শনিবার, ১১ অক্টোবর, ২০২৫
জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয় অন্যান্য

প্রকাশ : ১০ অক্টোবর ২০২৫, ০৯:৪৫

পর্যাপ্ত প্রস্তুতি না নিয়ে মা ইলিশ রক্ষা কার্যক্রম?

অনলাইন ডেস্ক
পর্যাপ্ত প্রস্তুতি না নিয়ে মা ইলিশ রক্ষা কার্যক্রম?

বুধবার চঁাদপুর কণ্ঠের প্রিন্টিং সংস্করণে একটি সংবাদের শিরোনাম হয়েছে ‘মতলব উত্তরে নদীর পাড়ের হাট বাজারে প্রকাশ্যে ইলিশ বিক্রি’। আর অনলাইন সংস্করণে শিরোনাম হয়েছে ‘রায়পুরে মেঘনার পাড়ে পঁাচটি ঘাটে মা-ইলিশ ধরার মহোৎসব’। এ দুটি সংবাদ শিরোনাম দেখে এবং সংবাদ পড়ে সচেতন কিংবা ইলিশপ্রেমী প্রতিটি মানুষকে ভীষণ হতাশ হতে হয়েছে।

প্রথম সংবাদটি পরিবেশন করা হয়েছে চঁাদপুর কণ্ঠের মতলব উত্তর ব্যুরো থেকে। সংবাদটিতে লিখা হয়েছে, ৪ অক্টোবর থেকে ২৫ অক্টোবর পর্যন্ত চঁাদপুরের মতলব উত্তর উপজেলায় মেঘনা নদীর অভয়াশ্রম এলাকায় ইলিশ সহ সব ধরনের মাছ ধরা, ক্রয়-বিক্রয়, পরিবহন ও মজুদ সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করেছে সরকার। সকল মাছ ধরার ওপর ২২ দিনের এই নিষেধাজ্ঞা থাকলেও এ উপজেলার মেঘনা পাড়ের হাট বাজারগুলোতে প্রকাশ্যে মা ইলিশ বিক্রি করতে দেখা যাচ্ছে। এ উপজেলায় সচেতনতা বৃদ্ধিতে প্রচারণার অভাব, নিষেধাজ্ঞার কার্যক্রম বাস্তবায়নে মৎস্য বিভাগকে মাঠে খুঁজে না পাওয়ার কারণে মা ইলিশ রক্ষার কার্যক্রম চলছে ঢিমেতালে। মৎস্য বিভাগের এ রকম দায়িত্বহীনতার কারণে হতাশা প্রকাশ করেছেন উপজেলা দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটির সভাপতি মতিউর রহমান চৌধুরী। সরেজমিনে মেঘনা পাড়ের ক’টি বাজারে গিয়ে প্রকাশ্যেই ইলিশ বেচাকেনার দৃশ্য দেখা গেছে। কিছু কিছু জায়গায় ইলিশ বিক্রিতে লুকোচুরি করতে দেখা গেলেও অনেক বাজারে প্রকাশ্যেই বিক্রি করতে দেখা গেছে। এমন ক’টি বাজার পরিচালনা কমিটির নেতৃবৃন্দের সাথে কথা হলে তারা জানান, বিগত সময়ে মা ইলিশ ধরার নিষিদ্ধের ২২ দিন সময়সীমার আগে উপজেলা মৎস্য বিভাগ বাজার কমিটিকে নিয়ে সভা করলেও এবার আমাদেরকে নিয়ে কোনো সভা হয়নি। কয়েকজন ইউপি চেয়ারম্যানের সাথে কথা হলে তারাও জানান, অন্যান্য সময়ে প্রতিটি ইউনিয়নে স্থানীয় জেলেদের নিয়ে সভা অনুষ্ঠিত হলেও এবার সে রকম কোনো সভা অনুষ্ঠিত হয়নি। খেঁাজ নিয়ে জানা গেছে, এবারে মা ইলিশ ধরার নিষেধাজ্ঞার প্রচার প্রচারণা ছিলো এ উপজেলায় একেবারেই দায়সারা। সিনিয়র উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা বিজয় কুমার দাসের সাথে মুঠোফোনে কথা হলে তিনি জানান, পর্যাপ্ত জনবলের অভাব, ছোট একটি মাত্র স্পিড বোট ও অর্থ সংকটের কারণে উপজেলার বিশাল অঞ্চল মনিটরিং করা আমাদের জন্যে খুবই কষ্টসাধ্য।

