প্রকাশ : ২৯ অক্টোবর ২০২৫, ২২:৪১
চাঁদাবাজির ফাঁদে চাঁদপুর-ঢাকার সংক্ষিপ্ত সড়ক-যাত্রা
বাবুরহাট থেকে দাউদকান্দি পর্যন্ত যাত্রী ও চালকদের নিত্য আতঙ্ক

চাঁদপুর শহরের বাবুরহাট মাইক্রো স্ট্যান্ড থেকে শুরু করে ঢাকা পর্যন্ত দীর্ঘ যাত্রাপথে প্রতিদিন শত শত যাত্রী ও মাইক্রোবাস চালক চাঁদাবাজদের কবলে পড়ছেন। এই সংক্ষিপ্ত রুটে চাঁদাবাজিই ভয়াবহ সমস্যা হিসেবে এখন স্বল্প সময়ে স্বস্তিময় যাত্রার অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাবুরহাট মাইক্রো স্ট্যান্ড থেকে শুরু করে মতলব দক্ষিণ ও মতলব উত্তর- দাউদকান্দি সংযোগ সেতু (শ্রীরায়েরচর ব্রীজ) সংলগ্ন এলাকায় যে পরিমাণ চাঁদাবাজি হচ্ছে, তা শুধু অবৈধ নয়, বরং যাত্রী ও চালকদের জন্যে এক ধরনের মানসিক ও আর্থিক নির্যাতনে পরিণত হয়েছে। বিশেষ করে বাবুরহাট, মতলব দক্ষিণের শেষ প্রান্ত এবং মতলব উত্তর ও দাউদকান্দি সংযোগ সেতু এলাকায় চাঁদাবাজি এখন একটি রুটিন চিত্রে পরিণত হয়েছে। এই চাঁদাবাজি শুধু চালক বা গাড়ির ক্ষতি করছে না, এর প্রভাব পড়ছে সাধারণ যাত্রীদের যাতায়াত খরচ ও নিরাপত্তার ওপর।
|আরো খবর
অনুসন্ধানে ও সরজমিন পর্যবেক্ষণ করে দেখা গেছে, বাবুরহাট মাইক্রোবাস স্ট্যান্ডে পৌরসভা নির্ধারিত টোল আদায়ে ব্যাপক অনিয়ম হচ্ছে। গাড়িপ্রতি দৈনিক একবার ২০ টাকা টোল আদায়ের কথা থাকলেও ইজারাদাররা নিচ্ছেন গাড়িপ্রতি ৪০০-৫০০ টাকা প্রতি ট্রিপে। এমনকি কিছু কিছু গাড়ির ক্ষেত্রে মাথাপিছু যাত্রীপ্রতি ১০০ টাকা করে অর্থাৎ ৬ সিটের গাড়ির জন্যে ৬০০ টাকা ও ১০ সিটের গাড়ির জন্যে ১০০০ টাকা পর্যন্ত নেয়া হচ্ছে।
চাঁদপুরের যাত্রীদের জন্যে কম সময়ে ঢাকা যেতে নৌপথের বিকল্প হিসেবে একটি মাধ্যম হচ্ছে বাবুরহাট থেকে মাইক্রো কিংবা প্রাইভেট কারে করে যাওয়া। কিন্তু যাত্রীদের অভিযোগ, এ পথে ঢাকায় যেতে মাইক্রো কিংবা প্রাইভেট কারে গুণতে হচ্ছে অতিরিক্ত ভাড়া।
একাধিক যাত্রী বলেন, নৌপথের চেয়ে বেশি ভাড়া আদায় করা হচ্ছে বাবুরহাট ট্যাক্সি ক্যাব স্ট্যান্ডে। ঈদ, পূজা, পয়লা বৈশাখ, বৈরী আবহাওয়ার দিনগুলোসহ বিশেষ ছুটির দিনগুলোতে এই ভাড়া নৌপথের ভাড়ার তিনগুণ, চারগুণ এমনকি পাঁচগুণও হয়ে যায়। নন এসি গাড়িতে সাধারণত ৪০০-৫০০ টাকা এবং এসি গাড়িতে ৬০০-৭০০ টাকা করে যাত্রীপ্রতি ভাড়া নেয়া হচ্ছে।
ভাড়া বেশি নেয়ার অভিযোগের প্রেক্ষিতে ড্রাইভাররা বলেন, পৌরসভা গাড়িপ্রতি দৈনিক একবার ২০ টাকা টোল নির্ধারণ করেছে। কিন্তু আমাদের কাছ থেকে প্রতি ট্রিপে ৪০০-৫০০ টাকা, এমনকি কিছু গাড়ির ক্ষেত্রে ১০০০ টাকাও নেয়া হচ্ছে (যে গাড়িগুলো ঢাকা থেকে চাঁদপুরে ভাড়া নিয়ে আসে এ রকম বাইরের গাড়িগুলোকে গুণতে হয় যাত্রীপ্রতি মাথাপিছু ১০০ টাকা করে)। টোল আদায়ে পৌরসভার নির্ধারিত যে হার রয়েছে এবং দৈনিক একবার আদায়ের যে বিধান রয়েছে, তা যদি ইজারাদাররা মানে, তাহলে ভাড়া কমাতে আমাদের কোনো আপত্তি নেই। ড্রাইভারদের কাছে জানতে চাওয়া হয় 'আপনারা প্রতিবাদ করছেন না কেনো?' উত্তরে তারা জানান, ইজারাদাররা অনেক প্রভাবশালী। প্রতিবাদ করলে পরের দিন হতে এখান থেকে আর কোনো ট্রিপ নিতে পারবো না।
এ বিষয়ে চাঁদপুর পৌরসভার কর শাখার প্রধান তৌহিদুল ইসলাম চপল বলেন, ২০০৯ সাল থেকে বাবুরহাট ট্যাক্সি ক্যাব স্ট্যান্ড ইজারা দেয়া আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু করে চাঁদপুর পৌরসভা। গত বছর এই ইজারা মূল্য ছিলো ৩ লাখ ৭০ হাজার টাকা ( ১০% আয়কর, ১৫% ভ্যাট ও ৫% জামানতসহ যা ছিলো প্রায় ৪ লাখ ৮১ হাজার টাকা)। কিন্তু এ বছর ২৮টি সিডিউল বিক্রি হয় এবং ইজারাদারদের মধ্যে ব্যাপক প্রতিযোগিতায় শেষ পর্যন্ত ২৬ লাখ ৫৫ হাজায় টাকায় (সাথে আয়কর ১০%, ভ্যাট ১৫% ও জামানত ৫%সহ) বাবুরহাট মাইক্রো স্ট্যান্ডটি ইজারা নেন হাবিবুর রহমাল মাল।
যাত্রী সেবার বিষয়ে চাঁদপুর সড়ক পরিবহন নেতা বাবুল মিজি জানান, চাঁদপুর-ঢাকা সড়ক পথে লাক্সারি গাড়ি তেমন নেই। পরিবহন মালিকরা চেষ্টা করছে কীভাবে মানুষকে আধুনিক সুযোগ-সুবিধা সম্পন্ন গাড়ির মাধ্যমে সেবা দেয়া যায়। তবে সড়কে চাঁদাবাজি বিষয়ে তিনি জানান, বড়ো গাড়ি থেকে কোনো চাঁদা নেয় না বা নেয়ার সুযোগ নেই। বাবুরহাট মাইক্রো স্ট্যান্ডের ড্রাইভার ও যাত্রীরা এ বিষয়ে ভালো বলতে পারবে।
মাইক্রো স্ট্যান্ডটির ইজারা নীতিমালা সম্পর্কে পৌর কর্মকর্তা তৌহিদুল ইসলাম চপল বলেন, দিনে একবার গাড়িপ্রতি ২০ টাকা টোল আদায় করবে ইজারাদার। 'গাড়িপ্রতি ৪০০-৫০০ টাকা করে টোল আদায় হচ্ছে' এ বিষয়ে চপল বলেন, পৌরসভার বিধানের বাইরে টোল আদায়ের সুযোগ নেই। গাড়িপ্রতি ৪০০-৫০০ টাকা করে টোল নেয়া হচ্ছে এমন কোনো অভিযোগ আমাদের কাছে আসেনি।
ওয়্যারলেস মোড়ে মাইক্রো-প্রাইভেটকার স্ট্যান্ডের কোনো ইজারা আছে কিনা জানতে চাইলে চপল বলেন, ওয়্যারলেস মোড়ে আমাদের কোনো স্ট্যান্ড নেই। 'তাহলে কারা তুলছেন প্রাইভেট কার-মাইক্রো থেকে গাড়িপ্রতি ২০০-৩০০ টাকা, কিছু গাড়ি থেকে তারও অধিক চাঁদা' এমন প্রশ্নের জবাবে চপল বলেন, কারা তুলছেন চাঁদা তা আমাদের জানা নেই। তবে বিষয়টি সম্পর্কে আমাদের কাছে অভিযোগ এসেছে। আমাদের পৌরসভার প্রশাসক মহোদয় এ বিষয়ে শীঘ্রই ব্যবস্থা নেবেন।
এ বিষয়ে চাঁদপুর পৌরসভার প্রশাসক মো. গোলাম জাকারিয়া বলেন, পৌরসভার নির্ধারিত যে টোল আছে তা আমরা চার্ট আকারে বাবুরহাট মাইক্রো স্ট্যান্ডে লাগিয়ে দিয়েছি। পৌরসভার নির্ধারিত যে টোল রয়েছে গাড়িপ্রতি দিনে একবার ২০ টাকা, তারচে' বেশি নেয়ার সুযোগ নেই। টোল আদায়ে অনিয়ম হয়েছে বলে অভিযোগ পেয়েছি, শীঘ্রই জেলা প্রশাসক মহোদয়ের সাথে পরামর্শ করে ব্যবস্থা নেয়া হবে।
পৌর প্রশাসক আরো বলেন, ওয়্যারলেস ট্যাক্সিক্যাব স্ট্যান্ডের আমরা কোনো ইজারা দেই নি। আমরা শুনেছি, কিছু অসাধু লোক সেখান থেকে চাঁদা তুলছে। তাদের বিরুদ্ধেও জেলা প্রশাসক মহোদয়ের সাথে কথা বলে ব্যবস্থা নেয়া হবে।
মতলব উত্তর-দাউদকান্দি সংযোগ সেতুর গোড়া এলাকায় কিছু কথিত শ্রমিক সংগঠন বা ‘টোল আদায়কারী’ চক্র সক্রিয়। তারা কখনো কাগজ চেক করার নামে, কখনো আবার ‘লাইনের জন্যে’ বলে ২০০-৩০০ টাকা পর্যন্ত আদায় করে। যাদের কাছে টাকা না থাকে তাদের হয় অপমান করা হয়, নয়তো গাড়ি আটকে রেখে দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষা করানো হয়।
ফরিদগঞ্জের এক মাইক্রোবাস চালক জানান, আমি প্রতিদিন ঢাকা যাই। সারাদিনে ৩-৪ জায়গায় চাঁদা দিতে হয়। শুধু দাউদকান্দিতেই ৩০০ টাকা গেছে। না দিলে গাড়ি আটকে রাখে ও গালি দেয়। একজন যাত্রী জানালেন, আমাদের যাত্রীদের কাছ থেকেও অনেক সময় সরাসরি টাকা চায়। যদি মাইক্রো চালক দিতে না চায় তখন যাত্রীদের বলছে ‘ভাড়া বাড়বে’। কেউ প্রতিবাদ করলে শুনতে হয়, এই রাস্তা দিয়ে যেতে হলে এমন নিয়ম মানতেই হবে।
অনুসন্ধানে উঠে এসেছে, এই চাঁদাবাজি মূলত স্থানীয় প্রভাবশালী মহল, কথিত পরিবহন শ্রমিক ইউনিয়ন ও প্রশাসনের কিছু অসাধু সদস্যের সমন্বয়ে পরিচালিত হয়। পুলিশি নজরদারির অভাব ও স্থানীয় রাজনৈতিক ছত্রছায়া এই চক্রকে আরও বেপরোয়া করে তুলেছে। জানা গেছে, একটি ছায়া সংগঠন, যারা নাকি ‘লাইনের সুবিধা’ বা ‘নিরাপত্তা’ দেয়ার নামে চাঁদা আদায় করছে। অথচ বাস্তবে এদের কোনো আইনগত ভিত্তি নেই।
চাঁদপুর ও দাউদকান্দি পুলিশের কিছু সদস্যের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তারা এসব বিষয়ে অবগত হলেও অপর্যাপ্ত জনবল ও স্পষ্ট অভিযোগ না পাওয়ার অজুহাতে কার্যকর পদক্ষেপ নিচ্ছেন না।
চাঁদপুর জেলা পুলিশ সুপার বরাবর একাধিকবার লিখিত অভিযোগ দেয়া হলেও দৃশ্যমান ব্যবস্থাগ্রহণ করা হয়নি।
অভিযোগকারী চালকরা জানান, যখন অভিযোগ জানানো হয়, তখন পুলিশ বলে, ঠিক আছে দেখি, কিন্তু পরে ফোন ধরে না।
অনুসন্ধানে জানা যায়, বাবুরহাট মাইক্রো স্ট্যান্ডে চাঁদপুর পৌরসভা থেকে নির্ধারিত রসিদে টাকা গ্রহণের নিয়ম থাকলেও তা মানা হচ্ছে না। তারা গাড়িপ্রতি বেশি টাকা নিয়ে থাকে, যা যাত্রীদের নিকট থেকে বেশি ভাড়ার মাধ্যমে আদায় করা হচ্ছে। কিছুদিন পূর্বে মতলব উত্তরের শেষ প্রান্ত শ্রীরায়েরচর স্ট্যান্ডে সিএনজি চালকরা মাইক্রোবাসের গতিরোধ করে চালককে মারধর করে। এতে চালক জানান, আমরা পরিবহন নেতাকে (নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক) মাসিক হিসেবে টাকা প্রদান করি, সে টাকা লাইনে না দিলে আমরা কী করবো? চাঁদপুর জেলা মাইক্রোবাস মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক জানান, আমরা বহুবার দাউদকান্দির সমস্যার কথা পুলিশ ও জেলা প্রশাসনকে জানিয়েছি। কিন্তু আমাদের গাড়িগুলোর ওপর যারা চাঁদাবাজি চালায়, তারা বড়ো বড়ো রাজনৈতিক দলের ছত্রছায়ায় থাকে। তিনি আরও জানান, চাঁদাবাজদের মধ্যে অনেকেই পরিচিত রাজনৈতিক নেতার নাম ব্যবহার করে ভয়-ভীতি দেখান।
বাংলাদেশে দণ্ডবিধির ৩৮৫ ও ৩৮৬ ধারায় চাঁদাবাজি স্পষ্টতই অপরাধ। কোনো ব্যক্তি যদি ভয়-ভীতি বা জোরপূর্বক অন্যের কাছ থেকে অর্থ আদায় করে, তাহলে তার সর্বোচ্চ শাস্তি ১০ বছরের কারাদণ্ড হতে পারে।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে (ফেসবুকে) প্রতিনিয়ত যাত্রী ও চালকদের ভিডিও বা পোস্ট ভাইরাল হচ্ছে। কিন্তু প্রশাসনের পক্ষ থেকে নেই তেমন কোনো পদক্ষেপ। অনেকেই বলছেন, এই চাঁদাবাজি বন্ধে কার্যকর ব্যবস্থাগ্রহণ করা উচিত।








