। আমি ভয় পেয়ে গেছিলাম...”।
কৃষকের চোখেও যেন একটু অশ্রু, বললেন, “জীবনে অনেক হারাতে হয়, কিন্তু যেটা নিজের হয়, সেটা একদিন ঠিকই ফিরে আসে।”
রাখাল জানে, তার জীবনে আনন্দ অনেক কম। বাবা মারা যাবার পর মা একাই সংসার চালাতেন। আর সে ছোট থেকেই মাঠে গরু চরানো, জমিতে কাজ করা এসব শিখে ফেলেছে। লেখাপড়া করতে চেয়েছিল, কিন্তু পরিস্থিতি তাকে হাতে লাঙ্গল ধরিয়ে দিয়েছে। তবুও স্বপ্ন ছাড়েনি। মাঝে মাঝে স্কুলের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে, যেন এইটুকু পথ তার কাছে স্বপ্নের চেয়ে দূরবর্তী।
সে মনে মনে ভাবে, “একদিন আমি পড়াশোনা করবো, প্রতিষ্ঠিত হবো। মায়ের মুখে হাসি ফোটাবো।”
তার জীবনের গল্পটা যেমন কষ্টে ভরা, তেমনি তাতে লুকিয়ে আছে স্বপ্নের আলো। আর সেই আলোর সঙ্গী, সে বিশ্বাস করে, এই লাল গরুটি।
রাখাল আবার গরুটিকে নিয়ে ফিরে যায় ছায়াঘেরা গাছের নিচে। মাটির ওপরে বসে সে ভাবে, এই জীবন সহজ নয়, কিন্তু একটুখানি সাহস, ভালোবাসা, আর অল্প কিছু স্বপ্ন থাকলে জীবনেও আলো দেখা যায়। আজকের এই ঘটনাই যেন তার জীবনের বাস্তব চিত্র—যেখানে হারানো স্বপ্ন আবার ফিরে আসে, একটু অপেক্ষার পর।