রবিবার, ০৪ মে, ২০২৫  |   ২৭ °সে
জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয় অন্যান্য
ব্রেকিং নিউজ
  •   চাঁদপুর জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি ইউসুফ গাজী গ্রেফতার

প্রকাশ : ১৩ জুন ২০২৪, ০০:০০

ব্যাটারিচালিত রিক্সার ভালো-মন্দ

ড. এম মেসবাহউদ্দিন সরকার
ব্যাটারিচালিত রিক্সার ভালো-মন্দ

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিচক্ষণতায় ব্যাটারিচালিত রিকশা চলাচলের পুনঃঅনুমতি পাওয়ায় দুমুঠো ডাল-ভাত খাওয়ার দুশ্চিন্তা থেকে মুক্তি পেয়েছে এর সঙ্গে জড়িত কয়েক লাখ রিকশাচালকের পরিবার। রাজধানীসহ সারাদেশে যানবাহনের মধ্যে একটি উল্লেখযোগ্য সংখ্যা হলো ব্যাটারিচালিত থ্রি-হুইলার বা অটোরিকশা।

এদের বেপরোয়া এবং নিয়ন্ত্রণহীন চলাচলের কারণে সাধারণ মানুষ খুবই বিরক্ত হলেও এর চাহিদার কোনো কমতি নেই। স্বল্প দূরত্বে এবং কম খরচে যাতায়াতের ক্ষেত্রে এর গ্রহণযোগ্যতা দেশব্যাপী। শুরুতে পঙ্গু ও প্রতিবন্ধী লোকদের জন্য এর অনুমতি দেওয়া হলেও বর্তমানে অনেক সুস্থ ব্যক্তিও এগুলো চালাচ্ছেন। বিপুল জনসংখ্যার এই দেশে বেকারত্বের হার বেশি।

তাই শিক্ষিত/অল্প শিক্ষিত অনেক যুবক এই পেশায় এসে তাদের বেকারত্ব ঘুচিয়েছে। তবে আতঙ্কের বিষয় হলো, তারা ট্রাফিক নিয়মের কোনো ধার ধারে না। উল্টোপথে, আড়াআড়ি, কোনাকুনি যেভাবে পারে তারা চলছে আর দুর্ঘটনায় পতিত হচ্ছে। মাঝে মধ্যে নিজেরাই মুখোমুখি সংঘর্ষে পতিত হয়ে রাস্তার পাশে পড়ে থাকতে দেখা যায়।

মহাসড়কে দূরপাল্লার গাড়ির চাকায় পিষ্ট হচ্ছে হর-হামেশাই। এভাবে গত কয়েক বছরে বিশেষ করে ঈদের সময় সড়ক দুর্ঘটনার একটি বড় অংশই ঘটছে ব্যাটারিচালিত রিকশা এবং ইজি বাইকের জন্য। প্রয়োজনের তুলনায় অনেক বেশি থ্রি-হুইলার দেখা যায় গ্রামে ও মফস্বল শহরগুলোতে। ঈদ কিংবা বিশেষ দিনে এগুলো মালামাল ও যাত্রী নিয়ে বেপরোয়া গতিতে মহাসড়কে উঠে আসে এবং দুর্ঘটনার শিকার হয়।

এদের অত্যাচার থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য মহাসড়ক এমনকি মফস্বল শহরেও এগুলো বন্ধ করার জন্য প্রায়ই দাবি ওঠে। পুলিশ ও স্থানীয় প্রশাসনের পক্ষ থেকেও বিভিন্ন সময়ে বিশেষ করে ঈদ ও পূজার ছুটিতে এগুলো বন্ধ করার জন্য ঘোষণা দেওয়া হয়।

বর্তমানে সড়ক, মহাসড়ক এবং অলিতে-গলিতে কি পরিমাণ ব্যাটারি চালিত বাইক, রিকশা আছে তার কোনো সঠিক পরিসংখ্যান নেই। তবে বাংলাদেশ যাত্রীকল্যাণ সমিতির হিসাবে সারা বাংলাদেশে ৪০ লাখ ইজিবাইক ও ব্যাটারিচালিত রিকশা আছে। এর মধ্যে ঢাকা শহরে আছে ৭-৮ লাখ।

