শনিবার, ০৩ মে, ২০২৫  |   ২৪ °সে
জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয় অন্যান্য
ব্রেকিং নিউজ
  •   চাঁদপুর জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি ইউসুফ গাজী গ্রেফতার

প্রকাশ : ১১ মার্চ ২০২৫, ০৯:৫৭

নতুন যুগের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় জীবনমুখী ও প্রাসঙ্গিক উচ্চশিক্ষা

ড. মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমান
নতুন যুগের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় জীবনমুখী ও প্রাসঙ্গিক উচ্চশিক্ষা

শিক্ষা একটি দেশের অগ্রগতি ও সমৃদ্ধির চাবিকাঠি, একটি জাতি যত বেশি শিক্ষিত, তত বেশি সভ্য ও উন্নত হয়। এর জন্য বাংলাদেশকে গ্রস ন্যাশনাল ইনডেক্স, হিউম্যান অ্যাসেটস ইনডেক্স এবং ইকোনমিক ভালনারেবিলিটি ইনডেক্সের মতো বিভিন্ন সূচকেও উন্নতি করতে হবে; সবকিছুতে শিক্ষাই হবে মূলমন্ত্র। তবে তা হতে হবে নৈতিক, মূল্যসংযোজী, কর্মমুখী এবং প্রয়োজনীয় জ্ঞান ও দক্ষতার নির্মাতা। শিক্ষার লক্ষ্য শুধু মুখস্থ করে পরীক্ষা পাস করার বদলে হতে হবে ভবিষ্যৎপ্রসারী ও উদ্দেশ্যভিত্তিক। বাংলাদেশে জনসংখ্যার একটি বড় অংশ কর্মক্ষম থাকবে ২০৩০ সাল পর্যন্ত, যা আবার জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন অর্জনের বছর। বাংলাদেশ পরিবর্তনশীল বিশ্বের সঙ্গে সংগতি রাখা শিক্ষাক্রম দিয়ে বিশ্বমানের উন্নয়ন আনতে পারে, যা এই ‘জনসংখ্যাজনিত সুবিধা’কে (ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড) কাজে লাগিয়ে মানব উন্নয়ন ও অর্থনীতিতে অবদান রাখতে পারে। কর্মহীন স্নাতকদের হার এবং স্থানীয় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বৈশ্বিক অবস্থান দেখে বোঝা যায় বাংলাদেশে মানসম্মত শিক্ষার সংকট চলছে। সিইও ওয়ার্ল্ড ম্যাগাজিনের সেরা শিক্ষা ব্যবস্থাপনার দেশের তালিকায় ৯৩টি দেশের মধ্যে ভারত ও মিয়ানমার থাকলেও বাংলাদেশ নেই। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যেসব কারণে একটি সঠিক শিক্ষা সংস্কৃতি গড়ে তুলতে ব্যর্থ হয়েছে, তার দুটি হলো পাঠ্যক্রম ও ইন্ডাস্ট্রি সম্পৃক্ততা। ইন্ডাস্ট্রি কিন্তু কারখানা নয় বরং কর্মসংস্থানকারী ক্ষেত্রগুলো।

