সোমবার, ২০ মে ২০২৪, ৬ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১, ১১ জিলকদ ১৪৪৫  |   ২৮ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   এসএসসি সমমানের পরীক্ষার ফল প্রকাশ

প্রকাশ : ০১ মে ২০২৪, ০০:০০

মে দিবসের তাৎপর্য ও ইসলাম

নূর মোহাম্মদ
মে দিবসের তাৎপর্য ও ইসলাম

পয়লা মে--ঐতিহাসিক মে দিবস। আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত শ্রমিক শ্রেণির এক অনন্য দিন। ১৮৮৬ সালের এই দিনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহরের হে মার্কেটে দৈনিক আট ঘন্টা কাজের দাবিতে ধর্মঘট ডেকেছিল শ্রমিকেরা। শাসক ও মালিকগোষ্ঠীর হিংস্র আক্রমণে সভ্যতার নির্মাতা শ্রমিকের তাজা রক্ত ঝরেছিল সেদিন। অধিকার আদায়ের জন্যে জীবন বিসর্জন দিয়েছিলেন শ্রমিকেরা। ১ মে থেকে চারদিনের বেদনাবহ ও গৌরবময় ঘটনাবলি স্মরণে আমেরিকান ফেডারেশন অব লেবার ১৮৮৮ সাল থেকে প্রতি বছর শ্রমিকদের মিছিল-সমাবেশের মধ্য দিয়ে এই দিনটিকে মে দিবস হিসেবে পালন করে আসছে।

বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও এই দিনটি অত্যন্ত মর্যাদার সাথে পালিত হচ্ছে। বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর থেকে এই দিনটিকে ছুটির দিন ঘোষণা করা হয়। কেবল শ্রমিকরাই যে এদিনটি পালন করছে তা নয়, শাব্দিক অর্থে যারা শ্রমিক নন, তারাও এখন মে দিবস পালন করেন। কারণ দিনে দিনে প্রমাণিত হয়েছে, সভ্যতার বিনির্মাণে শ্রমিকদের ভূমিকা অনন্য। শ্রমিকদের শ্রম ছাড়া সভ্যতা নির্মাণ সম্ভব নয়। কিন্তু শুরুতে শ্রমিকদের ন্যায়সংগত দাবি তাদের নিজেদের লড়াই করেই আদায় করতে হয়েছে। অন্যরা মালিকদের শোষণ সমর্থন করে তাদের দাবির বিরোধিতাই করেছিল। ১৮৮৬ সালে হে মার্কেটে শ্রমিকদের রক্তদান বৃথা যায়নি। আজ শ্রমিকদের রোজ আট ঘন্টা কর্মের দাবি কেবল যুক্তরাষ্ট্রেই স্বীকৃত হয়নি, এটি স্বীকৃত হয়েছে আন্তর্জাতিকভাবে সারা বিশ্বে। এখন যে কোনো দেশে আট ঘন্টার বেশি শ্রমদান ও শ্রম আদায় নিষিদ্ধ। এছাড়াও শ্রমিক শ্রেণির বহু দাবি আজ অধিকার হিসেবে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত হয়েছে। ১৮৮৬ সালের মে দিবসের ইতিহাস ও পূর্বাপর কিছু ঘটনা নিম্নরূপ--

