মঙ্গলবার, ০২ ডিসেম্বর, ২০২৫
জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয় অন্যান্য

প্রকাশ : ০২ ডিসেম্বর ২০২৫, ০৮:৩৭

রাষ্ট্র কি কোচিং চক্র ভাঙতে প্রস্তুত

সাব্বির নেওয়াজ
রাষ্ট্র কি কোচিং চক্র ভাঙতে প্রস্তুত

দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা এখন কোচিংনির্ভর; প্রথম থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত একাডেমিক কোচিং যেন নিয়মে পরিণত হয়েছে। আছে আরও বিভিন্ন রকমের কোচিং। প্রশ্ন জাগে, দেশে কোচিং সেন্টারের সংখ্যা কত? বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো ‘বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জরিপ ২০২৪’ প্রতিবেদন জানিয়েছে, নিবন্ধিত কোচিং সেন্টারের সংখ্যা ছয় হাজার ৫৮৭টি। এর মধ্যে একাডেমিক শ্রেণি-পর্যায়ের কোচিং ছয় হাজার ৩১২টি এবং বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি ও চাকরি প্রস্তুতিমূলক রয়েছে আরও ২৭৫টি। বলা বাহুল্য, প্রকৃত সংখ্যা আরও অনেক বেশি। কারণ রাজধানী থেকে জেলা-উপজেলায় প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের আশপাশেই নিবন্ধনহীন কোচিং সেন্টার গড়ে উঠেছে।

অদ্ভুত বৈপরীত্য হলো–যেখানে এসব প্রতিষ্ঠান শিক্ষাসংশ্লিষ্ট, সেখানে নিবন্ধন দিচ্ছে সিটি করপোরেশন, পৌরসভা ও ইউনিয়ন পরিষদ স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান। স্থানীয় সরকার (সিটি করপোরেশন) আইন ২০০৯-এর ১১১, পৌরসভা আইনের ৭৯ এবং ইউনিয়ন পরিষদ আইনের ৮২ ধারায় কোচিং সেন্টার নিবন্ধনের সুযোগ থাকলেও, শিক্ষাক্রম, শিক্ষকের যোগ্যতা, শ্রেণি-পরিকল্পনাÑকোনো কিছুতেই নেই কেন্দ্রীয় নীতিমালার বাধ্যবাধকতা। ফলে কোচিং ব্যবসা চলছে সম্পূর্ণ বাণিজ্যিক যুক্তিতে, বিনা তদারকিতে।

রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা এখন কোচিং সাম্রাজ্যে পরিণত। ফ্ল্যাট বাড়ির নিচতলা ও দ্বিতীয়তলা ভাড়া নিয়ে কোচিং সেন্টার চালাচ্ছেন নামি বিদ্যালয়গুলোর শিক্ষকরা। দ্বিতীয় শ্রেণি থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত শত শত শিক্ষার্থী প্রতিদিন এসব কোচিং সেন্টারে ছুটছে। রাজধানী থেকে মফস্বল, এমনকি প্রত্যন্ত গ্রামেও এখন কোচিং সেন্টারের ছড়াছড়ি। স্কুল-কলেজের পাঠ্যপুস্তকের পাশাপাশি কোচিং সেন্টার ছাড়া শিক্ষার্থী ও অভিভাবক যেন নিরাপদ বোধ করেন না। অনেক জায়গায় এটি বিকল্প স্কুলে রূপ নিয়েছে; যেখানে ক্লাসরুমের ঘাটতি নেই, অনুপস্থিত শুধু রাষ্ট্রীয় নজরদারি।

প্রশ্ন হলো-সরকারি নির্দেশনার পরও শিক্ষার্থীদের কেন কোচিংয়ে পাঠাতে হচ্ছে? অভিভাবকদের উত্তর হতে পারে বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থার সবচেয়ে বড় সতর্কবার্তা। তাদের অভিযোগ–স্কুলে শিক্ষকরা ক্লাসে মনোযোগ দিয়ে পড়ান না; বরং নিজের কোচিং সেন্টারে আসতে ইঙ্গিত, অনুরোধ কিংবা কখনও কখনও চাপ প্রয়োগ করেন। স্কুলের পরীক্ষায় নম্বর কমিয়ে দিন। এতে পরিবারে বাড়তি অর্থনৈতিক চাপ তৈরি হচ্ছে। ভর্তি ফি, মাসিক ফি, টিউশন ফি মিলে নিম্ন ও মধ্যবিত্ত পরিবারের জন্য এটি এক বড় বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই ‘বাধ্যবাধকতা’ আসলে কীসের ফল? স্কুল কি তার মৌল দায়িত্ব শিক্ষার্থীর শেখার নিশ্চয়তা সঠিকভাবে পালনে ব্যর্থ? নাকি শিক্ষক ব্যবস্থাপনার ভেতরই তৈরি হয়েছে বাণিজ্যিক স্বার্থের অপ্রকাশ্য সহমত?

