মঙ্গলবার, ০৯ সেপ্টেম্বর, ২০২৫  |   ৩১ °সে
জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয় অন্যান্য

প্রকাশ : ০৯ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০৮:৩৬

সাক্ষরতার উদ্দেশ্য এবং বর্তমান বৈশ্বিক প্রেক্ষাপট

মাছুম বিল্লাহ
সাক্ষরতার উদ্দেশ্য এবং বর্তমান বৈশ্বিক প্রেক্ষাপট

বছর ঘুরে আবার হাজির হলো আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা দিবস। গত বছরও আমরা দিনটি পালন করেছি, তারপর পার করেছি একটি বছর, কী অর্জিত হলো এ পর্যন্ত সেই হিসেব রাখার জন্যই আমরা আবার পালন করছি এই গুরুত্বপূর্ণ দিবসটি। এবারের (২০২৫) এর প্রতিপাদ্য হচ্ছে ‘প্রোমোটিং লিটারেসি ইন দি ডিজিটাল এরা’। ডিজিটাল যুগে সাক্ষরতাকে অবশ্যই এগিয়ে নিতে হবে। আমরা মনে করি, এর পূর্বে ডিজিটাল এরা-র সঙ্গে লিটারেসির সম্পর্ক কি সেটি খুঁজে দেখা প্রয়োজন। লিটারেসি দিবস পালনের ধারণা শুরু হয় সেই ১৯৬৫ খ্রিস্টাব্দে।

১৯৬৬ খ্রিস্টাব্দের ২৬ অক্টোবর ইউনেস্কোর সাধারণ সম্মেলনের ১৪তম অধিবেশনে ৮ সেপ্টেম্বর ‘আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা দিবস’ হিসেবে পালনের ঘোষণা করা হয়, কিন্তু পালন শুরু হয় সেই ১৯৬৭ খ্রিস্টাব্দে। জনসাধারণকে আরও শিক্ষিত, ন্যায়সঙ্গত, শান্তিপূর্ণ এবং টেকসই সমাজ গঠনের জন্য সাক্ষরতার গুরুত্বের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়ার জন্য দিবসটি পালিত হয়ে আসছে। কিন্তু বিশ্বের বর্তমান প্রেক্ষাপট, শিক্ষাসহ জ্ঞান বিজ্ঞানের অগ্রগতি, আবার মানুষের অধিকার কেড়ে নেয়া, গণতান্ত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম এবং গণতান্ত্রিক সমাজের পরিবর্তে দেশে দেশে স্বৈরতন্ত্রের উত্থান, অনুশীলন ও চর্চা, বাণিজ্য অবরোধ, মারণাস্ত্রের প্রসার এবং নিরীহ মানুষের জীবনহানি লিটারেসির মাধ্যমে শান্তিপূর্ণ সমাজ প্রতিষ্ঠার উদ্দেশের সাথে কতটা এগিয়েছে, কতটা সামঞ্জস্যের কাছে গেছে সেই হিসেব কষতে হবে। শুধু তাই নয়, এর সাথে যুক্ত হয়েছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার বিষয়টি। এই জটিল পরিস্থিতিতে আমাদের হিসেব কষতে হচ্ছে লিটারেসির অবস্থান, সংজ্ঞা, ব্যাখ্যা ও কর্মপদ্ধতি।

সাক্ষরতা সবার মৌলিক অধিকার কিন্তু যে সমাজ আমরা সৃষ্টি করেছি, যে বৈশ্বিক ব্যবস্থা তৈরি করেছি তাতে সাক্ষরতা ও শিক্ষা বিশেষ করে প্রকৃত শিক্ষা, মানসম্পন্ন শিক্ষা পেছনের সারিতে অবস্থান করছে। সমতার কথা, মানবিক অধিকারের কথা, মানবতার কথাও চলে আসে সাক্ষরতার সাথে। সেই দৃষ্টিকোণ দিয়ে গোটা পৃথিবীর দিকে তাকালে আমরা অধিকারহীনতা, অধিকার আদায়ের সংগ্রামে মানুষের রক্তদান, আত্মহুতি আর জীবন মরণ সংগ্রামই দেখতে পাচ্ছি। সেখানে লিটারিসি, ডিজিটাল লিটারেসির জায়গা কোথায়? পৃথিবীর প্রায় ৭৭৫ মিলিয়ন অধিবাসীর ন্যূনতম প্রয়োজনীয় অক্ষরজ্ঞানের অভাব রয়েছে। প্রাপ্তবয়স্ক প্রতি পাঁচজনের মধ্যে এখনও একজন শিক্ষিত নন এবং এই জনগোষ্ঠীর প্রায় দুই-তৃতীয়াংশই নারী।