ষড়যন্ত্রের অভিযোগে ১৮০৬ সালে মামলা হয়েছিল ফিলাডেলফিয়ার ধর্মঘটী জুতা শ্রমিক নেতাদের বিরুদ্ধে। এই মামলায় ফাঁস হলো যে, কারখানার মালিকরা শ্রমিকদের ঊনিশ থেকে বিশ ঘন্টা পর্যন্ত খাটায়! তখনকার প্রচলিত অলিখিত নিয়মই ছিলো দিনের কাজের ঘন্টা সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত। এর প্রতিবাদে ঊনিশ শতকের গোড়ার দিকে ফুঁসে উঠে আমেরিকার শ্রমিকরা। ১৮২০ সালে আমেরিকার বিভিন্ন শহরে ছোট ছোট স্থানীয় ট্রেড ইউনিয়নগুলো একত্র করে একটা ফেডারেশন গঠনের চেষ্টা করা হয়। শ্রমিকরা ১৮৪০ সাল পর্যন্ত কাজের ঘন্টা কমানোর জন্যে একের পর এক ধর্মঘট করে। ১৮২৭ সালে ফিলাডেলফিয়ার গৃহনির্মাণ শ্রমিকরা দৈনিক দশ ঘন্টা কর্মঘন্টার দাবিতে ধর্মঘট করেছিলেন। ১৮৩৪ সালে নিউইয়র্কের রুটি শ্রমিকরা ধর্মঘট করেন, যাদেরকে দৈনিক গড়ে আঠারো থেকে বিশ ঘন্টা কাজ করতে হতো।

১৮৩৭ সালে অর্থনৈতিক মন্দার সময় যুক্তরাষ্ট্রের সরকার সরকারি কাজে নিযুক্ত শ্রমিকদের দৈনিক দশ ঘন্টার কর্মঘন্টা বেঁধে দেন। পরবর্তী বছরগুলোতে বেসরকারি শ্রমিকদের ক্ষেত্রেও এই আইন কার্যকর করার দাবি উঠতে থাকে। দৈনিক দশ ঘন্টা কর্মের এ দাবি খুব দ্রুত আন্দোলনের আকার ধারণ করে। দৈনিক দশ ঘন্টা কাজের সময়, শ্রমিকদের সন্তানদের বিনামূল্যে শিক্ষা ব্যবস্থা, দেনা শোধ করতে না পারলে শ্রমিকদের জেলে পাঠানোর আইনের বিলুপ্তি, অপ্রাপ্ত বয়স্ক ও মহিলা শ্রমিকদের কাজের ও মজুরির সুযোগ-সুবিধা প্রদান প্রভৃতি দাবিতে শ্রমিকরা সংঘবদ্ধ হতে থাকে। ১৮৫০ সালের দিকে সর্বত্র শ্রমিক ইউনিয়ন গড়ার প্রবল উদ্যোগ দেখা যায়। এই সময় থেকে শ্রমিকরা দশ ঘন্টার জায়গায় আট ঘন্টা রোজের দাবি তোলেন এবং আমেরিকা সহ সকল উদীয়মান পুঁজিবাদী দেশে আট ঘন্টা রোজের আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে।

১৮৭০-এর দিকে আমেরিকা জুড়ে শুরু হয় তীব্র অর্থনৈতিক সংকট ও বাণিজ্যিক মন্দা। মন্দার অজুহাতে মালিকরা মজুরি কমানো, শ্রমিক ছাঁটাই, শ্রম ঘন্টা বাড়ানো প্রভৃতি নির্যাতনমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করলে শ্রমিকরাও এসব নির্যাতনের বিরুদ্ধে তীব্র আন্দোলন শুরু করে।