এসব যন্ত্রচালিত রিকশার কোনো নিবন্ধন দেয় না বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) কিংবা কোনো সিটি করপোরেশন। মূলত স্থানীয় রাজনৈতিক নেতা-কর্মী, পরিবহন শ্রমিক নেতা, সমিতি ও পুলিশ মিলে অর্থের বিনিময়ে এই ধরনের যানবাহন চলাচলের ব্যবস্থা করে।

কাজেই চলার পথে রাস্তায় কোনো সংঘর্ষ হলে চালক, যাত্রী, পুলিশ, শ্রমিক নেতা ও রাজনৈতিক কর্মীদের মধ্যে বাগ্বিত-তা, হাতাহাতি, মারামারি অবশেষে সড়ক অবরোধ। এর সমস্ত প্রভাব পড়ে কাঁচামাল পরিবহনে তথা অর্থনীতিতে।

এখানেই শেষ নয়, ব্যাটারিচালিত রিক্সা ও ইজিবাইককে কেন্দ্র করে সারাদেশে একটি চাঁদাবাজ চক্রও গড়ে উঠেছে। শুধু ঢাকার মিরপুর এলাকায়ই মাসে দেড় কোটি টাকা চাঁদা সংগ্রহ হয়। প্রতিটি ব্যাটারিচালিত রিকশায় মাসে দুই হাজার টাকা চাঁদা দিতে হয়। সেই হিসাবে দেশের ৪০ লাখ রিকশা থেকে মাসে ৮০০ কোটি টাকা চাঁদা ওঠে।

উল্লেখ্য, এ ধরনের একটি রিকশা তৈরি করতে ৭০ হাজার থেকে ১ লাখ টাকা খরচ হয়। মালিকপক্ষ প্রতিটি রিকশার জন্য দৈনিক ৮ ঘণ্টা হারে ৩০০ টাকা ভাড়া পান। প্রতিটি রিকশা চার্জ দিতে দৈনিক প্রায় দেড় হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ খরচ হয়। সাধারণত একটি রিকশার জন্য চার থেকে পাঁচটি ১২ ভোল্টের ব্যাটারি প্রয়োজন।

প্রতিসেট ব্যাটারি চার্জের জন্য গড়ে ৮০০ থেকে ১১০০ ওয়াট হিসেবে ৫ থেকে ৬ ইউনিট (দিনে বা রাতে কমপক্ষে ৫ থেকে ৬ ঘণ্টা) বিদ্যুৎ খরচ হয়। প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের দাম ৭ টাকা ধরে ৪০ লাখ ব্যাটারিচালিত রিকশায় প্রতিদিন সাড়ে ১২ কোটি টাকার বেশি বিদ্যুৎ খরচ হয়। তাই বিদ্যুতের সঠিক ব্যবহার এবং সে অনুপাতে রাজস্ব আদায়ে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে।

বর্তমানে নানা মডেলের ব্যাটারিচালিত রিকশা দেখা যায়। এর মধ্যে পায়ে চালানো পুরনো মডেলের (সরু টায়ার) রিকশায় ব্যাটারি লাগিয়ে পা দুটো উঁচু করে যেভাবে সজরে চলতে থাকে, তা দেখে যে কারও ভয় লাগার কথা। এগুলোই বেশি দুর্ঘটনায় পতিত হয়। অন্য মডেলগুলো লোহার শিটের তৈরি এবং অনেকটা ছোট মোটা চাকার তৈরি এবং কিছুটা নিরাপদ।

আবার মফস্বল শহরগুলোর মডেলটি একেবারেই অন্যরকম। এগুলোর ছাদ ঢাকা, সামনে পেছনে সিট এবং একটু বড়। যাই হোক, এদের বেপরোয়া চলাচলের কারণে সড়ক দুর্ঘটনা ক্রমেই বেড়ে চলেছে। সেই প্রেক্ষিতে সম্প্রতি সড়ক পরিবহনমন্ত্রী ব্যাটারিচালিত রিকশার বন্ধের ঘোষণা দিয়েছিলেন। ফলে, গত ১৯ মে ঢাকার মিরপুর, বাড্ডা, গুলিস্তান, নিউমার্কেটসহ বিভিন্ন স্থানে ঘটেছে অনেক অপ্রীতিকর ঘটনা, যা মিডিয়া ও পত্রিকাতে দেশবাসী দেখেছে।

