মঙ্গলবার, ২৮ অক্টোবর, ২০২৫
জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয় অন্যান্য

প্রকাশ : ২৮ অক্টোবর ২০২৫, ০৮:৩১

গ্রামীণ খেলাধুলা বিলুপ্তির পথে

পুনর্জাগরণের প্রচেষ্টাই আশার আলো

আলমগীর তালুকদার
পুনর্জাগরণের প্রচেষ্টাই আশার আলো

আবহমান গ্রাম বাংলার স্বাধীনতা-পূর্ববর্তী গ্রামীণ খেলাগুলোর মধ্যে হা-ডু-ডু, দাঁড়িয়াবান্দা (রেডি খেলা), গোল্লাছুট, ফুটবল, ঘুড়ি ওড়ানো, কেরাম বোর্ড, কানামাছি, চোখ পলান্তি, ডাংগুলি (কইটবাড়ি), মার্বেল খেলা, ফুটবল, ভলিবল, কুস্তি, নৌকা বাইচ, বউচি, লাঠি খেলা, লাঠিম খেলা উল্লেখযোগ্য। এসব খেলা কালের বিবর্তনে হারিয়ে যেতে বসেছে। আধুনিক প্রযুক্তি, ডিজিটাল বিনোদন ও মোবাইলে আসক্ত তরুণ সমাজের কারণে ছেলেমেয়েরা সময় পেলেই ঘরে বসে মোবাইলে বিভিন্ন গেম খেলায় আসক্ত হয়ে পড়েছে। খেলার মাঠের অভাব, অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিবর্তন, নগরায়ন ও পরিবেশগত পরিবর্তন ও মিডিয়া প্রচারের অভাবে বাংলার ঐতিহ্যবাহী গ্রামীণ খেলা হারিয়ে যেতে বসেছে।

কচুয়ার মুক্তিযোদ্ধা সালাউদ্দিন মানিক (৭০) একজন ক্রীড়ামোদী মানুষ। নিজে একজন ফুটবল খেলোয়াড় ও রেফারি হিসেবে এখনও দায়িত্ব পালন করছেন। তাঁর মতে, বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের আগে থেকে গ্রাম বাংলার প্রায় প্রতিটি জনপদে হা-ডু-ডু, দাঁড়িয়াবান্দা, গোল্লাছুট, ফুটবল, ঘুড়ি ওড়ানো, কেরাম বোর্ড, কানামাছি ভোঁ-ভোঁ এসব খেলা বেশ জনপ্রিয় ছিলো। ওই সময় পৌষে ধান কাটার পর ৪ মাস জমি খালি থাকতো। তখন দল বেঁধে সবাই হা-ডু-ডু, দাঁড়িয়াবান্দা, গোল্লাছুট, ফুটবল খেলতো। ঘুড়ি বানানো ও ঘুড়ি খেলা বেশ আনন্দদায়ক ছিলো। কাগজ ও বাঁশ দিয়ে ঘুড়ি বানানো শেষে ঘুড়ির লেজ তৈরি করতাম মায়ের পরিত্যক্ত শাড়ির পাইর দিয়ে। ঘুড়ি ওড়ানো দেখতে দূর-দূরান্ত থেকে লোকজন ভিড় জমাতো। আবহমান ঘুড়ি উৎসবও হতো। এখন আর সেই ঘুড়ি ওড়ানো চোখে পড়ে না। তার মতে, আশির দশকের পর ক্রমান্বয়ে আবহমান বাংলার এসব খেলা হারিয়ে যাচ্ছে। এ সময়টিতে ফুটবল ও ক্রিকেট খেলা জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে।

কচুয়া সরকারি ডিগ্রি কলেজের শরীরচর্চা শিক্ষক ও রোভার এবং স্কাউট লিডার বিপ্লব কুমার সাহা জানান, একসময় বাংলাদেশের প্রতিটি গ্রাম ছিলো প্রাণবন্ত, মাঠে শিশুদের হাসির শব্দ, দৌড়ের আওয়াজ, আর হা-ডু-ডুর উচ্ছ্বাসে মুখরিত থাকতো চারপাশ। বিকেলের রোদে লাঠি খেলার ঝাঁপাঝাঁপি, গোল্লাছুটের কৌশল, কানামাছির হাস্যরস—সব মিলিয়ে গ্রামীণ জীবন ছিলো আনন্দমুখর। কিন্তু এখন সেই দৃশ্য শুধুই স্মৃতি। আধুনিক প্রযুক্তি, শহুরে জীবনযাত্রা ও মাঠের অভাবে হারিয়ে যাচ্ছে প্রাচীন খেলাধুলার ঐতিহ্য। গ্রাম বাংলার বহু ঐতিহ্যবাহী খেলা হা-ডু-ডু (বর্তমানে কাবাডি রূপে স্থান করে নিয়েছে), দাঁড়িয়াবান্দা, গোল্লাছুট, লাঠিখেলা, দড়ি টানাটানি, নৌকা বাইচ, বউচি, ঘুড়ি উড়ানো, বলিখেলা, ছক্কা-ছক্কি, পাঁচগুটি ইত্যাদি। এসব খেলাধুলা শুধু বিনোদন নয়, বরং সমাজের ঐক্য, সাহস ও পরিশ্রমের প্রতীক। হা-ডু-ডু খেলায় দলগত শৃঙ্খলা, লাঠিখেলায় আত্মরক্ষার কৌশল, আর নৌকা বাইচ ছিলো সহযোগিতা ও উৎসবের প্রতীক। সব মিলিয়ে গ্রামীণ খেলায় ছেলেমেয়েদের শারীরিক ও মানসিক বৃদ্ধি, মানসিকতার বিকাশ ঘটিয়ে বিপথগামিতা থেকে রক্ষা করতো।

