প্রকাশ : ১২ নভেম্বর ২০২৫, ২১:২৫
৩৮ বছর একই বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষিকা পদে চাকুরির পর রওশন আরা বেগমের অবসরগ্রহণ

নানা প্রতিবন্ধকতা ও প্রতিকূল
পরিবেশের মধ্যেও একই বিদ্যালয়ে ৩৭ বছর ৮ মাস প্রধান শিক্ষিকা পদে কর্মরত থেকে রওশন আরা বেগম এবার চাকুরি জীবনের ইতি টানলেন। তিনি চাঁদপুর শহরের তালতলাস্থ পীর মহসীন উদ্দিন পৌর বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা পদে অধিষ্ঠিত থেকে সসম্মানে অবসরে যাওয়ার সুযোগ পেলেন। গত ৮ নভেম্বর ২০২৫ (শনিবার) নিজের অবসরে যাওয়ার কথা নিশ্চিত করেন নিজেই। বিদ্যালয়টিতে ১৯৮৮ সালের ২১শে জুন হতে ২০২৫ সালের ২৭শে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত একটানা শুধুমাত্র প্রধান শিক্ষক পদেই তিনি কর্মরত ছিলেন।
প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী, ১৯৮৮ সালের ২১ জুন অস্থায়ী ভিত্তিতে প্রধান শিক্ষক হিসেবে বিদ্যালয়টিতে চাকুরি শুরু করেন রওশন আরা। পরবর্তীতে ১৯৯৩ সালের ১ জানুয়ারি বিদ্যালয়টিতে চূড়ান্তভাবে স্থায়ী প্রধান শিক্ষক হিসেবে নিযুক্ত হন। এরপর থেকে একটি এল টাইপের একচালা টিনের বিদ্যালয় হতে ক্রমান্বয়ে অবকাঠামোগত পরিবর্তনের মাধ্যমে বিদ্যালয়টিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে থাকেন। ২০০৪ সালে তৎকালীন চাঁদপুর-৩ আসনের এমপি জনাব এস এ সুলতান টিটু তাঁর নিজ উদ্যোগে সমগ্র পৌরসভার মধ্যে শিক্ষালয়টির দোতলা ভবন নির্মাণ করে দেন ফ্যাসিলিটিজ বিভাগ কর্তৃক। পরবর্তীতে প্রায় ১৫ বছর পর ২০১৯ সালে ৪ তলা ভিত্তিবিশিষ্ট উর্ধ্বমুখী ভবনে রূপ দিতে সক্ষম হন প্রধান শিক্ষিকা রওশন আরা। তিনি জানান, ২০২২ সালের প্রথম দিকে একতলা ভবন নির্মাণ কাজ সম্পন্ন হয় এবং পর্যায়ক্রমে ২০২৩ থেকে ভবনটিতে ৪ তলার উর্ধ্বমুখী সম্প্রসারণের কাজ শুরু হয়, যেটি ২০২৫-এর সেপ্টেম্বরের দিকে শেষ হয় আমার অবসরগ্রহণের পূর্বেই। এছাড়া শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা নিশ্চিতে দুদিকের বাউন্ডারী ওয়ালের কাজ শেষ করি এবং পূর্ব দিকেও বাউন্ডারী ওয়াল নির্মাণ কাজের অর্ডার প্রক্রিয়াধীন আছে।
রওশন আরা জানান যে, তাঁরা জন্মগতভাবে চাঁদপুরের বাসিন্দা। তাঁর পিতা প্রথম জীবনে চট্টগ্রামে কাস্টমস অফিসার ছিলেন। এরপর তিনি চাঁদপুরে ব্যবসা বাণিজ্য করেন এবং ওকালতি করেন। রওশন আরাসহ সকল ভাইবোন চাঁদপুর সদরের উল্লেখযোগ্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়ালেখা করেন। যেমন ভাইয়েরা হাসান আলী সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ও বোনেরা মাতৃপীঠ সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়, চাঁদপুর সরকারি