কিন্তু ৪০ লাখ এই বাহনের সঙ্গে জড়িয়ে আছে কয়েক কোটি লোকের রুটিরুজির প্রশ্ন। তাই মাতৃতুল্য প্রধানমন্ত্রী স্বল্প আয়ের মানুষের কষ্টের কথা বিবেচনা করে শুধু ঢাকা শহরে ব্যাটারিচালিত রিকশা চলাচলের অনুমতি দিয়েছেন। তবে কোনোভাবেই যেন নির্দিষ্ট এলাকা ও শহরের বাইরে কিংবা মহাসড়কে এই বহন চলাচল না করে সেদিকেও নির্দেশনা দিয়েছেন।

প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশের পরিবেশের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ এবং দুর্ঘটনা সহনশীল একটি ইউনিক মডেল তৈরি করার বিষয়েও নির্দেশ দিয়েছেন। সত্যিই একটি টেকসই, দৃষ্টিনন্দন, পরিবেশবান্ধব এবং সাশ্রয়ী মূল্যের ব্যাটারিচালিত রিকশার মডেল তৈরি হলে তা শুধু বাংলাদেশেই নয়, পার্শ্ববর্তী কয়েকটি দেশ, এমনকি ইউরোপ-আমেরিকাতেও বাজারজাত করার ব্যবস্থা করা যেতে পারে।

কারণ, ওই অঞ্চলের পর্যটকদের জন্য এ ধরনের রিকশা খুবই আকর্ষণীয় হবে। পাশাপাশি, মডেলটি সারাবিশ্বে বাংলাদেশের জিআই পণ্য হিসেবে পরিচিতি পাবে এবং বৈদেশিক মুদ্রা আয় করার নতুন পথ সৃষ্টি হবে। যা হোক, একটি বিধিবালার মাধ্যমে এটিকে নিয়ন্ত্রণ করার কথাও প্রধানমন্ত্রী বলেছেন। যেখানে তাদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা, চলাচলের জন্য নির্দিষ্ট এলাকা ভাগ করে দেওয়া এবং নির্দিষ্ট গতি ইত্যাদি নির্ধারণের কথা বলেছেন।

এসবের সঙ্গে গাড়িটির লাইসেন্স এবং প্রত্যেক চালকের একটি আইডি সরবরাহ করা যেতে পারে। ভবিষ্যৎ তহবিল হিসেবে চালকদের আয়ের একটি অংশ ওই আইডির বিপরীতে প্রশাসন নিয়ন্ত্রিত একটি অ্যাকাউন্টে জমা রাখার বিধান করা যেতে পারে। তবে ব্যাটারিচালিত রিকশাগুলো শুধু প্রতিবন্ধীরাই চালাবে, নাকি সুস্থ ব্যক্তিরাও চালাবে, তাও বিধিমালায় অন্তর্ভুক্ত থাকা উচিত বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করেন।

কারণ, সারা পৃথিবীই চলছে এখন প্রযুক্তির সহায়তায়। প্রযুক্তির সহায়তা নিতে চায় সবাই। কৃষকরা আগে লাঙ্গল দিয়ে হাল-চাষ করত। প্রযুক্তির উৎকর্ষতায় সেই কৃষক এখন অত্যাধুনিক যন্ত্রের সাহায্যে কম পরিশ্রমে জমি চাষ করে বেশি ফসল ফলায়। এক সময় ডায়াল ফোন (এনালগ) শুধুই ধনীর ঘরে শোভা পেত, কিন্তু আজ প্রযুক্তির উন্নতি এবং সহজলভ্যতার কারণে স্মার্টফোনও কৃষকের হাতে।

ফসলের বাজারদর জানতে পারে স্মার্টফোন দিয়ে। এভাবে সবার উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে রিকশায়ও এসেছে প্রযুক্তির ছোঁয়া। কায়িক পরিশ্রম না করে ব্যাটারিচালিত রিকশা চালিয়ে যদি বেশি আয় করা যায় এবং তাতে যদি সংসারটাও ভালো চলে, তাতে দোষের কি? তাই ব্যাটারিচালিত রিকশা নিষিদ্ধ নয়, নিয়ন্ত্রণ হোক সঠিকভাবে এবং জিআই পণ্য হিসেবে ছড়িয়ে পড়ুক বিশ্বব্যাপী।

রিকশাটির পেছনের অংশে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ এবং বাংলাদেশের পতাকা অঙ্কিত থাকলে মানুষ বাংলাদেশের ইতিহাস, মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে জানতে আরও আগ্রহী হবে।

লেখক : অধ্যাপক এবং তথ্যপ্রযুক্তিবিদ, আইআইটি, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়