বৃহস্পতিবার, ১১ সেপ্টেম্বর, ২০২৫  |   ৩৩ °সে
জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয় অন্যান্য

প্রকাশ : ১১ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০৯:২৫

নকল টিভি চ্যানেল : বাংলাদেশের অনলাইন বিভ্রান্তির নতুন ফাঁদ

তথ্য-প্রযুক্তি কণ্ঠ ডেস্ক
নকল টিভি চ্যানেল : বাংলাদেশের অনলাইন বিভ্রান্তির নতুন ফাঁদ

'এইমাত্র পাওয়া'—এই বাক্যটি দেখলেই অনেকেই ধরে নেন, খবরটি গুরুত্বপূর্ণ এবং সত্য। কিন্তু যদি সেই খবরটি আসে একটি ইউটিউব চ্যানেল থেকে, যার নাম 'ATN Bangla 24' বা 'Channel i Update'—তবে কি সেটি আসল? নাকি শুধুই নামের খেলায় বিভ্রান্তি?

বাংলাদেশে অনলাইনে জাতীয় মানের টিভি চ্যানেলের নাম ও লোগো নকল করে গুজব, ভুয়া সংবাদ এবং বিভ্রান্তিকর তথ্য ছড়ানোর প্রবণতা আশঙ্কাজনকভাবে বেড়েছে। এই ফিচারটি সেই সংকটের গভীরে প্রবেশ করে দেখবে কীভাবে এই ভুয়া চ্যানেলগুলো কাজ করে, কেন এগুলো এতো বিপজ্জনক এবং কীভাবে আমরা সচেতনতা ও প্রযুক্তিগত জ্ঞান দিয়ে এই বিভ্রান্তি মোকাবেলা করতে পারি।

বিভ্রান্তির কৌশল : নাম, লোগো এবং বিশ্বাস

ভুয়া টিভি চ্যানেলগুলো সাধারণত নিচের কৌশলগুলো ব্যবহার করে :

১. নামের অনুকরণ

– আসল চ্যানেলের নামের সঙ্গে মিল রেখে নতুন নাম তৈরি করা হয়। যেমন :

– 'ATN Bangla' → 'ATN Bangla 24'

– 'Channel i' → 'Channel i Update'

– 'Somoy TV'→ 'Somoy News BD'

– 'Independent TV' → 'Independent 24×7'

২. লোগোর নকল

– আসল চ্যানেলের লোগো হুবহু কপি করে ব্যবহার করা হয়, কখনো রঙ বা ফন্টে সামান্য পরিবর্তন করে।

৩. ইউটিউব ও ফেসবুক পেজ

– এসব নাম ও লোগো ব্যবহার করে ইউটিউব চ্যানেল, ফেসবুক পেজ বা ওয়েবসাইট খোলা হয়।

– 'Breaking News' শিরোনামে ভুয়া ভিডিও বা পোস্ট ছড়ানো হয়।

৪. ভুয়া রিপোর্টার পরিচয়

– কিছু চ্যানেল 'আমাদের প্রতিনিধি' বলে ভুয়া রিপোর্ট তৈরি করে, যাতে সাধারণ মানুষ বিভ্রান্ত হয়।

কিছু বিভ্রান্তিকর চ্যানেলের নাম (উদাহরণস্বরূপ)

শুধুমাত্র বিশ্লেষণ ও সচেতনতার উদ্দেশ্যে উল্লেখ করা হয়েছে। এগুলোর মধ্যে কিছু হয়তো ইতোমধ্যে বন্ধ হয়েছে বা পরিবর্তিত হয়েছে।

নিচে প্রথমে ভুয়া চ্যানেলের নাম, তারপর আসল চ্যানেলের অনুকরণ ও কোন্ প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার হয় তা উল্লেখ করা হলো।

ATN Bangla 24 – ATN Bangla – YouTube.

Channel i Update – Channel i – Facebook.

Somoy News BD – Somoy TV – YouTube.

Independent 24×7 – Independent TV – YouTube.

NTV Online News – NTV – Facebook.

Ekattor Breaking – Ekattor TV – YouTube.

RTV 24 – RTV – YouTube.

Boishakhi Live – Boishakhi TV – Facebook.

কেন মানুষ বিভ্রান্ত হয়?

বিশ্বাসযোগ্যতা : পরিচিত নাম ও লোগো দেখে মানুষ ধরে নেয়, এটি আসল চ্যানেল।

দ্রুত তথ্য পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা : 'এইমাত্র পাওয়া' বা 'ব্রেকিং নিউজ' শিরোনামে মানুষ দ্রুত ক্লিক করে।

আবেগঘন বিষয় : ধর্ম, রাজনীতি, সেলিব্রিটি মৃত্যু, বা দুর্যোগ—এসব বিষয়ে ভুয়া খবর ছড়ালে মানুষ সহজেই প্রতিক্রিয়া দেয়।

সোশ্যাল মিডিয়ার অ্যালগরিদম : বেশি শেয়ার, কমেন্ট বা রিঅ্যাকশন পেলে পোস্টটি আরও ছড়িয়ে পড়ে।

প্রভাব : বিভ্রান্তি থেকে সহিংসতা

এই ভুয়া চ্যানেলগুলোর প্রভাব শুধু বিভ্রান্তি নয়—তা সমাজে বাস্তব ক্ষতি ডেকে আনে :

– ভুয়া মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পরিবারকে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত করা

– রাজনৈতিক উত্তেজনা বাড়ানো

– ধর্মীয় সংবেদনশীলতা উসকে দিয়ে সহিংসতা সৃষ্টি

– স্বাস্থ্য সংক্রান্ত ভুয়া তথ্য ছড়িয়ে চিকিৎসা বিভ্রান্তি

একটি উদাহরণ—২০২৪ সালের একটি ঘটনায়, 'Channel i Update' নামের একটি ইউটিউব চ্যানেল একটি জনপ্রিয় অভিনেতার মৃত্যুর ভুয়া খবর ছড়িয়ে দেয়। কয়েক ঘণ্টার মধ্যে খবরটি ভাইরাল হয় এবং অভিনেতার পরিবারকে সংবাদ সম্মেলন করে তা অস্বীকার করতে হয়।

কীভাবে প্রতিরোধ করা যায়?

যাচাই করুন

– কোনো চ্যানেলের নাম দেখলেই বিশ্বাস করবেন না।

– ইউটিউব বা ফেসবুকে 'Verified' চিহ্ন আছে কি না, তা দেখুন।

অফিসিয়াল ওয়েবসাইটে যান

– আসল চ্যানেলের ওয়েবসাইটে গিয়ে খবরটি আছে কি না, তা যাচাই করুন।

ফ্যাক্ট-চেকিং প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করুন

– BD FactCheck, Rumor Scanner Bangladesh-এর মতো প্ল্যাটফর্মে যাচাই করুন।

রিপোর্ট করুন

– ভুয়া চ্যানেল বা পোস্ট দেখলে ইউটিউব বা ফেসবুকে 'Report' করুন।

সচেতনতা ছড়ান

– পরিবার, বন্ধু, সহকর্মীদের এসব বিষয়ে সচেতন করুন।

শিক্ষার ভূমিকা

বাংলাদেশে 'ডিজিটাল লিটারেসি' শিক্ষা জরুরি। শিক্ষার্থীদের শেখাতে হবে :

– ভুয়া খবর শনাক্ত করার কৌশল

– সোশ্যাল মিডিয়ার নিরাপদ ব্যবহার

– বিশ্বাসযোগ্য উৎস চেনার উপায়

সরকারের করণীয়

বাংলাদেশ সরকার ইতোমধ্যে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন চালু করেছে। তবে আরও কিছু পদক্ষেপ প্রয়োজন :

– ভুয়া চ্যানেল শনাক্তে প্রযুক্তিগত টুলস তৈরি

– সোশ্যাল মিডিয়া কোম্পানিগুলোর সঙ্গে সমন্বয়

– জনসচেতনতা বৃদ্ধির জন্য ক্যাম্পেইন

নকল টিভি চ্যানেলের নাম ও লোগো ব্যবহার করে অনলাইনে বিভ্রান্তি ছড়ানো এখন আর শুধু প্রযুক্তিগত সমস্যা নয়—এটি সামাজিক, নৈতিক, এবং গণতান্ত্রিক সংকট। এই সংকট মোকাবিলায় প্রয়োজন সচেতনতা, শিক্ষা, প্রযুক্তি এবং সৃজনশীলতার সম্মিলিত প্রয়াস।

আমরা যদি এখনই সচেতন না হই, তাহলে ভবিষ্যতের সমাজ হবে বিভ্রান্তির, ভয়ের এবং অবিশ্বাসের। কিন্তু যদি আমরা তথ্যের আলোয় এগিয়ে যাই, তাহলে প্রযুক্তির অন্ধকারকে জয় করা সম্ভব।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়