শনিবার, ০৬ সেপ্টেম্বর, ২০২৫  |   ২৮ °সে
জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয় অন্যান্য
ব্রেকিং নিউজ
  •   ফরিদগঞ্জে কচুক্ষেত থেকে কিশোরের মরদেহ উদ্ধার

প্রকাশ : ০৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০১:৫৮

ভালো নেই ধামাইলের শেষ প্রদীপ রামকৃষ্ণ সরকার

এম. মুসলিম চৌধুরী, মৌলভীবাজার
ভালো নেই ধামাইলের শেষ প্রদীপ রামকৃষ্ণ সরকার

সিলেটের লোকঐতিহ্যের অন্যতম আকর্ষণ ধামাইল নৃত্যগীত। এক সময় বিয়ে, পূজা, অন্নপ্রাশন কিংবা গ্রামীণ আনন্দ-অনুষ্ঠান সবকিছুতেই ধামাইল ছিলো অপরিহার্য। নারীরা হাততালি দিয়ে চক্রাকারে ঘুরে ঘুরে গান গাইতেন, তাতে ফুটে উঠতো তাদের সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না আর জীবনের বেদনা। আজ সেই ধামাইল নাচ-গান বিলুপ্তির পথে। তবে এই হারানো ঐতিহ্য আঁকড়ে ধরে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন একজন মানুষ রামকৃষ্ণ সরকার। তবে এখন আর ভালো নেই রামকৃষ্ণ সরকার। কয়েক মাস ধরে জটিল রোগে আক্রান্ত হয়ে অসহায় জীবন পার করছেন তিনি।

IMG-20250906-WA0010

রামকৃষ্ণ সরকার শ্রীমঙ্গল উপজেলার ভুনবীর ইউনিয়নের রুস্তমপুর গ্রামের সন্তান। ছোটবেলা থেকেই ধামাইলের প্রতি ছিল গভীর টান। আশপাশের গ্রামে বিয়ের আসরে গিয়ে গোল হয়ে হাততালি দিয়ে নেচে ওঠা নারীদের ধামাইল নাচ তাকে মুগ্ধ করতে। সেই টান থেকেই শুরু হয় তার আজীবনের সংগ্রাম। গত দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে গ্রামে গ্রামে ঘুরে সংগ্রহ করেছেন প্রায় তিন শতাধিক ধামাইল, কীর্তন, বাউল ও আধ্যাত্মিক গান। শুধু সংগ্রহেই থেমে থাকেননি, এসব গানের সাথে নৃত্য ভঙ্গি মিলিয়ে নতুন প্রজন্মকে শিখিয়ে যাচ্ছেন নিরলসভাবে। ২০০৫ সালে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন নবনাগরী ধামাইল সংঘ ও ধামাইল একাডেমি। এখানেই শিশু থেকে মধ্যবয়সী ছেলে-মেয়েদের বিনামূল্যে প্রশিক্ষণ দেন। প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিল্পীরা আজ বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে ধামাইল পরিবেশন করছেন, যা আবারও মানুষের মধ্যে আগ্রহ জাগাচ্ছে।

রামকৃষ্ণ সরকারের পথ মোটেও সহজ ছিল না। অভাব-অনটনের সংসারে থেকেও লোকসংস্কৃতিকে বাঁচাতে তিনি জীবন উৎসর্গ করেছেন। তাঁর তিন মেয়ে সুমি, রুমি ও ঝুমি বাবার কাজে পাশে থেকেছেন সর্বদা। বাবার সাথে গান সংগ্রহে যোগ দিয়েছেন, শিখেছেন ধামাইলও। কিন্তু বর্তমানে রামকৃষ্ণ সরকার অসুস্থ, চিকিৎসার খরচ বহন করার মতো সামর্থ্য নেই পরিবারের। স্ত্রী শুকলা রানী বলেন, সংসার কষ্টে চলে, মেয়েদের পড়ালেখা সামলাতে হিমশিম খাচ্ছি। এখন স্বামীর চিকিৎসার ব্যয় আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়। ছোট মেয়ে ঝুমি সরকারের কণ্ঠে বিষাদের আক্ষেপ, বাবা লোকসংস্কৃতিকে বাঁচাতে সারাটা জীবন দিয়েছেন। কিন্তু তাঁকে বাঁচিয়ে রাখার জন্যে কোনো সরকারি বা প্রাতিষ্ঠানিক সহায়তা আমরা পাইনি। বারবার দরজায় ধর্ণা দিয়েও শুধু আশার বাণী মিলেছে।

লোক গবেষক পার্থ তালুকদার মনে করেন, সিলেট অঞ্চল মরমি সাধক ও চারণকবিদের উর্বর ভূমি। রাধারমণ দত্ত, হাছন রাজা, শাহ আবদুল করিমদের পদগীত বিশ্বজুড়ে সঙ্গীতপ্রেমীদের প্রাণে স্পন্দন জাগিয়েছে। অথচ সংরক্ষণের অভাবে বহু পদ, সুর ও গানের ধারা হারিয়ে গেছে। তাঁর মতে, রামকৃষ্ণ সরকারের মতো সংগ্রাহক না থাকলে ধামাইলও হয়তো একদিন হারিয়ে যাবে। আজও রামকৃষ্ণ সরকার গুনগুন করে গেয়ে উঠেন তাঁর প্রিয় রাধারমণ দত্তের গান-আমার বন্ধু দয়াময়, তোমারে দেখিবার মনে লয়। সেই সুরে মিশে থাকে একদিকে জীবনের ক্লান্তি, অন্যদিকে সংস্কৃতি রক্ষার অদম্য তাগিদ।

ধামাইল শুধু নাচ-গান নয়; এটি নারীর অনুভূতির ভাষা, সমাজ-সংস্কৃতির আয়না। রামকৃষ্ণ সরকারের জীবনের সংগ্রাম আমাদের মনে করিয়ে দেয় আধুনিকতার নামে পুরনোকে বিসর্জন দেওয়া কখনোই প্রগতির পথ নয়। বরং ঐতিহ্যের শেকড়েই নিহিত আছে নতুন প্রজন্মের ভিত্তি।

রামকৃষ্ণ সরকার দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বলেন, আজ আমি অসুস্থ। শরীরের সীমাহীন ক্লান্তি আমাকে টেনে ধরে রাখে, কিন্তু তবুও আমি থামিনি। আমার নিঃশ্বাস যতদিন চলবে, ততদিন আমি ধামাইলকে বাঁচিয়ে রাখার লড়াই চালিয়ে যাবো। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত আমি আমার সমস্ত শ্রম, ভালোবাসা আর সাধনা উৎসর্গ করে যাবো সিলেটের লোকঐতিহ্য রক্ষায়। কারণ ধামাইল শুধু একটি নৃত্য নয়, এটি আমাদের অস্তিত্ব, আমাদের শিকড়, আমাদের প্রাণের ভাষা।” আজ যখন তিনি চিকিৎসার অভাবে সংগ্রাম করছেন, তখন প্রশ্ন জাগে আমরা কি পারব না এই সংস্কৃতি রক্ষকের পাশে দাঁড়াতে? ধামাইল বাঁচানো মানে শুধু সিলেট নয়, বাংলাদেশের লোকঐতিহ্যকে বাঁচানো।

ডিসিকে/এমজেডএইচ

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়