দ্বিতীয় সংবাদটিতে রায়পুর থেকে তাবারক হোসেন আজাদ লিখেছেন, ৪ থেকে ২৫ অক্টোবর পর্যন্ত মা-ইলিশ আহরণ, বিক্রয় ও মজুদ করার সরকারি নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে লক্ষ্মীপুরের রায়পুরে মেঘনা নদীতে ইলিশ ধরার মহোৎসব চলছে। এসব আবার অবাধে বাজারে বিক্রিও করা হচ্ছে। গত ৪ মাস সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা ও ২ বছর সহকারী মৎস্য কর্মকর্তা না থাকায় এবং কোস্টগার্ড এখন পর্যন্ত না দেয়ায় অভিযান পরিচালনা করছেন না মৎস্য বিভাগ। জাটকা রক্ষায় মৎস্য বিভাগের এমন ভূমিকায় জনমনে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।সচেতন জেলেরা বলছেন, এমন অবস্থা চলতে থাকলে ভবিষ্যতে নদীতে ইলিশ সংকটে পড়বে এবং জেলে পল্লীতেও অভাব দেখা দেবে। মঙ্গলবার (৭ অক্টোবর ২০২৫) বিকেল থেকে সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত সরেজমিনে দেখা গেছে, রায়পুরের মেঘনা নদীর চরবংশী হাজিমারা স্লুইস গেট, আলতাফ মাস্টার মাছ ঘাট, পুরাণ বেড়ি, চান্দারখাল, সাজু মোল্লার মাছঘাট সহ বিভিন্ন এলাকার মেঘনা নদীতে জেলেরা প্রকাশ্যে কারেন্ট জাল দিয়ে অবাধে ইলিশ ধরছেন। এসব ইলিশ মৎস্য ঘাটে প্রকাশ্য ডাকে বিক্রিও করা হচ্ছে। এসব ঘাট থেকে মা ইলিশ কিনে জেলা শহরসহ জেলার বিভিন্ন হাট-বাজারে প্রকাশ্যে বিক্রি করছেন ব্যবসায়ীরা। জেলেরা বলেন, ইলিশ রক্ষায় মৎস্য বিভাগের কোনো ভূমিকা না থাকায় এসব হচ্ছে। আবার সঠিক প্রচার-প্রচারণার অভাবে অনেক জেলে মা ইলিশসহ জাটকা ধরার নিষেধাজ্ঞার সময় ও আইনের কথাও জানেন না। হায়দরগঞ্জের শহরআলীর মোড় এলাকার মেঘনা নদীর জেলে মো.আবুল মাঝি ও খায়রুল আলম বলেন, আমরা প্রতিনিদিনই নদীতে মাছ ধরছি। বড়ো মাছের আশায় নদীতে জাল ফেলি। জালে জাটকার সাথে মা ইলিশও ধরা পড়ছে। আমরা তো বড়ো মাছের জন্যে জাল ফেলি, কিন্তু এ এলাকায় হাজার হাজার জেলে রয়েছে যারা কারেন্ট জাল দিয়ে শুধু জাটকা ধরছেন। মৎস্য কর্মকর্তারা এখানে আসেন না। চান্দারখাল এলাকার জেলে মো. মহিউদ্দিন ও হাসিম খান বলেন, ৪ অক্টোবর থেকে মা ইলিশের অভিযান শুরু হলেও মৎস্য কর্মকর্তারা ও কোস্টগার্ড না থাকায় বিকেল থেকে নদীতে ইলিশ ধরা হচ্ছে। এছাড়াও অনেক ধার-দেনা ও ঋণে জর্জরিত আছি। নদীতে ইলিশের সাথে অন্য মাছও আমরা ধরতেছি। তারা জানান, অন্য তিনটি ইউনিয়নে নিবন্ধন থাকলেও দক্ষিণ চরবংশী ইউনিয়নে তাদের কোনো জেলে নিবন্ধন নেই। এছাড়াও জাটকা আইন সম্পর্কে কেউ তাদের কখনও বলেনি। তাই তাদের কোনো ধারণাও নেই। উত্তর চরবংশীর খাসেরহাট ও নাইয়াপাড়া এলাকার কয়েকজন মাছ বিক্রেতা বলেন, জেলেরা নদীতে কারেন্ট জাল দিয়ে ছোট ছোট জাটকার সাথে মা ইলিশও ধরে আমাদের কাছে নিয়ে আসেন। বাধ্য হয়ে তা কিনে নিচ্ছি। কারণ জেলেদের কাছে আমাদের দাদন দেয়া।সাজু মোল্লারঘাট এলাকার সতেচন জেলে মালেক খান সহ একাধিক জেলে বলেন, অসাধু জেলেরা সরকারি কোনো আইন না মেনে কারেন্ট জাল দিয়ে জাটকার পাশাপাশি মা-ইলিশও ধরছে। তা আবার মৎস্য ঘাট, হাট-বাজার ও আড়তদারদের কাছে প্রকাশ্যে বিক্রি করা হচ্ছে। রায়পুরে কোস্টগার্ড ও নৌপুলিশ ফঁাড়ি নেই। রয়েছে চঁাদপুরের চরভৈরবী এলাকায়। তাদের সদস্যরা মাঝে মাঝে অভিযান চালিয়ে ওই ইলিশ জব্দ করলেও মৎস্য বিভাগ অভিযান চালাচ্ছে না। এতে ভবিষ্যতে নদীতে ইলিশের মহাসংকট দেখা দেবে। জেলে পল্লীতে মারাত্মক অভাব দেখা দেবে। তাই আমরা সরকারের কাছে এসব জাটকা ও মা ইলিশ শিকার ও বিক্রি বন্ধের জন্যে দ্রুত পদক্ষেপ নেয়ার আবেদন করছি।

জেলা মৎস্য অফিস সূত্রে জানা গেছে, ৪ অক্টোবর থেকে ২৫ অক্টোবর পর্যন্ত ইলিশ শিকার, পরিবহন, বিক্রি, বাজারজাতের ওপর সরকার নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। অথচ এ আইন মানছেন না অসাধু জেলে ও মৎস্য ব্যবসায়ীরা। লক্ষ্মীপুরের মৎস্য কর্মকর্তা আমিনুল ইসলাম জানান, মৎস্য কর্মকর্তা একজন পদায়ন করা হলেও তিনি না আসায় এবং এখন পর্যন্ত কোস্টগার্ড না দেয়ায় অভিযান পরিচালনা করতে পারছি না। এছাড়াও জেলা থেকে পৃথক অভিযানও চালানো হচ্ছে। তবে জনবল ও নৌযান সংকটের কারণে তারা পর্যাপ্ত অভিযান পরিচালনা করতে পারছেন না। রায়পুর উপজেলায় প্রায় ৬ হাজার জেলের নিবন্ধন রয়েছে। জেলে নিবন্ধন শুরু হলে আমরা নিবন্ধনের বাইরে থাকা জেলেদের নিবন্ধনের আওতায় নিয়ে আসার চেষ্টা করবো।

উপরোল্লিখিত দুটি সংবাদ পড়ে মনে হচ্ছে, দেশের মৎস্য মন্ত্রণালয় অভয়াশ্রম এলাকার প্রতিটি ঝুঁকিপূর্ণ জায়গায় মা ইলিশ রক্ষার পর্যাপ্ত প্রস্তুতি না নিয়ে এবং প্রচার ও সচেতনতামূলক কর্মসূচি পুরোপুরি না নিয়ে, প্রয়োজনীয় জনবল না দিয়ে, অর্থ বরাদ্দ না করে ও উপকরণ না দিয়ে সংবাদ সম্মেলন করে নৌবাহিনীর যুদ্ধ জাহাজ ও বিমানবাহিনীর ভয় দেখিয়ে অসাধু জেলেদের নিবৃত্ত করতে চেয়েছে। কিন্তু মতলব উত্তর ও রায়পুরের প্রত্যন্ত এলাকায় বেপরোয়াভাবে ও উৎসবমুখরতায় অসাধু জেলেরা মা ইলিশ নিধন করছে এবং লুকোচুরি করে নয়, প্রকাশ্যেই বিক্রি করছে। এতে অভয়াশ্রম এলাকার কিছু জায়গায় মা ইলিশ রক্ষার নামে মৎস্য মন্ত্রণালয় প্রহসন করছে কিনা সেটা নিয়ে প্রশ্ন ওঠার অবকাশ দেখা দিয়েছে।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়