বিশ্বের প্রায় ৬০ দশমিক ৭ মিলিয়ন শিশু প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা থেকে বঞ্চিত এবং আরও অনেকে অনিয়মিত বা শিক্ষা সমাপ্ত হওয়ার আগেই ঝরে পড়ে। প্রশ্ন হচ্ছে বিশ্বে মানবজাতির জন্য যে পরিমাণ সম্পদ রয়েছে তার মোটামুটি সুষম বণ্টন হলেও কি বিশ্বে সাক্ষরতা তথা শিক্ষিতের এই হাল হতো? গোটা বিশ্বে আনুষ্ঠানিকতার মধ্যে দিয়ে যেসব দিবস পালন হচ্ছে এবং সেখানে যেসব আলোচনা হয় বা পদক্ষেপের কথা বলা হয় তা সবই আটকে যায় ঐ জায়গাটিতে। কাজেই এখন কথা বলতে হবে এগুলো নিয়ে। তা না হলে যুগ যুগ ধরে আমরা আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা দিবস পালন করে যাব, কিস্তু কোন ফল বয়ে আনবে না। ফিলিস্তিনের অবুঝ শিশুরা যখন বাবা-মা, বাড়ি ঘর সব হারিয়ে চিৎকার করে কাঁদছে তার কাছে কেউ নেই, তার সামনে পেছনে ঘন অন্ধকার, ক্ষুধার জ্বালায় হাড্ডির সাথে চামড়া লেগে গেছে, সেই অবস্থায় ত্রাণের জন্য কারো সাথে গিয়ে গুলি খেয়ে আসতে হয়, সেই গ্রহে কীসের লিটারেসি, কাদের লিটারেসি, কেন লিটারেসি, এই লিটারেসির মানে কি সেই উত্তর আমাদের বের করতে হবে।

সাক্ষরতার সংজ্ঞা পাল্টাতে হচ্ছে প্রতি বছর। সাক্ষরতার সাথে জড়িত শিক্ষা, জ্ঞান, বিজ্ঞান, গবেষণা, ডিজিটাল ওয়ার্ল্ড এবং বর্তমান সময়ের বহুল আলোচিত কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা। সেই ১৯৬৭ খ্রিস্টাব্দ থেকে সাক্ষরতার যে সংজ্ঞা দেয়া হয়েছিল সেটি থেকে আমরা বহুদূর চলে এসেছি।

সাক্ষরতা সকলের জন্য একটি মৌলিক মানবাধিকার। এটি অন্যান্য মানবাধিকার বৃহত্তর স্বাধীনতা এবং বিশ্বব্যাপী নাগরিকত্ব উপভোগের দ্বার উন্মুক্ত করে। সাক্ষরতা হলো মানুষের জন্য বিস্তৃত জ্ঞান, দক্ষতা, মুল্যবোধ, মনোভাব এবং আচরণ অর্জনের একটি ভিত্তি। এটি সমতা, বৈষম্যহীনতা, আইনের শাসন, সংহতি, ন্যায়বিচার, বৈচিত্র এবং সহনশীলতার প্রতি আলোকপাত করে। উপযুক্ত সাক্ষরতা স্থায়ী শান্তির সংস্কৃতি গড়ে তোলে। সাক্ষরতার এসব উদ্দেশ্য ও সংজ্ঞা থেকে আমরা বর্তমান বিশ্বের অবস্থান তুলনা করলে যেসব চিত্র দেখতে পাই সেগুলোর সাথে সাক্ষরতার সমন্বয় ঘটাতে হবে তা না হলে অক্ষর দেখা পড়া আর সই করতে পারা নিয়ে মিটিং, শোভাযাত্রা আর বড় বড় সেমিনার করার মধ্যে কোন সমাধান খুঁজে পাওয়া যাবেনা।

বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলায় সাক্ষরতার ভূমিকা ব্যাপক। এটি ব্যক্তিগত ক্ষমতায়ন এবং সামাজিক ও মানবীয় উন্নয়নের হাতিয়ার। শিক্ষার সুযোগের বিষয়টি পুরোপুরি নির্ভর করে সাক্ষরতার ওপর। ১৯৬৭ খ্রিস্টাব্দে ইউনেস্কো প্রথম সাক্ষরতার সংজ্ঞা দিলেও প্রতি দশকেই এই সংজ্ঞা পাল্টাতে হয়েছে, এটিই স্বাভাবিক। ১৯৯৩ খ্রিস্টাব্দে ইউনেস্কো এই সংজ্ঞাটি নির্ধারণ করে যে, ব্যক্তি নিজ ভাষায় সহজ ও ছোট বাক্য পড়তে পারবে, সহজ ও ছোট বাক্য লিখতে পারবে এবং দৈনন্দিন জীবনে সাধারণ হিসাব নিকাশ করতে পারবে। কিন্তু এই সংজ্ঞাটিও এখন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। তার প্রমাণ আমরা কোভিড পরিস্থিতিতে পেয়ে গেছি। একজন ব্যক্তি ভালভাবে বাংলা পড়তে পারলেন, সাধারণ যোগ-বিয়োগ পারলেন কিন্তু বর্তমান যুগের ডিজিটাল ডিভাইসগুলোর সাথে পরিচিত নন, ব্যবহার করতে জানেন না, তাকে আমরা এই পরিস্থিতিতে সাক্ষরজ্ঞান সম্পন্ন বলব কিনা তা ভেবে দেখার সময় এসেছে। একজন মানুষকে সাক্ষর বলা মানে তাকে একটি সার্টিফিকেট প্রদান করা যে, বর্তমান যুগের সাথে তিনি তাল মেলাতে পারছেন। কিন্তু এই পরিস্থিতিতে তিনি পারছেন না, কাজেই সাক্ষরতার সংজ্ঞা পাল্টে যাবে।

আমাদের জীবন পাল্টে গেছে, শিক্ষাদানের পদ্ধতি, শিক্ষা গ্রহণের পদ্ধতিও অনেকটাই পাল্টে গেছে। আরও একটি বিষয় এখানে চলে আসে, সেটি হচ্ছে বৈশ্বিক এই প্রেক্ষাপটে শুধু নিজের দেশের ভাষায় যদি একজন লোক সাক্ষরজ্ঞানসম্পন্ন হন, তাতে কিন্তু গ্লোবাল ভিলেজের নাগরিক হিসেবে প্রকৃত অর্থে তিনি সাক্ষরজ্ঞানসম্পন্ন নন, কারণ যেসব প্রয়োজনীয় তথ্য একজন ব্যক্তির ব্যক্তিগত, সামাজিক, রাষ্ট্রীয় ও আন্তর্জাতিক সেটি স্বাস্থ্য সম্পর্কিতই হোক আর নিরাপত্তা সম্পর্কিতই হোক তাকে কিন্তু জানতে হচ্ছে আর সেটি জানার জন্য একটি গ্লোবাল ল্যাংগুয়েজের সাথে পরিচিত তাকে হতে হচ্ছে। যেমন এখন ফেসবুক, ইউটিউব, মেসেঞ্জার ইত্যাদি সামাজিক মাধ্যমে যা কিছু শেয়ার করা হয় সেই সাক্ষরতা কিন্তু ইংরেজিতেই করতে হয়। শুধু বাংলায় করলে নির্দিষ্ট গোষ্ঠী কিংবা এলাকা বা দেশের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে। কাজেই সাক্ষরতার সংজ্ঞা এখন ব্যাপক ও বিস্তৃত হতে বাধ্য।

গোটা পৃথিবীতে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের ৭০ শতাংশের বেশি মানুষ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সংযুক্ত। তরুণদের মধ্যে এ হার আরও বেশি, প্রায় ৯০শতাংশ। বাংলাদেশে যারা ইন্টারনেট ব্যবহার করেন তাদের মধ্যে ৮০শতাংশ মানুষের রয়েছে ফেসবুক অ্যাকাউন্ট। ১৩ থেকে ১৭ বছরের ছেলেমেয়েদের মধ্যে ৬০ শতাংশের বেশি অন্তত একটি সামাজিক যোগাযোগ প্রোফাইল রয়েছে। তারা দিনে দু ঘণ্টার বেশি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যয় করে। ছাত্র-শিক্ষক, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, শিশু-কিশোর, গৃহিণী, পেশাজীবীÑএদের বেশিরভাগেরই এখন ফেসবুক অ্যাকাউন্ট রয়েছে।