এভাবে আন্দোলন, জীবন বিসর্জন, বিভিন্ন সময় শ্রমিক ও শ্রমিক নেতাদের জেল ও ফাঁসিতে ঝুলানোর এক পর্যায়ে ১৮৮৬ সালের ১ মে রোজ শনিবার সমগ্র শিকাগো শহর নিস্তব্ধ। চালু নেই কোনো কল-কারখানা। মিছিলের প্রস্তুতি নিচ্ছে ধর্মঘটী শ্রমিকরা। মিছিল যাবে মিশিগান এভিনিউ হয়ে লেক ফ্রন্টের দিকে। যেখানে ছয় লাখ শ্রমিক জড়ো হয়েছে। ১১হাজার ৫শ’ ৬২টি শ্রমিক সংগঠন অংশগ্রহণ করেছে। তালা ঝুলছে প্রায় ১৫৭২টি শিল্প প্রতিষ্ঠানে। সরকার ও মিল মালিকরা আপ্রাণ চেষ্টা করেও আন্দোলন বন্ধ করতে পারছে না। বিভিন্ন গুজব ছড়ানোর পরও শান্তিপূর্ণভাবে শ্রমিকদের ১ম দিনের সমাবেশ শেষ হয়। পরের দিন রোববার ছুটির দিনেও শান্তিপূর্ণভাবে শ্রমিকদের সমাবেশ শেষ হয়। কিন্তু ৩ মে সোমবার আবার কারখানায় কারখানায় ধর্মঘট শুরু হলে সরকার ও মালিক পক্ষ তা নস্যাৎ করার জন্যে মরিয়া হয়ে ওঠে। শ্রমিকদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে পুলিশ। ঘটনাস্থলেই নিহত হয় ৬জন শ্রমিক এবং আহত হলো অগণিত শ্রমিক। এই নির্মম হত্যাকাণ্ড ও সন্ত্রাসের প্রতিবাদে শিকাগোর হে মার্কেটে প্রতিবাদ সভা ডাকা হলো ৪ মে। গত দিনের শ্রমিক হত্যার ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে অভূতপূর্ব জনসমাবেশ ঘটলো। ঘাবড়ে গেলো মালিক পক্ষ। শান্তিপূর্ণভাবে সমাবেশ প্রায় শেষের দিকে। যখন শেষ বক্তা ফিল্ডেন উঠেছেন বক্তৃতা দিতে রাত প্রায় ১০ টার দিকে, তখন পুলিশের বড় কর্মকর্তা নির্দেশ দিলেন সমাবেশ ভেঙ্গে দিতে। পুলিশের সাথে শ্রমিক নেতাদের কথা কাটাকাটির এক পর্যায়ে সমাবেশের বিভিন্ন স্থানে শুরু হয় বোমা বিস্ফোরণ। পুলিশ শুরু করে লাঠিচার্জ ও গুলি বর্ষণ। তাৎক্ষণিকই নিহত হন সাতজন পুলিশ ও চারজন শ্রমিক। স্পাই ও ফিল্ডেনসহ অনেকেই সভাস্থলে গ্রেফতার হন। রক্তের বন্যা বয়ে যায় শিকাগোর হে মার্কেটে।

ইসলামে শ্রমের মর্যাদা : ইসলামে মানুষের শ্রমের মাধ্যমে উপার্জনের অধিকার পূর্ণ মাত্রায় স্বীকৃত। মানুষ তার যোগ্যতা অনুযায়ী স্বাধীনভাবে যে কোনো বৈধ পন্থায় আয়-উপার্জন করতে পারবে। আর ইসলামি রাষ্ট্রের দায়িত্ব হলো নাগরিকরা যাতে যোগ্যতা অনুযায়ী কাজ করতে পারে সে জন্যে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা। এজন্যে ফরয ইবাদতের পর দ্বিতীয় ফরয হালাল উপায়ে রুজি অন্বেষণ করা। কুরআনুল কারীমে এজন্যে শ্রমকে জীবিকার প্রধান উপায় বলা হয়েছে। আল্লাহ তা’আলা বলেছেন, “এবং মানুষের প্রাপ্য শুধু তা, যার জন্য সে চেষ্টা ও শ্রম করেছে। এই চেষ্টা ও শ্রম অবশ্যই গুরুত্ব পাবে এবং চেষ্টা ও শ্রমকারীকে অবশ্যই পূর্ণ মাত্রায় তার প্রতিফল দেয়া হবে।” (সূরা আন নাজম : ৩৯-৪১) আল্লাহ তা’আলা আরো বলেছেন, “এরপর যখন সালাত আদায় শেষ হবে তখন তোমরা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়বে, আল্লাহর অনুগ্রহ উপার্জন করবে এবং আল্লাহর বেশি বেশি যিকর করবে, তাহলে তোমরা সফল হবে।” (সূরা জুমুআ : ১০)