কলেজ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে লেখাপড়া শেষ করেন। সবাই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মেধাবী শিক্ষার্থী ছিলেন। তিনি জানান যে, তাঁদের আব্বা-মায়ের নিজস্ব বাসা হলো আব্দুল করিম পাটওয়ারী সড়কের চৌধুরী পাড়ায়। বাসার নাম 'সূর্যমুখী', তাঁর পৈত্রিক বাড়ি ফরিদগঞ্জ উপজেলার ১০নং গোবিন্দপুর ইউনিয়নের চরভাগল গ্রামে। মরহুম অ্যাড. জাবেদ আলী এবং আমিরুন্নেছা দম্পতির ৪ মেয়ে ও ৩ ছেলের মধ্যে তিনি ষষ্ঠ সন্তান। তাঁর পিতা মহান মুক্তিযুদ্ধের ৯নং সেক্টরের একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। এছাড়াও একটি রাজনৈতিক দলেরও তৎকালীন সময়ে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন। অপরদিকে তাঁর মাতা আমিরুন্নেছা চট্টগ্রামের কাজীর দেউরি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা ছিলেন এবং ২০১৬ সালে সফল জননী হিসেবে শ্রেষ্ঠ জয়িতার পুরস্কার লাভ করেন। তিনি আরো জানান যে, তাঁর বড়োভাই ডা. মো শাহ আলম মনছুর আহমেদ তৎকালীন পিজি হাসপাতালের মেডিসিন বিশেষজ্ঞ এবং নিপসম-এর অধ্যাপক ছিলেন, দ্বিতীয় বোন মনোয়ারা বেগম বিমান বাহিনীর একটি ক্লাবে সুপারভাইজার ছিলেন, তৃতীয় ভাই মো. শাহজাহান ফিরোজ বস্ত্র দপ্তরের উপ-পরিচালক ছিলেন, ৪র্থ বোন দিলওয়ারা বেগম বাসাবো কদমতলা গার্লস হাই স্কুলের বিজ্ঞান শিক্ষিকা ছিলেন, ৫ম ভাই ডক্টর মনিরুল ইসলাম একজন অণুবিজ্ঞানী (ক্যানবোরা বিশ্ববিদ্যালয়) ক্যানসার রিচার্স অফিসার এবং অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্ন প্রবাসী। ৬ষ্ঠ বোন রওশন আরা বেগম প্রধান শিক্ষিকা এবং ৭ম বোন সাহানা সুলতানা ঢাকার মহিসন্ধী গার্লস বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে বিজ্ঞানের শিক্ষিকা ছিলেন এবং বর্তমানে অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী।
রওশন আরা বেগম বি.এস.সি. এবং বিএড শেষ করে এম.এস.সি. প্রথম পর্ব পড়ার সময়ে শিক্ষকতা পেশায় নিয়োজিত হন। তিনি কর্মরত অবস্থায় থাকাকালীন অ্যাড. সলিমুল্লাহ সেলিমের সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। তাঁর স্বামী অ্যাড. সলিমুল্লাহ সেলিম বর্তমানে চাঁদপুর জেলা বিএনপি'র সাধারণ সম্পাদক পদের দায়িত্বে রয়েছেন। তাঁদের দু কন্যা সন্তানের মধ্যে বড়ো মেয়ে শাওমুন খেয়া এমবিএ শেষ করে একজন ব্যাংকার হিসেবে স্বামীসহ কর্মরত রয়েছেন এবং ছোট মেয়ে তাসনিম তাহসিন পিউ সাতক্ষীরা সরকারি মেডিকেল কলেজ থেকে পাস করে স্বামীসহ অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী।
রওশন আরা বেগম বলেন, সুনাম ও দক্ষতার সাথে প্রায় ৩৭ বছর ৭মাস একই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে চাকুরি জীবন শেষ করলাম। কিন্তু বিগত ১৭ বছর আওয়ামী লীগের শাসনামলে শুধুমাত্র আমার স্বামী একটি বিরোধী দলীয় রাজনৈতিক দলের নেতা হওয়ায় অনেক প্রতিবন্ধকতা ও কষ্ট সহ্য করতে হয়েছে। এরই মধ্যে আমার স্বামীর বিরুদ্ধে করা ৪টি হত্যা মামলা এবং ১৭টি গায়েবি মামলার কারণে তাকেও অনেক দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে। এই সময়ে আমার বিরুদ্ধে আমার সহকর্মী এবং অন্যরাও সুযোগ বুঝে বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতা ও অসহযোগিতামূলক কোণঠাসা আচরণ করেন। যা আজও আমার মনে কষ্টের দাগ কাটে। বিশেষ করে একজন শিক্ষিকা অতিমাত্রায় বাড়াবাড়ি করে তার রাজনৈতিক ক্ষমতা ও দলীয় পোস্ট নিয়ে। শুধু তাই নয়, তিনি সবসময় বিদ্যালয়ে দু-একজন শিক্ষককে সাথে নিয়ে আমার বিরুদ্ধে কূটকৌশল পরিচালনা করতেন। তিনি আমার জীবনে ছিলেন এক অশনি সংকেত। আওয়ামী দুঃশাসনের ১৭ বছরে কারণে-অকারণে তৎকালীন পৌর কর্তৃপক্ষ ও আরো দু-একটি অফিসের মাধ্যমে আমাকে মিথ্যা অপদস্থ করেন। এসব বাজে মিথ্যা কারণ দর্শানো বিষয় সম্বন্ধে ওনারাও ভালো করেই জানতেন। এতে আমার কিছুই যায় আসে নি। শুধুই মনে কষ্ট হতো ও মানসিক চাপ বাড়তো। যা ইচ্ছা করলেও কখনো ভুলতে পারবো না। তিনি আরো বলেন, আমি বিদ্যালয়টির দায়িত্ব নেয়ার পর উক্ত বিদ্যালয়টি নিম্ন মাধ্যমিক পর্যন্ত স্বীকৃত ছিলো না। অতঃপর পর্যায়ক্রমে ১৯৮৯ সালে বিদ্যালয়টি নিম্ন মাধ্যমিক (অষ্টম শ্রেণী) একাডেমিক স্বীকৃতি পায় এবং যথাক্রমে মাধ্যমিক বিদ্যালয় হিসেবে ১৯৯০ সালে দশম শ্রেণিতে মানবিক ও ১৯৯১ সালে দশম শ্রেণিতে বিজ্ঞান বিভাগসহ একাডেমিক স্বীকৃতি লাভ করে। পরবর্তীতে বেশ কয়েক বছর পর ২০১০ সালে বিদ্যালয়টিতে বাণিজ্য বিভাগ অনুমোদিত হয়। এছাড়াও ২০০০ সালের জুন থেকে পৌরসভার বেসরকারি এমপিওভুক্তকরণে আমি প্রায় ৩৮ বছর একই বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষিকা হিসেবে একনিষ্ঠ ভূমিকা পালন করি।
রওশন আরা বেগম তাঁর বিশেষ ইচ্ছা সম্পর্কে জানান যে, আমি চাকরি জীবনের পাশাপাশি বেশ কিছু সামাজিক সংগঠনের সাথে জড়িত ছিলাম। তখন সেগুলোতে খুব একটা সময় দিতে না পারলেও এখন ইনশাআল্লাহ আল্লাহ সুস্থ থাকলে সামাজিক কর্মকাণ্ড, শিক্ষা সংশ্লিষ্ট বিষয়, সবুজায়ন ও ধর্মীয় কর্মকাণ্ডে জীবনের বাকি সময়টা কাটাতে চাই। এই সাথে আমার আরো একটি ইচ্ছা আছে যে, আমার অর্জিত অর্থ দিয়ে আমার স্বামীকে একটি গাড়ি কিনে দেবো। আমরা ঘুরে ঘুরে অসহায় মানুষের জন্যে সামাজিক কর্মকাণ্ডে অনেকটা সময় নিয়ে নিবেদিত হয়ে দুজনে একসাথে কাজ করতে পারবো। পরিশেষে আমি আমার পরিবারের জন্যে সবার কাছে দোয়া কামনা করছি। যাতে বাকি জীবনটা সম্মানের সাথে এই দুনিয়ায় কাটিয়ে যেতে পারি।