গ্রামীণ বাংলার এই খেলাগুলোর সঙ্গে যুক্ত ছিলো গান, ঢাক-ঢোল, দর্শকের উচ্ছ্বাস, আর এক টুকরো সামাজিক বন্ধন। আজকের প্রজন্ম প্রায়ই ভুলে গেছে। খেলাগুলোর বিলুপ্তির পেছনে রয়েছে একাধিক কারণ ছেলেমেয়েরা প্রযুক্তিনির্ভর জীবনধারায় অভ্যস্ত হয়ে স্মার্টফোন, ভিডিও গেম, ইউটিউব ও টিকটকে আসক্ত হয়েছে। শিশু-কিশোররা মাঠছাড়া হয়ে পড়েছে। খেলার মাঠের অভাবে, নগরায়ন ও জনসংখ্যা বৃদ্ধিতে মাঠ ও খোলা জায়গা হারিয়ে যাচ্ছে। পড়াশোনার ব্যস্ততা ও নিরাপত্তা-সংকটে পিতামাতার চাপে সন্তানরা মাঠে যেতে নিরুৎসাহিত হচ্ছে। ফলে পশ্চিমা সংস্কৃতির প্রভাবে ক্রিকেট, ফুটবল, বাস্কেটবলের জনপ্রিয়তায় স্থানীয় খেলাগুলোর গুরুত্ব হারিয়ে যাচ্ছে। প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগের অভাবে বিদ্যালয়, কলেজ ও সরকারি পর্যায়ে লোকজ খেলাধুলা সংরক্ষণের উদ্যোগ নেই। ফলে এই খেলা আজ কেবল বইয়ের পাতায়, ইতিহাসের আলোচনায় আর প্রবীণদের স্মৃতিতে টিকে আছে।

তিনি জানান, সম্প্রতিক সময়ে সীমিত আকারে বিভিন্ন স্কুল, স্কাউট সংগঠন, সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান ও স্থানীয় প্রশাসন লোকজ ক্রীড়ার পুনরুজ্জীবন কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। স্কাউট দলের বার্ষিক ক্যাম্প, বিদ্যালয়ের ক্রীড়া প্রতিযোগিতা, বৈশাখী মেলা কিংবা উপজেলা পর্যায়ের উৎসবে আবারও দেখা যাচ্ছে হা-ডু-ডু, লাঠিখেলা, দড়ি টানাটানি জাতীয় পুরানো খেলা। উপজেলা প্রশাসন, জেলা ক্রীড়া সংস্থা ও বিভিন্ন স্কাউট গ্রুপ একত্রে কাজ করছে এই ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনতে। যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয় এবং পাঠ্যক্রমে লোকজ খেলাধুলার ইতিহাস অন্তর্ভুক্ত করার উদ্যোগ গ্রহণ করলে গ্রাম বাংলার সংস্কৃতি ও গ্রামীণ খেলা পুনরায় প্রাণ ফিরে পেতে পারে।

কচুয়া সরকারি শহীদ স্মৃতি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক ও উপজেলা ক্রীড়া সংস্থার সাবেক সাধারণ সম্পাদক সনতোষ চন্দ্র সেন, যিনি দীর্ঘ বহু বছর ধরে খেলাধুলার সঙ্গে সম্পৃক্ত, তাঁর মতে, গ্রাম বাংলার প্রাচীন খেলাধুলা আমাদের সংস্কৃতির ঐতিহ্য। এই ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনতে সরকারি ব্যবস্থাপনায় বিদ্যালয়গুলোতে লোকজ ক্রীড়া দিবস ও বার্ষিক প্রতিযোগিতা চালু করা উচিত। টেলিভিশন ও সামাজিক মাধ্যমে এসব খেলার প্রচার বাড়ানো প্রয়োজন। জেলা পর্যায়ে ‘লোকজ ক্রীড়া উৎসব’ আয়োজন, খেলাধুলার মাঠ সংরক্ষণে প্রশাসনিক নির্দেশনা, স্কাউট, গার্লস গাইড ও রোভার দলের মাধ্যমে মাঠভিত্তিক উদ্যোগ এবং পরিবার ও অভিভাবকদের সচেতনতা বৃদ্ধি—সবই জরুরি। শিশুকে মাঠে খেলতে উৎসাহিত করতে হবে।

তিনি বলেন, বাংলাদেশের প্রাচীন খেলাধুলা শুধু বিনোদনের মাধ্যম নয়, বরং জাতির ঐতিহ্য, শিকড় ও সংস্কৃতির প্রতিচ্ছবি। যদি এখনই সবাই এগিয়ে আসে—সরকার, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, গণমাধ্যম—সঠিকভাবে প্রচার করা হয়, তবে আবারও ফিরবে সেই চিরচেনা বাংলার পুরানো দিনের খেলাধুলা। মাঠে দেখা যাবে শিশুর হাসি, দৌড়ের আওয়াজে ফিরবে হা-ডু-ডু খেলা। হারিয়ে যাওয়া খেলাধুলার পুনর্জাগরণের মধ্য দিয়েই টিকে থাকবে বাংলার ঐতিহ্য ও আমাদের জাতীয় পরিচয়। দলগত শৃঙ্খলা, ছেলেমেয়েদের মধ্যে গড়ে উঠবে প্রতিযোগিতার মনোভাব। টিকে থাকবে আমাদের হারিয়ে যাওয়া গ্রাম বাংলার খেলাধুলা।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়