তেমনিভাবে ইসলামি রাষ্ট্রে শ্রমজীবী ও অন্যান্য পেশার কোনো লোককে কেউ বিনা পারিশ্রমিকে খাটাতে পারবে না। তাদের শ্রমের ন্যায়সংগত পারিতোষিক অবশ্যই দিতে হবে। সামর্থ্যরে বাইরে তাদের উপর কাজের বোঝা চাপানো যাবে না, তাদের আর্থিক কিংবা দৈহিক কোনো ক্ষতি হলে ক্ষতিপূরণ দিতে হবে, সর্বোপরি তাদের সাথে সৌজন্যমূলক আচরণ করতে হবে। রাসূল (সাঃ) বলেছেন, “শ্রমিককে গায়ের ঘাম শুকাবার আগেই তার পারিশ্রমিক দিয়ে দাও।”(সুনান ইবন মাজা) রাসূল (সাঃ) অপর এক হাদীসে বলেছেন, ‘কিয়ামতের দিন আল্লাহ তা’আলা তিন ব্যক্তির বিরুদ্ধে প্রকাশ্য অভিযোগ উত্থাপন করবেন। তন্মধ্যে তৃতীয় ব্যক্তি হচ্ছে : যে ব্যক্তি কাউকে মজুর হিসেবে খাটিয়ে ও তার দ্বারা পূর্ণ কাজ আদায় করা সত্ত্বেও শ্রমিকের মজুরি দেয় না।’ (দৈনন্দিন জীবনে ইসলাম, পৃঃ-৪৯৯) রাসূল (সাঃ) আরো বলেছেন, “শ্রমিকের পারিশ্রমিক ও ঋণ পরিশোধ নিয়ে ধনী ব্যক্তিদের তালবাহানা করা যুলুম।”(বুখারী ও মুসলিম) সাথে সাথে ইসলাম শ্রমিকের উপরও এই দায়িত্ব অর্পণ করেছে যে, সে যেন চুক্তি অনুযায়ী যথাযথভাবে কর্ম সম্পাদন করে। আল্লাহ তা’আলা বলেছেন, “তোমরা প্রতিশ্রুতি পালন করবে, প্রতিশ্রুতি সম্পর্কে কৈফিয়ত তলব করা হবে।”(সূরা বনী ইসরাইল : ৩৪) রাসূল (সাঃ) বলেছেন, “আর শ্রমজীবী ব্যক্তি তার মনিবের সম্পদের দায়িত্বশীল এবং সে এ মালের দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে।” (সহীহ বুখারী)

ইসলামের শ্রেষ্ঠত্ব এখানেই। ইসলাম শ্রমিক-মালিকের অধিকার ও কর্তব্য ব্যক্তি, সমাজ ও বিশ্বে শতভাগ বাস্তবায়ন করে দেখিয়েছে। এ কারণে সমগ্র বিশ্বের সব মানব জাতি, ধর্ম, বর্ণ, অঞ্চল, দেশ, কাল নির্বিশেষে যদি সত্যিকারের কর্মের ন্যায়সংগত অধিকার, মর্যাদা ও স্বীকৃতি পেতে করতে চায় তাহলে একান্তভাবে ফিরে আসতে হবে ইসলামের মহান আদর্শের দিকে। মানবতার মুক্তির জন্য তাই ইসলামের বিজয় অনিবার্য। তাইতো গবেষক মুহাম্মদ খালিদ বলেছেন, "Islam is infact ideology (based on Divine Revelation) away of life, universal in its approach and eternal in its application. Being universal in its character it evolve a way of life which was basically 'democratic' and established a social order based on equality, fraternity and justice." (Mohammad Khalid, Welfare State of Pakistan, Royal book company, Karachi, 1968, p.-53.) লেখক : নূর মোহাম্মদ, প্রভাষক (ইসলাম শিক্ষা), বলাখাল মকবুল আহমেদ ডিগ্রি কলেজ, বলাখাল, হাজীগঞ্জ, চাঁদপুর।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়