প্রকাশ : ০৯ জুলাই ২০২৩, ০০:০০

Man can be destroyed but never defeated মানুষ ধ্বংস হতে পারে কিন্তু পরাজয় বরণ করতে পারে না। বিশ্ববরেণ্য নোবেলজয়ী, মার্কিন ঔপন্যাসিক, স্বেচ্ছায় আত্মহত্যাকারী আর্নেস্ট হ্যামিংওয়ে তাঁর অমর গ্রন্থ The old man and the sea -এ হাওয়াই দ্বীপবাসীদের বীরত্বকে স্মরণ করে রাখার জন্যে এ অসাধারণ বাক্যটি লিখেছেন।
আমেরিকার ৫০তম অঙ্গরাজ্য হাওয়াই (রাজধানী হনলুলু)। মূল ভূ-খণ্ড থেকে অনেক দূরে জাপানের কাছাকাছি প্রশান্ত মহাসাগরের একটি দ্বীপপুঞ্জ। সবদিক থেকে ঊর্বশীর চেয়ে অপরূপ সুন্দরী এ দ্বীপ আক্রান্ত হলে দ্বীপবাসীরা অসম যুদ্ধে না জড়িয়ে, তাদের পরাজয় বরণ ঠেকাতে রাজার ভাষণে উজ্জীবিত হয়ে স্বেচ্ছায় সুউচ্চ পাহাড়ে গিয়ে প্রশান্ত মহাসাগরের উত্তাল তরঙ্গমালায় নিচে গভীর খাদে ঝাঁপ দিয়ে নিজেদেরকে আত্মোৎসর্গ করলেন। ইতিহাসে চিরভাস্বর তাদের ত্যাগের মহিমা। ভারতবর্ষের হারানো স্বাধীনতা পুনরুদ্ধারের জন্য সমগ্র ভারতবাসী ঐক্যবদ্ধ হয়ে তা উদ্ধার করেন।
গত সপ্তাহে দিনাজপুর ডিসি অফিস (কাঞ্চন-১) কক্ষে এনজিওর একটি প্রোগ্রামে অংশগ্রহণের লক্ষ্যে সিঁড়িতে ওঠার সময় দেখলাম নিচতলায় ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর জন্য বরাদ্দকৃত একটি সুন্দর কক্ষ। ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী বলতে আমরা পিছিয়ে পড়া বা অনগ্রসর জনগোষ্ঠীকে বুঝি। তাদের জীবন ও জীবিকা সাধারণত খাদ্য সংগ্রহ, উদ্যোগ, কৃষি ও পশু পালনের ওপর নির্ভরশীল। এদেশে ৯৩টি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর বসবাস, যেমন চাকমা, মারমা, মুরং, মনিপুরী, সাঁওতাল ইত্যাদি। সাঁওতালকে কেউ কেউ আবার আদিবাসীও বলে। এই আদিবাসীদের মধ্যে সিধু-কানুর মতো বীরপুরুষ রয়েছে। তাদের ভাস্কর্য আমার ভালোবাসার মহেশপুর আদিবাসী উচ্চ বিদ্যালয়, বোঁচাগঞ্জ, দিনাজপুরে প্রাঙ্গণে ও কান্তনগর (রাস্তার তে-মাথায়) কাহারোল, দিনাজপুরে চেতনার প্রেরণা হিসেবে তীরধনুক হাতে দণ্ডায়মান।
সিধু-কানুদের নেতৃত্বে সাঁওতালরা ইংরেজদের শাসন ও শোষণের বিরুদ্ধে গর্জে উঠেছিলো। তারা সরাসরি বিজয়ী না হলেও তাদের বিদ্রোহ পুরোপুরি ব্যর্থ হয়নি। বিদ্রোহের পর ইংরেজ সরকার তাদের ক্ষুদ্র জাতি হিসেবে স্বীকৃতি দেয় এবং বসবাসের জন্যে তারা সাঁওতাল পরগণা নামে নতুন জেলা গঠন করে। জমির মালিকানার অর্জনের সাথে মহাজনদের দেয়া সব ঋণ বাতিল করে। তাদের বীরত্বের সুদূরপ্রসারী ফলাফল হলো কৃষক সংগ্রাম ও সিপাহী বিদ্রোহের প্রেরণা।
সিধু, কানু, চাঁদ ও ভৈরব ছিলেন চার ভাই। সাঁওতাল পরগণার ভাওলাদিহি গ্রামের দরিদ্র আদিবাসী পরিবারে তাদের জন্ম। ছোটবেলা থেকেই মহাজন ও দাদন ব্যবসায়ীদের অপমান ও পীড়ন দেখে দেখে তারা বড় হয়েছেন। তারা দেখেছেন কীভাবে ঋণের ফাঁদে, দাদন ব্যবসায় বংশপরম্পরায় নিঃস্ব হতে হয়। প্রতিবাদ করলে গ্রেফতার হয়রানি ও ব্রিটিশ সরকারের উল্টো খড়গ নেমে আসা। ধূর্ত ব্যবসায়ীরা জমিদার ও ইংরেজ সরকারের সহায়তায় সহজ-সরল সাঁওতালদের কাছ থেকে ধান, সরিষা ও তৈলবীজ নিয়ে তাদের দিত অর্থ, লবণ, তামাক ও কাপড়। সেগুলো নেয়ার সময় বড় বাটখারা ‘বড় বৌ’ বা কেনারাম দিয়ে ওজনে বেশি নিয়ে দেয়ার সময় ছোট বাটখারা ‘ছোট বৌ’ বা বেচারাম দিয়ে দুপাশেই ঠকাত। চাষাবাদের সময় ৫০ থেকে ৫০০ টাকা পর্যন্ত সুদে ঋণ দিয়ে দাদন ব্যবসায় বাধ্য করে কৌশলে সই বা টিপ নিতো। নানারকম অত্যাচার-নির্যাতন ও উৎপীড়ন করে তাদের ক্রীতদাসে পরিণত হতে বাধ্য করতো। তাদের জীবন দুর্বিষহ হয়ে ওঠায় তারা মুক্তির পথ খুঁজতে লাগলো।
