প্রকাশ : ১২ মে ২০২৫, ০৪:৩২
পেঁয়াজ কাটতে কাটতেই গড়ে উঠেছে ‘আব্দুল ওহাব হোটেল’: এক নিঃশব্দ সংগ্রামের গল্প

পেঁয়াজ কাটতে কাটতেই গড়ে উঠেছে ‘আব্দুল ওহাব হোটেল’: এক নিঃশব্দ সংগ্রামের গল্প
|আরো খবর
বিশেষ প্রতিনিধি: মোঃ জাকির হোসেন, কক্সবাজার থেকে ফেরার পথে
এক হাতে পেঁয়াজ, অন্য হাতে ছুরি—চোখে পানি ঝরলেও মুখে ক্লান্তির ছাপ নেই। বয়সের ভারে নুয়ে পড়া এক মানুষ, কিন্তু মনোবলে তিনি এখনো অদম্য। এই মানুষটির নাম আব্দুল ওহাব। হ্যাঁ, তিনি শুধু পেঁয়াজ কাটেন না, তিনিই এই ছোট্ট, জনপ্রিয় ‘আব্দুল ওহাব হোটেল’-এর প্রতিষ্ঠাতা এবং স্বত্বাধিকারী।
ছবির উপরের অংশে দেখা যাচ্ছে, একটি সাদামাটা টিনশেড দোকানের এক কোণে বসে আছেন এক বৃদ্ধ। সামনের কাঠের টেবিলে বিশাল থালা ভর্তি পেঁয়াজ, পেছনে ঝুলছে মেন্যু বোর্ড। সামনে রাখা হ্যান্ড স্যানিটাইজার, পানির বোতল আর রান্নার উপকরণ। যাঁকে দেখছেন, তিনিই আব্দুল ওহাব—এই হোটেলের মালিক, কর্মী, ব্যবস্থাপক—সবই একসাথে।
নিচের ছবিতে দেখা যাচ্ছে লেখক মোঃ জাকির হোসেন তাঁর ঘনিষ্ঠ চার বন্ধুদের নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন হোটেলের সামনে। পেছনে লেখা ঝলমলে লাল সাইনবোর্ডে স্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে হোটেলের নাম—“আব্দুল ওহাব হোটেল”। সঙ্গী বন্ধুরা হলেন—সহকারী অধ্যাপক মামুন, সহকারী অধ্যাপক হুমায়ুন কবির, সহকারী অধ্যাপক প্রণব কুমার দে, লেখক নিজে, প্রভাষক মোঃ রাসেল। এই ভ্রমণের আরো সঙ্গী ছিলেন সহকারী অধ্যাপক নজরুল ইসলাম, অধ্যক্ষ মো. মোশারেফ হোসেন। কক্সবাজার থেকে ফেরার পথে তাঁরা এসেছিলেন হোটেলে খেতে। এ যেন বন্ধুত্বের ভ্রমণের সাথে এক অনুপ্রেরণার সাক্ষাৎ।
একজন ক্রেতা বলেন, “আজ আমি খাবার খেতে এসে প্রায় আধা ঘণ্টা বসে আছি। এতটাই ভিড়! বোঝা যাচ্ছে, লোকজনের আস্থা ও ভালোবাসায় ভর করে আজ এই হোটেল এখানে পৌঁছেছে।”
একটি নিঃশব্দ সংগ্রামের প্রতীক
এই হোটেলটি শুধুমাত্র একটি খাবারের দোকান নয়, এটি শ্রম, সাধনা আর আত্মসম্মানের এক নিদর্শন। অধিকাংশ হোটেল মালিক যেখানে নিজেকে ‘ম্যানেজার’ পরিচয়ে পরিচিত করেন, সেখানে আব্দুল ওহাব নিজের হাতেই পেঁয়াজ কাটেন, অতিথিদের জন্য পরিবেশনা প্রস্তুত করেন। এই কাজের মধ্যে লুকিয়ে আছে তাঁর স্বপ্ন, তাঁর আত্মত্যাগ, তাঁর আত্মমর্যাদা।
বড় কোনো রেস্টুরেন্টের গ্ল্যামার এখানে নেই, নেই ঝাঁ-চকচকে পরিবেশ। তবে আছে মাটির গন্ধ, মানুষের প্রতি ভালোবাসা, আর আত্মনির্ভরশীল জীবনের দৃঢ় প্রত্যয়।
হোটেলের ভেতরে সজ্জিত মেন্যু বোর্ড, বাইরের পরিচ্ছন্নতা, পানির সুব্যবস্থা—সব কিছুই প্রমাণ করে, আব্দুল ওহাব তাঁর সামর্থ্য অনুযায়ী সর্বোচ্চ চেষ্টা করেন একটি সম্মানজনক ও স্বাস্থ্যকর পরিবেশ ধরে রাখতে।
বড় স্বপ্নের শুরু ক্ষুদ্র ঘর থেকে
যে সমাজে অধিকাংশ মানুষ বড় হতে চায় সুবিধা আর চটকদার জীবনের দিকে ঝুঁকে, সেখানে আব্দুল ওহাব একটি ব্যতিক্রমী দৃষ্টান্ত। তাঁর মতো মানুষরা দেখিয়ে দেন, একজন মানুষ চাইলে নিজের হাতের ঘাম দিয়েই গড়ে তুলতে পারেন একটি প্রতিষ্ঠান, একটি বিশ্বাস, একটি স্থায়ী স্থান।
এই হোটেলের সুনাম কেবল খাবারের জন্য নয়, বরং তার মালিকের সততা, পরিশ্রম ও আন্তরিকতার জন্যও। প্রতিদিন ভোর থেকে শুরু করে গভীর রাত পর্যন্ত চলা এই হোটেলের প্রতিটি মুহূর্ত যেন একটি শ্রমের কবিতা।
বন্ধুদের চোখে আব্দুল ওহাবের হোটেল
মোঃ জাকির হোসেন ও তাঁর বন্ধুদের কক্সবাজার থেকে ফেরার পথে হোটেলটির সামনে দাঁড়ানো মুহূর্তে উঠে আসে একধরনের আবেগ। এ যেন শুধুই খাওয়া নয়—একটি প্রাণবন্ত জীবনের সাক্ষাৎ।
একজন বন্ধু বলেন, “আমরা অনেকদিন পর একসাথে সফরে বের হয়েছি। আর এই হোটেলে এসে মনে হলো, জীবনের ছোট ছোট সংগ্রামই আসলে বড় গল্পের জন্ম দেয়।”
নীরব বিজয়ের গাঁথা
এই প্রতিবেদন কেবল একটি হোটেলের গল্প নয়। এটি একজন মানুষের অদম্য পরিশ্রম, আত্মবিশ্বাস, ও স্বপ্নের দলিল। সমাজের প্রতিটি প্রান্তে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা এই রকম ছোট ছোট গল্পগুলোই আমাদের সমাজের আসল রত্ন।
আব্দুল ওহাব ও তাঁর হোটেল আমাদের মনে করিয়ে দেয়—মানুষের প্রেরণা শুধু বিলাসিতা কিংবা উচ্চশিক্ষায় সীমাবদ্ধ নয়। বরং কখনো কখনো একটি ছুরি, একটি পেঁয়াজ আর এক মুঠো স্বপ্নই পারে গড়ে তুলতে এক নিরব সংগ্রামের বিজয়গাথা।
ডিসিকে/এমজেডএইচ