দীর্ঘদিনের এই চর্চা প্রমাণ করে যেখানে নীতিমালা নেই, সেখানে অনিয়মই নিয়মে পরিণত হয়। অথচ শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা, মাধ্যমিক-উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের নীতিমালাÑএসব কেবল কাগজে-কলমে।

শিক্ষার্থীরা বলছে, কোচিং সেন্টারে শিক্ষকরা বেশি সময় দেন, পাঠ্যবিষয় পরিষ্কারভাবে বোঝান এবং পরীক্ষার প্রস্তুতিতে সহায়তা করেন। অনেক সময় ফোন বা মেসেজের মাধ্যমে ব্যক্তিগত সহায়তাও পাওয়া যায়। ফলে অনেক শিক্ষার্থী কোচিং সেন্টারকে স্কুলের চেয়েও কার্যকর মনে করে।

এই বাস্তবতায় প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক, কোচিংয়ে শেখাতে পারলে বিদ্যালয়ে কেন শিক্ষকরা তা পারেন না? কোনো শিক্ষক যখন নিজের প্রতিষ্ঠানের পাশে কোচিং সেন্টার খুলে শিক্ষার্থীদের সেখানে যেতে ‘পরামর্শ’ দেন, তখন শিক্ষা-নৈতিকতা শুধু লঙ্ঘিত হয় না, শিক্ষকতা পেশার প্রতি মানুষের আস্থা ভেঙে পড়ে। অনেক শিক্ষক মূল দায়িত্ব থেকে সরে গিয়ে কোচিংয়ের দিকে বেশি মনোযোগ দিচ্ছেন। ফলে কোচিং সেন্টার শিক্ষা ব্যবস্থার পরিপূরক হওয়ার বদলে বৈষম্য সৃষ্টির হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে।

এখানে প্রশ্ন ওঠে–রাষ্ট্র কি তার স্কুল ব্যবস্থাকে এমন জায়গায় নিয়ে গেছে, যেখানে ‘শেখার নিশ্চয়তা’ কিনে নিতে হয়? স্কুলের ক্লাসরুম যদি কার্যকর হতো, শিক্ষক মূল্যায়ন ও তদারকি যদি যথাযথ হতো, তাহলে কি এত বিশাল কোচিং বাজারের প্রয়োজন হতো?

এ পর্যন্ত প্রণীত দেশের প্রায় সবক’টি শিক্ষানীতিতে বারবার বলা হয়েছে–শিক্ষা হবে মানসম্মত, সমতামূলক ও রাষ্ট্রীয়ভাবে নিয়ন্ত্রিত। কিন্তু কোচিং অরাজকতা দেখিয়ে দিচ্ছে রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ কোথাও নেই। বরং নিবন্ধনের দায়িত্ব যাদের, তারা শিক্ষা-মানের দিকে তাকানোর আইনগত বাধ্যবাধকতাই বোধহয় অনুভব করেন না।

এখন প্রশ্ন-কোচিং সেন্টার থাকা উচিত নাকি পুরোপুরি নিষিদ্ধ করা উচিত? বাস্তবতার খাতিরে একেবারে বন্ধ করা সম্ভব নয়। তবে সহায়ক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হিসেবে এগুলো চালাতে হলে নিবন্ধন ও নিয়ন্ত্রণ শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে আনতে হবে।

এখন প্রয়োজন তিনটি মৌলিক পদক্ষেপÑ১. কোচিং নিবন্ধন প্রক্রিয়া শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে আনা এবং কেন্দ্রীয় নীতিমালা জারি। ২. বিদ্যালয়ের শিক্ষক-ব্যবস্থাপনা ও পাঠদানের মান কঠোরভাবে পরিমাপ ও নজরদারি। ৩. বিদ্যালয় ও কোচিং পরিচালনায় স্বার্থ-সংঘাত কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করা।

বস্তুত শিক্ষা কোনো ব্যবসা নয়এটি রাষ্ট্রের দায়িত্ব। অথচ ব্যবসার যুক্তি যখন শিক্ষা ব্যবস্থার ভেতরে ঢুকে পড়ে, তখনই কোচিং বাজার জন্ম নেয়। স্কুলের বাইরে শেখার জন্য হাজার হাজার প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠার অর্থ হলো–স্কুল তার মৌল দায়িত্বে ব্যর্থ হয়েছে। আর এই ব্যর্থতা পূরণ করতে গিয়ে অভিভাবক, শিক্ষার্থী ও সমাজ–সবাইকে দিতে হচ্ছে চড়া মূল্য।

এখন প্রশ্ন, রাষ্ট্র কি এই চক্র ভাঙতে প্রস্তুত, নাকি শিক্ষার ভবিষ্যৎ আরও বাণিজ্যিক অন্ধকারে নিমজ্জিত হবে? উত্তর হচ্ছে, শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে অরাজকতা যতদিন চলবে, ততদিন কোচিং সেন্টারের চক্রও থামবে না। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলোমূল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর পাঠদানের মানোন্নয়ন। যদি স্কুল-কলেজেই মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করা যায়, তবে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা কোচিংয়ের দিকে ছুটবেন না। নীতিনির্ধারকদের এখনই সিদ্ধান্ত নিতে হবে।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়