উন্নয়ন অসম্ভব যদি আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাক্রমের মাধ্যমে যোগ্য ও দক্ষ নাগরিক না বানাতে পারি। শিক্ষা একটি ব্যক্তির জ্ঞান ও চরিত্র গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে এবং এমন মানব পুঁজি তৈরি করে, যা দেশের সমৃদ্ধিতে অবদান রাখবে। তবে এর জন্য দরকার শিক্ষা ও শ্রমবাজারের চাহিদার সমন্বয়। সঠিক শিক্ষা বর্তমান চাহিদার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ জ্ঞান সরবরাহের সঙ্গে স্নাতকদের দক্ষতা, কর্মপ্রবৃত্তি ও অভিযোজনক্ষমতা দিয়ে তাদের শক্তি থেকে সম্পদ বানায়। এভাবে একটি জ্ঞানভিত্তিক সমাজ ও অর্থনীতিতে ইন্ডাস্ট্রি-একাডেমিয়া সম্পর্ক পরিসংখ্যান ব্যুরোর মতে যে ১৫ শতাংশ শিক্ষিত বেকার আছে তা হ্রাস করতেও সাহায্য করবে। একটি সাম্প্রতিক বৈঠকে প্রকাশ পায় যে অনেকে তার সনদের তুলনায় নিম্নযোগ্যতার কাজ করে। আর এদের সম্ভাবনাকে কাজে না লাগানোতে তারা রাষ্ট্র ও পরিবারের জন্য বোঝা হয়ে উঠছে। নিয়োগকর্তারা স্নাতকদের মধ্যে ঈপ্সিত দক্ষতা খুঁজে পাচ্ছে না। এটা পাঠতব্য জ্ঞান নয়। তাদের সঙ্গে কথা বলে জেনেছি তারা খোঁজেন সংশ্লেষণ, যোগাযোগ, সহযোগিতা, আত্মবিশ্বাস, শেখার প্রবৃত্তি এবং ইতিবাচক মনোভাবের মতো গুণ। ফলে শত শত বিশ্ববিদ্যালয় এবং হাজার হাজার াতক থাকা সত্ত্বেও কর্মক্ষেত্রে দক্ষ ও যোগ্য লোকের অভাব। নানা পদের জন্য অনেক সময় আমাদের প্রতিবেশী দেশগুলোয় লোক খুঁজতে হয়। সুতরাং দক্ষতাভিত্তিক শিক্ষা, মনোভাব গঠন এবং একটি সুস্থ শিক্ষা সংস্কৃতি গড়ে তুলতে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর পাঠ্যক্রমকে ঢেলে সাজানো দরকার।

অঞ্চল ফাউন্ডেশনের এক অনুসন্ধানে উঠে এসেছে যে প্রায় ৮০ শতাংশ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রী বিভিন্ন কারণে শিক্ষার মান নিয়ে অসন্তুষ্ট। আমাদের উচ্চ শিক্ষা হওয়া উচিত ছিল ব্যবহারিক ও জীবনমুখী। ২০১০ সালের জাতীয় শিক্ষানীতি উল্লেখ করেছে যে অর্থনৈতিক ও সামাজিক অগ্রগতি অর্জনের জন্য শিক্ষা হতে হবে সৃজনশীল ও প্রয়োগযোগ্য। শিক্ষার্থীদের কাজের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ও আগ্রহী করতে হবে। ছাত্রছাত্রীদের উচ্চ শিক্ষার মূল্য ও উদ্দেশ্য বুঝতে হবে, যাতে তারা সুশৃঙ্খলিত হয় আর ব্যক্তিগত পরিবর্তনের বড় চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার জন্য প্রস্তুতি নিতে পারে। সুতরাং এ ধরনের গুণগত পরিবর্তনে বিষয়ভিত্তিক পাঠ্যক্রমের সংস্কার করে সামগ্রিকভাবে শেখার ফলাফল, পাঠদান-শিক্ষা কার্যক্রম এবং মূল্যায়নের ওপর মনোযোগ দেয়া উচিত। শিক্ষাকে জাতীয় সংস্কারের জন্য ব্যবহার করতে এর গুণমান উন্নত করার পাশাপাশি আমাদের শিক্ষার্থীদের মানবিক শিক্ষার ওপরও মনোযোগ দিতে হবে। পাঠ্যক্রমে নৈতিকতা, মানবাধিকার, সামাজকল্যাণ এবং বৈশ্বিক সচেতনতার ওপর জোর দিয়ে দেশপ্রেমিক সুনাগরিক এবং নেতা তৈরি করা যায়। এটি সাধারণ শিক্ষা (এঊফ) কোর্স, সহশিক্ষা কার্যক্রম এবং দলগত কার্যক্রমের মাধ্যমে অর্জন করা সম্ভব। এমনটি রয়েছে সম্প্রতি চালু করা ঙইঊ (আউটকাম-বেজড এডুকেশন) শিক্ষাপদ্ধতিতে যাতে পড়ানো-শেখানো ও ছাত্রদের সেবা দেয়ার মতো কাজগুলোকে গতিশীল ও কার্যকর করার কথা রয়েছে। তবে অনেক অংশীজনের অজ্ঞতা ও অনীহার কারণে ওবিইর পরিপূর্ণ সুবিধাগুলো আহরিত হচ্ছে না।