আদিবাসীরা অত্যন্ত পরিশ্রমী এবং প্রকৃতির সঙ্গে লড়াই করা তাদের স্বভাব। যে মাটিতে কোনো মানুষের পা পড়েনি, হিংস্র প্রাণী, পোকামাকড় আর সাপ বিচ্ছু ভরপুর সেখানে তারা বসবাস এবং চাষাবাদ করে সোনার ফসল ফলায়। ইংরেজ সরকার তাদেরকে বলেছিলো, ‘তোমরা দুর্গম অঞ্চলের জঙ্গল পরিষ্কার করে চাষাবাদ ও বসবাস করো। আমরা সেই অনাবাদী জমিতে কোনো কর ধার্য করবো না’। তারা তাদের সেই কথা পরবর্তীতে আর রাখেনি।
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আমলে ১৭৮০ দালে তিলকা মুরমু (মাঞ্জহী) প্রথম গণসংগ্রামের সূচনা করেন। ১৭৮৪ সালে ১৭ জানুয়ারি তার তীরের আঘাতেই ভাগলপুরে ক্লিভল্যান্ড প্রাণ হারান। ১৭৮৫ সালে তিলকা মাঞ্জহী ধরা পড়েন এবং তাকে ফাঁসি দেয়া হয়। পরবর্তীতে ১৮১১ সালে দ্বিতীয় বার, ১৮২০ সালে তৃতীয় বার এবং ১৮৩১ সালে চতুর্থ বার গণসংগ্রাম গড়ে উঠে। অবশেষে ১৮৫৫ সালে ৩০ জুন সিধু-কানুর ডাকে ৪০০ গ্রামের ৩০ হাজারের অধিক সাঁওতাল একত্রিত হয়ে ভারতের ইতিহাসে প্রথম কলকাতা অভিমুখে পদযাত্রা বা গণমিছিল করেন। তাদের সমবেত কণ্ঠে উচ্চারিত হয় ‘জমি চাই, মুক্তি চাই’ শ্লোগান। পদযাত্রার সময় অত্যাচারী মহাজন কেনারাম ভগত ও জঙ্গিপুরের দারোগা মহেশ লাল দত্ত ৬/৭ জন সাঁওতাল নেতাকে গ্রেফতার করেন। সিধু-কানুকে গ্রেফতার করতে উদ্ধত হলে বিপ্লবীরা ৭ জুলাই পাঁচকাঠিয়া নামক স্থানে মহাজন কেনারাম ও দারোগা মহেশ লালসহ তাদের দলের ১৯ জনকে হত্যা করে। বিপ্লবীরা বীরভূমের বিখ্যাত ব্যবসা কেন্দ্র নাগপুর বাজার ধ্বংস করে এবং ২১ জুলাই কাতনা গ্রামের ইংরেজ বাহিনী বিপ্লবীদের কাছে পরাজয় স্বীকার করে। এমতাবস্থায় ইংরেজ বাহিনী ডাইরেক্ট অ্যাকশন শুরু করে। সেই আগুনের দাবানল টানা আটমাস যাবৎ চলে।
ইংরেজরা হাজার হাজার সাঁওতালকে এলোপাতাড়িভাবে হত্যা করে। ১৮৫৬ সালের ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহে সিধুর গোপন আস্তানায় হানা দিলে সেই লড়াইয়ে সাঁওতাল বিদ্রোহের মহানায়ক সিধু পুলিশের গুলিতে নিহত হন। দ্বিতীয় সপ্তাহে একদল সশস্ত্র বিদ্রোহীসহ কানু পুলিশের হাতে ধরা পড়ে। আদালতের বিচারে কানুকে ফাঁসি দেয়া হয়। তাদের দুই ভাই চাঁদ ও ভৈরব ভাগলপুরের কাছে এক ভয়ানক যুদ্ধে বীরের মতো প্রাণ ঊৎসর্গ করেন। সে সময় সাঁওতাল নারীদের নিয়ে বিপ্লব করেছিলো দুইবোন ফুলো মুরমু ও ঝানো মুরমু। ফুলো মুরমুকে ব্রিটিশ সিপাহীরা নৃশংসভাবে ধর্ষণ ও হত্যা করে, তার লাশ রেললাইনে ফেলে দেয়। ইতিহাসের প্রথম বীরাঙ্গনা হিসেবে সাঁওতাল জাতিসত্তা তাকে আজও শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে।
পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ ও বিহারের ভাগলপুর সাঁওতালদের লাল রক্তে সবুজ শ্যামল মাটি রঞ্জিত হয়। প্রতিবছর তাদের স্মৃতি ও স্মরণে ৩০ জুন যথাযোগ্য মর্যাদার সাথে পালিত হয় ‘হুল দিবস’। ক্ষুদ্র জাতিসত্তার সকল বীর এবং বীরাঙ্গনাদের আত্মার প্রতি অতল গভীর শ্রদ্ধা জানিয়ে প্রিয় দেশাত্মবোধক গানটি উৎসর্গ করে কলমটি থামালাম ‘মুক্তির মন্দির সোপান তলে, কত প্রাণ হলো বলিদান, লেখা আছে অশ্রুজলে’।
মোঃ কায়ছার আলী : শিক্ষক, প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট।