প্রকাশ : ১৪ অক্টোবর ২০২৫, ১০:০১
হারিয়ে যাচ্ছে ফরিদগঞ্জের লোকপ্রিয় খেলাধুলা
যে খেলায় ধুলা ছড়ায় না, সে খেলা খেলা নয়

যে খেলায় ধুলা ছড়ায় না, সে খেলা খেলা নয়। গোধূলি বেলায় ধুলোমাখা শরীর নিয়ে যে শিশু-কিশোর ঘরে ফিরে না, সে সময় বা কাল কখনোই মধুময় হতে পারে না; তাকে কখনোই দুরন্ত শৈশব বলা যায় না। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বদলে যায় আমাদের চারপাশের চিত্র। বদলে যায় সমাজ, সংস্কৃতি। প্রযুক্তির কল্যাণে দিনকে দিন আমরা হয়ে যাচ্ছি যান্ত্রিক। আগের সেই প্রাণোচ্ছল খেলাধুলার ঘটেছে অপমৃত্যু। প্রযুক্তির ছোঁয়ায় হারিয়ে যাচ্ছে আগের দিনের গ্রামীণ খেলাধুলার ঐতিহ্য। খেলা শুধু বিনোদনই ছিলো না, ছিলো শরীর চর্চার এক বিরাট মাধ্যম। যে চর্চা শিশু-কিশোর এবং যুবকদের উন্নত মন-মানসিকতা গড়ার ক্ষেত্রে নিয়ামক হিসেবে কাজ করে। খেলাধুলার ক্ষেত্র যতোটা সঙ্কুচিত হচ্ছে, আমাদের প্রজন্ম অন্যদিকে ধাবিত হচ্ছে। যা কারো জন্যে মঙ্গল নয়। এর দায় জনপ্রতিনিধি, রাজনীতিবিদ, সমাজপতি, সাংবাদিক, শিক্ষক এবং অভিভাবক কেউ এড়াতে পারবে না।
যে খেলা থাকার কথা শিশু-কিশোরদের মাঠে, রাজনীতিবিদরা সে খেলা নিয়ে গেছে রাজনীতির মাঠে! কেনো-রে ভাই, তোমাদের কি আর কোনো শব্দ নেই? তোমাদের ‘খেলা হবে’ হুংকারে সত্যিকারের খেলা ভয়ে পালিয়ে গেছে শিশু কিশোরের মাঠ থেকে। তোমাদের সে নোংরা খেলার বলি হয়ে আসল খেলা হারিয়ে গেছে।
বিংশ শতাব্দীর শেষাংশেও গ্রামের শিশু-কিশোররা পড়াশোনার পাশাপাশি মেতে উঠতো বিভিন্ন ধরনের খেলায়। বিকেলে খোলা মাঠে দস্যিপনা চালাতো শিশু-কিশোররা। যুবারা দল বেঁধে খেলতো হা-ডু-ডু, দাড়িয়াবান্ধা, কাবাডিসহ বিভিন্ন গ্রামীণ খেলা। এমনকি সেখানে স্থান পেতো বর্তমান সময়ের সবচেয়ে জনপ্রিয় খেলা ক্রিকেট, ফুটবলও। আজকে কেন হারিয়ে যাচ্ছে লোকপ্রিয় সেই খেলাধুলা? তা কি শুধুই মাঠের সংকট? নাকি অন্য কিছু?
ফরিদগঞ্জে শূন্য দশকেও অনেক গ্রামীণ খেলাধুলার চর্চা ছিলো। আস্তে আস্তে তা হারিয়ে যাচ্ছে। শিশু-কিশোররা এখনো কিছু খেলা টিকিয়ে রেখেছে। তবে অধিকাংশ লোকপ্রিয় খেলা হারিয়ে গেছে কালের গর্ভে। অথচ ঐ খেলাগুলো ছিলো মেধা বিকাশের অন্যতম মাধ্যম। সেই সাথে শরীর চর্চারও। তখন সে খেলাগুলোর মুগ্ধতা, গভীরতা, হৃদয়স্পর্শী, ব্যাপ্তি এবং সবশ্রেণির সম্পৃক্ততার এতোই ব্যাপকতা ছিলো যে, কিশোর এবং যুবকদের অন্য কিছুর চিন্তা মাথার চৌধারে আসেনি। তখনকার সামাজিক চিত্র ছিলো শুধু কাজ এবং খেলাধুলাময়। তাহলে বর্তামান চিত্র এমন কেন? এখন কেন কিশোর এবং যুবকরা নেশার জগতে চলে যাচ্ছে? এখন কেন কিশোর গ্যাং সৃষ্টি হলো? এখন কেন কিশোর যুবকরা বিপথগামী হচ্ছে? তার জন্যে কি শুধুই খেলার মাঠ সংকটই দায়ী? আমি তা মনে করি না। আমি মনে করি এর জন্যে প্রধানত দায়ী রাষ্ট্রের আইন প্রণেতাগণ (সংসদ সদস্য), এর জন্য দায়ী রাজনীতির সঠিক চর্চার অভাব, এর জন্যে দায়ী প্রযুক্তি, দায়ী শিক্ষা ব্যবস্থা, দায়ী অযোগ্য প্রশাসন, দায়ী অপরিকল্পিত নগরায়ন। এ বিষয়ে ব্যাখ্যা দিলে লেখার পরিধি এবং বিষয়বস্তু অন্য দিকে চলে যাবে। তবে দৃশ্যমান হিসেবে আমরা খেলার মাঠকেই দেখছি।
আজকের যুব এবং কিশোর সমাজ বিপথগামী হওয়ার অন্যতম কারণ, পর্যাপ্ত খেলার মাঠের অভাব। খেলার মাঠের অভাবে কিশোর-কিশোরী খেলার পরিবেশ পাচ্ছে না। ফলে, তাদের মেধার বিকাশ হচ্ছে না যথাযথভাবে। শরীরচর্চা, বিকেলের আনন্দ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। খেলাধুলার সুষ্ঠু পরিবেশ না থাকায় অনেকেই মোবাইল গেইমিংয়ে আসক্ত হয়ে যাচ্ছে। জড়িয়ে পড়ছে অনৈতিক কর্মকাণ্ডে। মোবাইলে সময় কাটাচ্ছে ঘণ্টার পর ঘণ্টা। বিভিন্ন প্রলোভনে পড়ে তৈরি হচ্ছে কিশোর গ্যাং। খেলাধুলার পরিবেশ বিলুপ্ত হওয়ার কারণে জড়িয়ে যাচ্ছে মাদকের সঙ্গে, যা সুন্দর ও সমৃদ্ধি জীবন গড়ে তুলতে বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। খেলাধুলার মাধ্যমে শরীর, মন দুটোই ভালো থাকে। খেলাধুলা কিশোরদের মনে হার মেনে নেওয়ার সক্ষমতা শেখায়, প্রতিপক্ষের প্রতি সহিষ্ণু আচরণ করতে শেখায়। খেলায় জিতলে তাদের আত্মবিশ্বাস বেড়ে যায়। নেতৃত্বের গুণাবলির বিকাশ ঘটে। খেলায় সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার কৌশল ভবিষ্যতে কিশোরদের অনেক সাহায্য করে। কাজেই, খেলার মাঠ ধ্বংসের মাধ্যমে শিশু-কিশোদের জীবনের এই সোনালি সময়কে ধ্বংস করে আগামীর দিনে ভালো নাগরিক আশা করা কতোটা যুক্তিযুক্ত?
নগরায়ন ও ক্ষুদ্র স্বার্থের কারণে খেলাধুলা করার মাঠগুলোর যে ক্ষতি হচ্ছে, তার নেতিবাচক প্রভাব সবার ওপর পড়বে না এমন নিশ্চয়তা কে দিতে পারবে? হাজারও প্রশ্ন মনে উদয় হলেও আমরা এখন নির্বাক। যেন আমাদের করার কিছুই নেই! আমরা কিশোর-কিশোরীদের একটি সুন্দর পরিবেশ দিতে পারলে আগামীর সমৃদ্ধ ও সোনার বাংলাদেশ গড়ার কারিগর হবে তারাই। অথচ আমরা যদি তাদের জীবন অঙ্কুরেই বিনষ্ট করি, তবে ভবিষ্যতে দেশে জনসংখ্যা বাড়বে, মানুষ বাড়বে না। তাই আমাদের উচিত আমাদের শিশু-কিশোরদের জন্যে ব্যক্তিগত, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে সুন্দর ও আনন্দঘন পরিবেশ তথা মুখরিত খেলার মাঠ ফিরিয়ে আনা। তাদের খেলাধুলার পরিবেশের যেন বিঘ্ন না ঘটে সেদিকে মনোযোগ দেওয়া। সেই সাথে লোকপ্রিয় কিছু কিছু খেলা রাষ্ট্রীয়ভাবে চালু করা অতীব জরুরি।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমকে নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে পরবর্তী প্রজন্মকে ভালো মানুষ হিসেবে গড়ে তোলা দুরূহ হয়ে পড়বে।
অতীতের খেলাধুলাগুলো কেমন ছিলো, তার সঠিক উত্তর তারাই দিতে পারবেন যারা সে খেলাগুলো খেলেছেন। সে সময় আনন্দ কেমন ছিলো তা তারাই অনুভব করতে পারবেন, যারা তা দেখেছেন। ফরিদগঞ্জের সে সময়গুলোতে স্কুল মাদ্রাসার মাঠ ছাড়াও শীত মৌসুমে বেশ কয়েক মাস ধরে ফসলি জমি খালি থাকতো। তাছাড়া কিছু অনাবাদী জমি থাকতোই। আবার কিছু উঁচু ভূমি থাকতো, যাকে বলা হতো ভিটা বা ছাড়া। তখনকার সময়ে ঘনবসতি ছিলো না, তাই বাড়ির উঠান থাকতো বড়ো। সাধারণত এই স্থানগুলোতেই শিশু, কিশোর-কিশোরী এবং যুবকরা খেলাধুলা করতো। আবার কিছু খেলার জন্যে প্রশস্ত মাঠের প্রয়োজন নেই। বাড়ির রাস্তাই যথেষ্ট। যেমন-মার্বেল, সাত ছাড়া, কড়ি, চার গুটি, ষোল ঘর, পাঁচ কাঠি, ধাপ্পা, দড়ি লাফ, খেজুরের বিচি আর সুপারির কড়া দিয়ে এক ধরনের গাণিতিক খেলা ছিলো। আবার কিছু খেলা হতো বাগানে। যেমন-গুলতি, পাখি শিকার, ছড়ায় ছড়ায় একটা খেলা শৈশবে খেলেছি নামটি এখন মনে নেই। কিছু হতো পুকুরে। যেমন-নানান ধরনের সাঁতার, লাফ দেওয়া, ডুব দিয়ে পাড় পার হওয়া, একজন আরেকজনকে স্পর্শ করা, পানিতে হাঁস ধরা।
ফুটবল, কাবাডির মতো ফরিদগঞ্জের জনপ্রিয় একটি খেলা ছিলো দাড়িয়াবান্ধা। এই খেলাটি আমার অতি প্রিয় খেলা এবং আমি খেলাটি বেশ ভালো পারতাম। প্রতিপক্ষের চোখে চোখ রেখে একটার পর একটা ধাপ পেরিয়ে যেতে হয়। প্রতিটি ধাপে ধূর্ত শেয়ালের মতো বুদ্ধি খাটিয়ে নিজেকে বাঁচিয়ে এগিয়ে যেতে হয়। দুরন্ত শৈশবের উত্তেজনাকর খেলাগুলোর মধ্যে অন্যতম ছিলো এই দাড়িয়াবান্ধা খেলা। গ্রামের অত্যন্ত জনপ্রিয় শারীরিক পরিশ্রমের এই খেলা। বিকেলবেলা হৈহুল্লোড় হবে, হারজিত নিয়ে ঝগড়া হবে, এই না হলে খেলা! দাড়িয়াবান্ধা তেমনই একটি খেলা। ছোট ছোট কোর্ট বানিয়ে খেলা হতো। বিভিন্ন এলাকায় একে বিভিন্ন নামে ডাকা হয় এবং অঞ্চলভেদে এর নিয়মকানুনেও ভিন্নতা থাকে। ফরিদগঞ্জে এই খেলার নাম ‘র্যাডি’। মূলত প্রতিপক্ষকে ফাঁকি দিয়ে এক কোর্ট থেকে অন্য কোর্টে গিয়ে পয়েন্ট বাগানোই এই খেলার মূল উদ্দেশ্য। তাই এই খেলায় থাকে উত্তেজনা।
লাটিম আমাদের ঐতিহ্যবাহী একটি শিশুতোষ খেলা। ছেলেবেলার অত্যন্ত প্রিয় খেলাগুলোর মধ্যে এটি একটি। নতুন কেনা রঙিন লাটিম দিয়ে কাউকে হারিয়ে দেওয়ার যে সুখস্মৃতি, তা ভোলার নয়। একটা সময় কাচের ছোট্ট গোলাকার কালচে সবুজ মার্বেল খেলেনি এমন লোক খুঁজে পাওয়া কঠিন। কী যে এক উদ্দাম নেশা ছিলো এই মার্বেল খেলার প্রতি। একজন ব্যাটসম্যান, চারদিকে নির্দিষ্ট দূরত্বে চার বা পাঁচজন ফিল্ডার। অবাক হচ্ছেন? এটা ক্রিকেট নয়, ক্রিকেটের আমাদের সংস্করণ ডাংগুলি খেলা। খেলেছেন নিশ্চয়ই। হয়তো গুলির আঘাতে কপাল বা মাথা কেটে যাওয়ার চিহ্নও আছে আপনার শরীরে। দেড়-দুই ফুটের লম্বা ডাং বা লাঠি আর দু-আড়াই ইঞ্চির ছোট লাঠি দিয়ে খেলা হতো এই ডাংগুলি। অঞ্চলভেদে এই খেলার নিয়মকানুনেও ভিন্নতা আছে। এছাড়াও এক্কাদোক্কা, লুকোচুরি, বৌছি, চোর পুলিশ, কানামাছি, ইচিং বিচিং, মোরগ লড়াই, গোল্লাছুট, পুতুল বিয়ে, ষোলগুটি, ঘুড়ি ওড়ানো, ওপেনটি বায়স্কোপ, ধাঁধা, গোস্ত চুরি, টুকপালানি ও সাতভাই চম্পা। ধানের শক্ত আঁটি কেটে পরিষ্কার করে অথবা আইসক্রিমের কাঠি সংগ্রহ করে মুঠোতে নিয়ে এক ধরনের খেলা খেলতাম। স্কুলের বেঞ্চে বা টেবিলে কলম খেলতাম।
জাতীয় ফুটবল দলের সাবেক অধিনায়ক রেজাউল ও ফরিদগঞ্জ উপজেলার এক সময়কার তুখোড় ফুটবল খেলোয়াড় জাকির হোসেন গাজী বলেন, আমাদের শৈশব ছিলো স্বপ্নের মতো রঙ্গিন। ইচ্ছে হয় সেই সোনালী অতীতে ফিরে যাই। কিন্তু সব ইচ্ছে পূরণ হবার নয়। আজকের সমাজ নষ্ট হওয়ার অন্যতম কারণ হলো ইন্টারনেট এবং পর্যাপ্ত খেলার মাঠ না থাকা।
কাবাডি, ফুটবলসহ এক সময় হায়ারে খেলতে যাওয়া ক্রীড়ামোদী, সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান বিল্লাল হোসেন ভূঁইয়া বলেন, একটা সময় সারাদিন মাঠে পড়ে থাকতাম খেলাধুলা নিয়ে। বহু জায়গায় গিয়েছি হায়ারে খেলতে। খেলাধুলা এখনো আমার রক্তের সাথে মিশে আছে। আমার জীবনে এমনও ঘটনা রয়েছে, টুর্নামেন্ট পরিচালনার জন্যে নিজের জায়গা বিক্রি করেছি। ব্যবসার টাকা এনে খেলা চালিয়েছি। এখনো রাজনীতির পাশাপাশি যখনই কোনো খেলার সংবাদ শুনি, চলে যাই। শৈশবের সেই খেলার আমেজ এখন না থাকলেও অনুভূতি ঠিকই আছে। খেলা থেকে দূরে আছে বলেই বর্তমান প্রজন্ম মাদকের দিকে ঝুঁকে পড়ছে। বর্তমান সময়ে ফরিদগঞ্জে জনপ্রিয় ক্রীড়া সংগঠক আনোয়ার হোসেন সজিব বলেন, ছোট বেলায় যখন খেলাধুলা করতাম তখন কিন্তু ক্রিকেট বা ব্যাডমিন্টন খেলা এতোটা জনপ্রিয় ছিলো না। তখন আমরা যে খেলাগুলোতে আসক্ত ছিলাম বিশেষ করে ফুটবল, গোল্লা, হা-ডু-ডু, রেডি খেলা, চোখ পলান্তি বা কানামাছি, ষোলঘর, কাঠি দিয়ে ক্যারাম বোর্ড। এই খেলাগুলো নিয়ে দিন কাটাতাম। আবার পড়ালেখাও করতাম। বর্তমানে তো এই খেলাগুলো বিলুপ্তির পথে।
বাংলাদেশ জাতীয় ফুটবল দলের সাবেক অধিনায়ক রেজাউল করিম রেজা এ প্রতিবেদককে বলেন, একটা সময় আমাদের ধ্যান-জ্ঞান ছিলো খেলা। সময় সুযোগ পেলেই খেলা নিয়ে পড়ে থাকতাম। যেমনটা এ যুগের শিশু-কিশোররা একটু সময় পেলেই মোবাইল নিয়ে বসে যায়। আমরা একটু সময় পেলেই খেলায় মজে যেতাম। সকালেও খেলতাম, স্কুল ছুটির পর কখনো কখনো স্কুল মাঠেই নেমে পড়তাম। বাড়ির উঠানে প্রায় প্রতিদিন বিকেল বেলায় খেলতাম। খেলা থেকে দূরে থাকার কারণে শিশু- কিশোররা ডিভাইসে আসক্ত হয়ে পড়ছে। কেউ কেউতো মাদকের সাথে যুক্ত হয়ে যাচ্ছে। আমরা ফরিদগঞ্জে একটি ফুটবল একাডেমি করেছি, সেখানে চর্চার জন্যে খেলোয়াড় পাচ্ছি না!