ওবিই পদ্ধতিতে অধ্যয়নের বিষয়গুলোর চেয়ে অধিক গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে অধ্যয়নাহরিত জ্ঞানকে শিক্ষার্থীদের ব্যবহার করতে শেখানো (লার্নিং), যেন তা হয় প্রায়োগিক ও টেকসই। এমন প্রদর্শনযোগ্য ও পরিমাপযোগ্য সক্ষমতাই হলো “লার্নিং আউটকাম। সুতরাং একটি পাঠতব্য বিষয়ের কাঙ্ক্ষিত ফলাফলটি (আউটকাম) প্রথমে নির্দিষ্ট করে তারপর তা অর্জনের লক্ষ্যে শ্রেণীকক্ষের ভেতরে ও বাইরে কার্যক্রম নিতে হবে। এর সঙ্গে কার্যকর ও সমকালীন মূল্যায়ন কৌশলের মাধ্যমে শিক্ষার্থীর প্রকৃত শেখাকে পরিমাপ করাও অপরিহার্য। বিষয়বস্তুনির্ভর এবং মুখস্থ করা বিদ্যা যাচাইকারী প্রথাগত পরীক্ষা পদ্ধতির ওপর অতিরিক্ত নির্ভরতা শিক্ষার্থীদের সৃজনশীলতা ও বিশ্লেষণ ক্ষমতাকে রুদ্ধ করে দিচ্ছে। যেমন ইতিহাস পরীক্ষায় সিরাজউদ্দৌলার রাজত্বকালের বর্ণনা না চেয়ে জানতে চাইতে হবে তার পরাজয়ের কারণগুলোর বিশ্লেষণ। পুঁথিগত বিদ্যা দিয়ে বাস্তব জীবনের সমস্যাগুলো সবসময় সমাধান করা যায় না। সমস্যাভিত্তিক এবং প্রকল্পভিত্তিক মূল্যায়ন শিক্ষার্থীদের বাস্তব জীবনে জ্ঞান ও দক্ষতা প্রয়োগের জন্য প্রস্তুত করতে পারে। অনেক পেশায় চাকরির অপেক্ষা না করে, বরং তারা স্বনিযুক্ত হতে পারে এবং কর্মকেন্দ্রিক শিক্ষা থাকলে চাকরি খুঁজতে হয় না।

দেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা বৃদ্ধি পেলেও উচ্চ শিক্ষার মান বাড়েনি। ২০২৪-এর বিপ্লবোত্তর সুবাতাসে আমাদের শিক্ষা সংস্কারেও মনোযোগী হতে হবে, যাতে স্নাতকদের সক্ষমতা আর প্রতিষ্ঠানের গুণগত মান বৃদ্ধি পায় এবং তারা একুশ শতকের চ্যালেঞ্জ নিতে পারে। আমাদের উচ্চ শিক্ষা জীবনমুখী এবং দেশের জন্য প্রাসঙ্গিক করতে হবে। একটি মানসম্মত এবং উদ্দেশ্যসংবলিত শিক্ষা শিক্ষার্থীদের সামগ্রিকভাবে গড়ে তুলবে, যেন তারা পরিপূর্ণ (সব গুণ ও জ্ঞানে সমৃদ্ধ) এবং সম্ভাবনাময় (জীবনধারণ এবং সমাজ নির্মাণে অবদান রাখাতে সক্ষম) হতে পারে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় উদ্ভাবন ও সৃজনশীলতার জন্য যথেষ্ট সুযোগ থাকবে, যাতে সবাই দরকারি জ্ঞান এবং দক্ষতা অর্জন করতে পারে এবং চরিত্র পরিশীলিত করতে পারে। পরিবেশ এমন হবে যাতে শিক্ষার্থীরা শেখার প্রক্রিয়ায় সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করতে পারে এবং স্থায়ী প্রথিত সঠিক দক্ষতা ও কর্মস্পৃহা অর্জন করতে পারে। প্রতিটি শিক্ষার্থীকে একাকী ও দলবদ্ধভাবে তার পরিবার ও বৃহত্তর সম্প্রদায়ে অবদান রাখতে হবে। তাদের কাছে আত্ম-উন্নয়ন এবং জীবনব্যাপী শেখার সুযোগ থাকবে। তারা কর্মজীবনের জন্য এভাবে প্রস্তুত হবে যেন যেকোনো পরিস্থিতিতে ইতিবাচক মনোভাব নিয়ে খাপ খাইয়ে অবদান রাখতে পারে। জাতীয় ও বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে জীবনমুখী এবং আধুনিক উচ্চ শিক্ষা ব্যবস্থা তৈরি করা অপরিহার্য যাতে আমরা একটি প্রতিযোগিতামূলক, উদ্ভাবনী এবং অগ্রগামী জাতি গড়ে তুলতে পারি। মোদ্দাকথা শিক্ষা শুধু গুটিকয় বই পড়ায় সীমাবদ্ধ থাকলে চলবে না। বরং পাঠ্যসূচি পুনর্গঠন করে পড়ানো-শেখানোর কার্যক্রম, যা করার মাধ্যমে শিক্ষকরা শিক্ষার্থীদের ঈপ্সিত ‘আউটকাম’ অর্জন করতে পারে, তা শক্তিশালী করা গুরুত্বপূর্ণ।

উচ্চ শিক্ষার প্রধান উদ্দেশ্য হলো শিক্ষাদানের পাশাপাশি গবেষণার মাধ্যমে নতুন জ্ঞান সৃষ্টি, শিক্ষার্থীদের প্রয়োজনীয় ও নির্ধারিত কাজ করার দক্ষতা বৃদ্ধি এবং সেই জ্ঞান ও দক্ষতাকে সমাজে প্রয়োগের সুযোগ সৃষ্টি করা। যোগ্য ও শিক্ষিত স্নাতক জাতীয় উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। আর তাই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে হতে হবে এমন অগ্রসর ও ইতিবাচক মানব এবং উদ্ভাবনের সূতিকাগার আর জাতীয় উন্নয়নের কেন্দ্রভূমি। সমাজ ও রাষ্ট্রের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে শিল্প, সংস্কৃতি, ব্যবসা এবং বাণিজ্য, এমন সব খাতের সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখতে হবে যাতে জীবনমুখী কার্যক্রম শিক্ষার সম্পূরক হয়ে ওঠে। বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে উচ্চমানের প্রতিষ্ঠানে পরিণত করতে, আমাদের পাঠ্যক্রমকে জীবনমুখী করার পাশাপাশি জোর দিতে হবে গবেষণালব্ধ জ্ঞানের ওপর। আহরিত জ্ঞান বিতরণের সঙ্গে সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো শিল্প ও অর্থনীতির অগ্রগতিতেও অবদান রাখবে এবং দেশীয় ও আন্তর্জাতিক কর্মকাণ্ডে সমঅংশগ্রহণকারী তৈরি করবে। বৃহত্তর কর্মক্ষেত্র ও বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যকর মেলবন্ধন শিক্ষার্থীদের দক্ষ, সৃজনশীল ও উদ্ভাবনী চিন্তার অধিকারী হয়ে বিভিন্ন ক্ষেত্রে তাদের যোগ্যতা প্রমাণ করার সুযোগ দেবে। শিল্প-বাণিজ্য-যোগাযোগ-নির্মাণ-বিজ্ঞান ক্ষেত্র যার যার সমস্যা নিয়ে আসবে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যারা জ্ঞান-অভিজ্ঞতা ও গবেষণার মাধ্যমে তার সমাধান দেবে। এটি উভয় পক্ষের জন্য হবে একটি জয়-জয় পরিস্থিতি।

