প্রকাশ : ১৮ মে ২০২৫, ০৫:৫৫
শেষ ঠিকানার কারিগর: মনু মিয়ার নিঃস্বার্থ জীবনের গল্প!

|আরো খবর
শেষ ঠিকানার কারিগর: কবর খোঁড়ার ৫০ বছরের সেবায় নিঃস্বার্থ মনু মিয়া
পঞ্চাশ বছরেরও বেশি সময় ধরে কবর খুঁড়ে যাওয়া মনু মিয়া আজ হাসপাতালের শয্যায়। তাঁর জীবনের এই নিঃস্বার্থ সেবা আমাদের সমাজের বিবেককে নাড়া দেয়।
১. ভূমিকা: এক নিঃস্বার্থ সেবকের গল্প
কিশোরগঞ্জ জেলার ইটনা উপজেলার জয়সিদ্ধি ইউনিয়নের আলগাপাড়া গ্রামের বাসিন্দা মনু মিয়া। বয়স ৬৭ বছর। জীবনের পঞ্চাশ বছরেরও বেশি সময় তিনি কবর খুঁড়ে গেছেন নিঃস্বার্থভাবে। মানুষের মৃত্যুসংবাদ পেলেই খুন্তি, কোদালসহ প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি নিয়ে ছুটে যেতেন কবরস্থানে। এই সেবার জন্য তিনি কখনো কোনো পারিশ্রমিক নেননি।
২. জীবনের সংগ্রাম ও সেবা
মনু মিয়া তাঁর জীবনের অর্ধশতাব্দীরও বেশি সময় ধরে কবর খুঁড়ে গেছেন। তাঁর হাতে খোঁড়া কবরের সংখ্যা ৩,০৫৭টি। স্থানীয়ভাবে তিনি পরিচিত ছিলেন ‘শেষ ঠিকানার কারিগর’ হিসেবে। তিনি একটি রেজিস্টার খাতায় প্রতিটি কবরের নাম, তারিখ ও স্থান লিপিবদ্ধ করে রাখতেন। তার এই রেকর্ড স্থানীয় প্রশাসনের অনেকেরও অজানা নয়।
এই সেবার জন্য তিনি কখনো কোনো পারিশ্রমিক নেননি। মানুষের অন্তিম যাত্রায় তিনি ছিলেন এক অনন্য সহচর।
কখনো গ্রামে, কখনো পাশের উপজেলার কোন মৃত ব্যক্তির খবর পেয়ে নাওয়া-খাওয়া বাদ দিয়ে ছুটে যেতেন তিনি। অনেক সময় বৃষ্টির মধ্যে, অন্ধকার রাতে, ঝড়ে কিংবা প্রখর রোদে তিনি তাঁর দায়িত্ব পালন করেছেন। তার এই সেবা ছিল ধর্মীয় অনুভব ও মানবিক দায়িত্ব থেকে উৎসারিত।
৩. প্রিয় সঙ্গী: ঘোড়া
জীবনের একটি পর্যায়ে তিনি দেখলেন, পায়ে হেঁটে অনেক দূর যেতে দেরি হয়। জরুরি সময়ে মৃতদেহ কবর দেওয়ার জন্য দ্রুত পৌঁছানো দরকার। তখন নিজের ধানিজমি বিক্রি করে একটি ঘোড়া কেনেন। এই ঘোড়াই তার সঙ্গী হয়ে ওঠে। এই ঘোড়াটিকে নিয়েই তিনি বছরের পর বছর মৃত্যুর খবর পেলেই ছুটে গেছেন কবরস্থানে।
দুর্ভাগ্যবশত, দুর্বৃত্তরা তাঁর প্রিয় ঘোড়াটিকে হত্যা করে। এই ঘটনার পর থেকে মনু মিয়া মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন।
ঘোড়াটি ছিল শুধু বাহন নয়, বরং একটি পরিবারের সদস্যের মতো। যারা তার পাশে থাকত, সঙ্গ দিত দীর্ঘ পথে। ঘোড়াটির হত্যার পর তিনি প্রায় এক মাস কোনো কবর খোঁড়েননি। তার চোখে জল দেখা গেছে, যা কিশোরগঞ্জবাসীর হৃদয় বিদীর্ণ করেছে।
৪. বর্তমান অবস্থা: হাসপাতালের শয্যায়
দীর্ঘদিনের কষ্ট ও অবহেলায় মনু মিয়া আজ নানা জটিল রোগে আক্রান্ত। রাজধানীর একটি বেসরকারি হাসপাতালে তিনি চিকিৎসাধীন। তার শরীরে ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, হূদরোগের মতো অসুখ বাসা বেঁধেছে। চিকিৎসা খরচ বহন করাও তার জন্য কষ্টকর। অনেক শুভানুধ্যায়ী তার পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছেন।
তাঁর স্ত্রী রহিমা বেগম স্বামীর পাশে ছায়ার মতো আছেন। তাঁরা নিঃসন্তান, এবং এই কঠিন সময়ে তাঁদের পাশে দাঁড়ানো আমাদের সমাজের দায়িত্ব।
৫. সমাজের অবহেলা ও আমাদের করণীয়
মনু মিয়ার মতো সেবক সমাজে দুর্লভ। আমাদের সমাজ যখন আত্মকেন্দ্রিকতায় নিমজ্জিত, তখন তিনি ছিলেন নিঃস্বার্থতার এক জীবন্ত প্রতীক। কিন্তু সমাজ ও রাষ্ট্র তার এই অবদানের যথাযথ মূল্যায়ন কখনো করেনি। কোনো পদক, কোনো সরকারি সম্মাননা, এমনকি একটি মাসিক ভাতাও তিনি পাননি।
এই সমাজের বিবেক কি তখনও জাগবে না, যখন এমন একজন ব্যক্তি হাসপাতালে মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছেন, আর রাষ্ট্র নিশ্চুপ?
আমাদের করণীয়—
- ১. রাষ্ট্রীয়ভাবে মনু মিয়াকে সম্মাননা দেওয়া;
- ২. তার চিকিৎসার সম্পূর্ণ খরচ সরকারিভাবে বহন করা;
- ৩. স্থানীয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে তার বাড়িতে চিকিৎসা সহায়তা ও মাসিক ভাতা নিশ্চিত করা;
- ৪. তার জীবনের গল্পকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আলোচনা করার মতো উদাহরণ হিসেবে তুলে ধরা।
"মনু মিয়া সারা জীবন নিঃস্বার্থভাবে মানুষের জন্য কাজ করেছেন। তাঁর অনুপস্থিতিতে তাঁর প্রিয় ঘোড়াটিকে এভাবে দুর্বৃত্তরা মেরে ফেলল। এটা খুবই নিন্দনীয় কাজ হয়েছে। এ অপরাধের বিচার হওয়া উচিত।"
৬. উপসংহার: আমাদের বিবেকের প্রশ্ন
মনু মিয়ার জীবনের এই নিঃস্বার্থ সেবা আমাদের সমাজের বিবেককে নাড়া দেয়। আমরা কি পারি না এই জীবন্ত মানবিকতা ও ত্যাগের প্রতীককে বাঁচিয়ে রাখতে? তাঁর জীবনের শেষ অধ্যায়ে আমাদের উচিত তাঁর পাশে দাঁড়ানো, তাঁর সেবার স্বীকৃতি দেওয়া এবং ভবিষ্যতে এমন সেবকদের সম্মানিত করা।
— ডিসিকে/এমজেডএইচ