বিশ্বব্যাপী ইউটিউব ব্যবহারকারী মানুষের সংখ্যা ১৫০ কোটির বেশি, হোয়াটসঅ্যাপ ১২০ কোটির বেশি। আমরা ফেসবুক ব্যবহার করছি কেন? এর উত্তর খুব সহজ। অলস দেহে সোফায় বসে কিংবা বিছানায় গা এলিয়ে দিয়ে, ফ্যানের বাতাসে কিংবা এসির মধ্যে অথবা শীতের রাতে কাঁথা কম্বলের মধ্যে লুকিয়ে ফেসবুকে চাপ দিয়ে দেখতে পাচ্ছি কানাডা কিংবা অস্ট্রেলিয়ার কোন বন্ধু কি করছেন, সেখানকার আবহাওয়া, রাজনৈতিক পরিস্থিতি, আমেরিকায় রাস্তায় কি হচ্ছে ইত্যাদি থেকে শুরু করে দেশের কোন জেলায় কি হচ্ছে, রাজধানীর কোন এলাকায় কি হচ্ছে, কোন সন্ত্রাসী ধরা পড়েছে, কেন পড়েছে, কীভাবে ধরা পড়েছে, কোন আত্মীয় বা বন্ধু-বান্ধবের কি কি সুসংবাদ এসেছে, কি কি দুঃসংবাদ হলো সবই এখন হাতের মুঠোয় দেখতে পাচ্ছি ফেসবুকের কল্যাণে। এ বিষয়গুলোকে সাক্ষরতার অবিচ্ছেদ্য অংশ ধরে নিলে সাক্ষরতার হার কত হবে সে হিসেব নিশ্চয়ই আমাদের কোথাও সেভাবে নেই।

ডিজিটাল সভ্যতার এই যুগে সাক্ষরতাকে ভিন্নভাবে সংজ্ঞায়িত করতে হবে। ডিজিটালি পিছিয়ে পড়া দেশগুলোকে সেদিকে বিশেষ নজর দিতে হবে। গ্লোবাল বিশ্বে সাক্ষরতার গুরুত্ব অপরিসীম। এর আত্মিক গুরুত্বের বাইরেও শিক্ষা একটি অধিকার হিসেবে, সাক্ষরতা একজন মানুষকে ক্ষমতায়িত করে, জীবনমান বৃদ্ধিতে সহায়তা করে এবং এটি টেকসই উন্নয়নের চালিকাশক্তি। আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা দিবস মানবকেন্দ্রিক পুনরুদ্ধারের শক্ত ভিত গড়তে অবদান রাখে। সাক্ষরতা ও ডিজিটাল দক্ষতা এখন প্রয়োজন নিরক্ষর যুবক ও তরুণদের। এটি আরও আবিষ্কার করবে যে টেকনোলজি সমৃদ্ধ সাক্ষরতা, কাউকে বাদ দিয়ে নয়।

সামিটের তথ্য অনুযায়ী আমরা আধুনিক ইতিহাসের সবচেয়ে গভীর শিক্ষা সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। নিম্ন আয়ের দেশগুলোতে ১০ বছর বয়সীদের প্রায় ৭০ শতাংশ একটি সাধারণ বাক্য পড়তে বা লিখতে পারেনা এবং নিম্ন আয়ের দেশগুলোর প্রায় ৭৩ মিলিয়ন স্কুলছাত্রী ক্ষুধার্ত অবস্থায় স্কুলে যায়। গাজার পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করার জন্য অভিধানে উপযুক্ত শব্দ খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। তার মধ্যে চীনের তিয়েন আনমেন স্কোয়ারে প্রদর্শিত হয়েছে অত্যাধুনিক অস্ত্র এবং সামরিক কুচকাওয়াজ।

কোথায় ফিলিস্তিন, কোথায় গাজা আর কোথায় আফ্রিকার অভুক্ত শিশু ও যুবারা? কোথায় তাদের বাঁচার অধিকার আর কোথায় সাক্ষরতার অধিকার? এ বিষয়গুলো আজ আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা দিবসে অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করে ব্যক্তি থেকে রাষ্ট্র, রাষ্ট্র থেকে বিশ্বকে পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। শুধুমাত্র আলোচনা, বেলুন ফুটানো আর শুধুই আনুষ্ঠানিকতার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলে দিবসটির প্রকৃত উদ্দেশ্য ও গুরুত্ব কোনটিই বাস্তবায়িত হবে না।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়