আমি ১৯৮৬ সালে যুক্তরাজ্যে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রস্তাব তৈরি শিখতে গিয়ে ‘টাউন ও গাউন’ ধারণার সঙ্গে পরিচিত হই। বাংলাদেশের চাকরিদাতা এবং একাডেমিকদের মাঝে সহযোগিতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যক্রমকে কর্মক্ষেত্র এবং বাস্তব জীবনের চাহিদার সঙ্গে মেলানোর একটি উপায়। ন্যূনতম যা করা যায় তা হলো বর্তমান ও ভবিষ্যৎ চাকরিদাতাদের নিয়মিত মতামত ও তথ্যের ভিত্তিতে স্নাতকদের জ্ঞান ও দক্ষতাকে যুগোপযোগী রাখা। চাকরিদাতারা জানাবে ভবিষ্যতে কর্মক্ষেত্রে কী কী দক্ষতার প্রয়োজন উদ্ভূত হবে এবং বর্তমান স্নাতকদের দুর্বলতাগুলো (যা শিক্ষাক্রম পুনর্গঠনে দিশারি হবে), নবউদ্ভাবিত প্রযুক্তি, আর কোথায় তারা বিদেশ নির্ভরশীল। অন্যদিকে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও বুঝতে পারবে কী কী অচল বিষয় বাদ দিয়ে কোন কোন অধুনা বিষয় ছাত্রদের শেখাতে হবে; একই সময়ে, শিক্ষকদের নতুন নতুন জ্ঞান ও প্রযুক্তি আয়ত্ত ও ব্যবহার করতে হবে। এভাবে পাঠ্যক্রম স্থবির না থেকে একটি জীবন্ত বিষয় হয়ে ক্রমাগত উন্নত হয় এবং শ্রমবাজারের জন্য প্রাসঙ্গিক থাকে, যাতে চাকরির জন্য প্রস্তুত বা স্বনিয়োজিত স্নাতক পেতে অসুবিধা না হয়। এভাবে শিক্ষা কার্যক্রম তৈরি করার সঙ্গে মধ্যপ্রাচ্যে আমি জড়িত ছিলাম সিকি শতাব্দী আগেই। অথচ এখনো আমাদের দেশে পাঠ্যক্রম তৈরির এ কৌশলকে ঠিকমতো কাজে লাগানো হচ্ছে না।

চাকরিদাতা প্রতিষ্ঠানগুলো বিশ্ববিদ্যালয়ের লব্ধজ্ঞান ব্যবহার করে ক্ষুরধার প্রযুক্তি বা আধুনিক তত্ত্ব বা প্রক্রিয়া উদ্ভবে এবং প্রয়োগমূলক বিষয়ের গবেষণা ও উন্নয়নে সহযোগিতা দিতে পারে। সব উন্নত দেশে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো প্রযুক্তি ও চিন্তাভাবনা উদ্ভাবনের সূতিকাগার হিসেবে বিবেচিত হয়। সর্বোন্নত দেশ যুক্তরাষ্ট্রের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি তৈরি হয় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর গবেষণাগারে। নোবেল বিজয়ীরা আসে সেখান থেকেই, শিল্প-কারখানা, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান বা সেনাবাহিনী থেকে নয়, যারা মূলত কাজে লাগাচ্ছে সেই জ্ঞান বা প্রযুক্তিকে। তারা বরং গবেষণা ও উন্নয়নের জন্য তহবিল প্রদান করে, যার ফল তাদের কাজে লাগে। আবার বিশ্ববিদ্যালয় যখন নতুন জ্ঞান বা প্রযুক্তি উৎপন্ন করে, এ প্রতিষ্ঠানগুলো তখন বাণিজ্যিকীকরণে সহায়ক হতে পারে। সেজন্য বিশ্বের সেরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ‘পেটেন্ট’ করা বা ‘স্পিন অব কোম্পানি’ তৈরি করার জন্য সাহায্য করে, যাতে একাডেমিকরা নতুন জ্ঞান অনুসন্ধানে আগ্রহী হয়ে ওঠে এবং শিক্ষার্থী ও সহকর্মীদের মধ্যে তা আত্মস্থ করতে পারে।

‘টাউন ও গাউন’-এর তৃতীয় সুবিধা হবে শিক্ষানবিশ হিসেবে প্রশিক্ষণ দিয়ে শিক্ষার্থীদের কর্মক্ষেত্রের প্রয়োজনীয়তা অনুযায়ী যোগ্য করে তোলা। যেমনটি আহছানউল্লা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় দেশের বড় কয়েকটি শিল্প প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে মিলে করছে। দেশে কিছু পেশাগত শিক্ষায় ছাড়া শিক্ষানবিশ থাকার ধারণাটি পোক্ত নয়। অথচ বিশ্বের আদি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এ কারণেই তৈরি হয়। শিক্ষানবিশি, প্রশিক্ষণ, যৌথ প্রকল্প ও শিক্ষাসফরের মাধ্যমে ভবিষ্যৎ স্নাতকরা তাদের সম্ভাব্য কর্মস্থলের পরিবেশ, প্রক্রিয়া ও চ্যালেঞ্জের সঙ্গে পরিচিত হয় এবং ব্যবহারিক অভিজ্ঞতাও অর্জন করে। সহযোগিতার মনোভাব ও যোগাযোগ ক্ষমতার মতো ‘সংবেদনশীল দক্ষতা’ অর্জনের মাধ্যমে তারা কর্মোপযোগিতা বাড়াতে এবং শক্তিশালী কর্মজীবন গড়তে সক্ষম হতে পারে।

শিক্ষা উপদেষ্টা বলেছেন যে আমরা উপযুক্ত মানবসম্পদ তৈরিতে ব্যর্থ হয়েছি। স্বাধীনতার ৫৪ বছর পরও আমরা একাধিক শিক্ষানীতির মধ্যে দুলছি। কারণ প্রত্যেক শিক্ষামন্ত্রীই তার নিজস্ব নীতি নিয়ে আসতে উৎসাহী! এটা সত্যি যে শিক্ষা ক্ষেত্রে মৌলিক পরিবর্তন প্রয়োজন; আমাদের শুধু পুঁথিগত জ্ঞানের পেছনে না দৌড়ে কাজকেন্দ্রিক এবং গুণাবলি অর্জনকারী কল্যাণময় শিক্ষা প্রতিষ্ঠা করতে হবে। শিক্ষার্থীদের মানবিক উৎকর্ষ বৃদ্ধির পাশাপাশি আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে বৈশ্বিক জ্ঞান কেন্দ্র হিসেবে পরিণত হওয়ার লক্ষ্য রাখতে হবে। চতুর্থ প্রযুক্তিগত বিপ্লব ঘটাতে প্রয়োজন দক্ষ ও শিক্ষিত জনগোষ্ঠী। ব্যক্তিগত, সামাজিক ও জাতীয় চাহিদার সঙ্গে সাযুজ্য রেখে বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো হতে পারে এমন অগ্রগতি এবং উন্নয়নের গুরুত্বপূর্ণ চালিকাশক্তি, পাশাপাশি বিশ্বমানের শিক্ষা ও দক্ষতা প্রদানের কেন্দ্র। শিক্ষার্থীদের বিপ্লব ও সম্প্রতি শুরু হওয়া সংস্কার উদ্যোগগুলো আশা জাগিয়েছে একটি কর্মক্ষমতা ও নৈতিকতা উদ্রেক করা শক্তিশালী শিক্ষা ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করার, যা বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে ক্রমাগত বিকশিত হবে এবং পরিপূর্ণ ও সুযোগ্য মানুষ ও সেবাদায়ী নেতা তৈরি করবে।

ড. মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমান : উপ-উপাচার্য, আহছানউল্লা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়