প্রকাশ : ১৩ আগস্ট ২০২৫, ০৮:৩৯
হাইমচরের জান্নাতুল মাওয়ার গল্প

হাইমচর উপজেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলে জন্ম ও বেড়ে ওঠা জান্নাতুল মাওয়ার। কাজ করেন চাঁদপুরের বিখ্যাত রূপালী ইলিশ ও নদীর সুস্বাদু তাজা মাছ নিয়ে। খুব অল্প বয়সে বিয়ে হয়ে যাওয়া মাওয়া এখন ইলিশ রাণী নামেই বেশ পরিচিত। জীবন সংগ্রামে তিনি একজন সফল নারী উদ্যোক্তা। মাধ্যমিকের গণ্ডি না পেরোতেই দাদির আবদারে ষষ্ঠ শ্রেণীতে থাকা অবস্থায় ২০০০ সালে বিয়ে হয়ে যায় জান্নাতুল মাওয়ার। যে সময় মুক্তমনে ছুটে চলার কথা সে সময় থেকে শুরু হয় জীবন-সংগ্রাম। মা ভক্ত ছেলে মায়ের ইচ্ছা পূরণে নিজ মেয়েকে অল্প বয়সে বিয়ে দিয়ে অনুশোচনায় ভুগছিলেন মাওয়ার বাবাও। বিয়ের পর মাওয়ার দাম্পত্য জীবনে আস্তে আস্তে নেমে আসে সংগ্রামের ছাপ। বিয়ের পর পড়াশোনাবিহীন নিজের মধ্যে কিছু একটা অপূর্ণতা ভেবেই সাংসারিক কাজের ভিতরেও লেখাপড়া চালিয়ে যান এই নারী। প্রথম সন্তানের পাঁচ বছর বয়সকালে মাওয়া উপজেলার নীলকমল ওসমানীয়া উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পরীক্ষা দিয়ে উত্তীর্ণ হয়। পরে হাজীগঞ্জ সরকারি মডেল কলেজ থেকে এইচএসসি শেষ করেন। বর্তমানে বিএ ফাইনাল ইয়ারে অধ্যয়নরত সংগ্রামী এই নারী নিজের অবসর সময়কে কাজে লাগাতে ঘরে বসেই শিখেন হাতের কাজ। এর মধ্যে ২০২১ সালে বাবার হঠাৎ মৃত্যুতে সম্পূর্ণ সাহস হারিয়ে ফেলেন তিনি। নিজের ইচ্ছাশক্তিকে কাজে লাগিয়ে আজকের নারীরা এগিয়ে যাচ্ছে বহুদূর। সেই কথা ভেবেই একজন সফল গৃহিণীর পরিচয়ের পাশাপাশি একজন সফল উদ্যোক্তার পরিচয় গড়ে তুলেছে নিজের নামের পাশে মাওয়া।
|আরো খবর
প্রবাসী স্বামীর একেবারে দেশে চলে আসার খবরে পুরোপুরি ভেঙ্গে পড়েন মাওয়া। সংসার খরচ আর সন্তানদের ভরণপোষণের কথা চিন্তা করে “নিজের বলার মতো একটি গল্প” নামে একটি ফাউন্ডেশন থেকে উদ্যোক্তা হওয়ার প্রশিক্ষণ নিয়ে শুরু করেন অনলাইন ব্যবসা। স্বামীর অর্থনৈতিক দুরবস্থা আর সামাজিক কুসংস্কারের কারণে মাওয়ার ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও তিনি বাড়ির বাইরে গিয়ে কাজের সন্ধান করতে পারতেন না। তাই সংসার, স্বামী-সন্তান ঠিক রেখে নিজের পরিচয়ে বাঁচার লক্ষ্যে পুরোপুরি কাজ শুরু করেন চাঁদপুরের বিখ্যাত রূপালী ইলিশ ও নদীর সুস্বাদু তাজা মাছ নিয়ে। নিজের চেষ্টা আর মেয়ে সাবিকুন নাহারের সহযোগিতায় এগিয়ে যেতে থাকেন হার না মানা জীবনযোদ্ধা এই নারী উদ্যোক্তা। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে “Ilish Rani ইলিশ রাণী” নামে রয়েছে তার একটি ফ্যান পেজ। দেশের গণ্ডি পেরিয়ে বিদেশ থেকেও এই পেজে অর্ডার আসতে থাকে বিভিন্ন প্রজাতির মাছের। ক্রেতাদের চাহিদা মেটাতে গিয়ে অনেক সময় অনেক কষ্ট করতে হয়েছে তাকে। তার এই কষ্ট বিফলে না গিয়ে আর্থিক ও সামাজিকভাবে সফল হয়েছেন তিনি। কুড়িয়েছেন বিভিন্ন সম্মাননা। তার এই সাফল্যে গর্বিত পরিবারসহ এলাকাবাসী।
হাজীগঞ্জ ই-কমার্সের সহযোগিতায় উঠে আসা মাওয়া বলেন, শুধুমাত্র একজন সফল গৃহিণী ও মা হিসেবে নয় পাশাপাশি নিজেকে দেখতে চেয়েছি একজন সফল উদ্যোক্তা হিসেবে। খুব অল্প বয়সেই বিয়ে হয়ে যায় আমার। সেই সঙ্গে খুব তাড়াতাড়িই প্রথম বেবি কনসিভ করি। অল্প বয়সেই সংসারের সব কিছু গুছিয়ে নিয়েছিলাম খুব সহজেই। কিন্তু ঘর সামলানোর পাশাপাশি নিজেকে স্বাবলম্বী করে তুলতে চেয়েছিলাম সবসময়। যেহেতু ঘর আর ছোট বাচ্চা সামলানোর পাশাপাশি বাহিরে গিয়ে কিছু করা আমার পক্ষে তেমন সম্ভব হচ্ছিলো না তাই চিন্তা করি ঘরে বসেই কিছু করার। আমার কাজের প্রথমদিকে অনেকে বিষয়টি ভালো চোখে দেখতেন না কিন্তু আজ সবাই আনন্দিত। আমি আমার মরহুম বাবাসহ পুরো পরিবারের কাছে কৃতজ্ঞ। এছাড়া যারা আমাকে আমার উদ্যোক্তা লাইফে বিভিন্ন পরামর্শ কিংবা সার্বিক সহযোগিতা করেছেন তাদের ঋণ কখনোই ভোলার মতো নয়।
প্রবাস-ফেরৎ স্বামীর উপর সংসারের সম্পূর্ণ চাপ না দেয়া জান্নাতুল মাওয়া আরো বলেন, যেহেতু ছোট বেলায় বিয়ে হয়, আর থাকতে হতো শ্বশুর বাড়ি। সংসারের কাজের পাশাপাশি হাতের কাজগুলো শিখি আর তখন থেকেই শুরু করে দেই নিজে কাজ শেখা ও অন্যদের শেখানো এবং ধীরে ধীরে এটা ভালো লাগার জায়গা হয়ে যায়। একটা সময় এসে মনে হলো সংসার ও সন্তানদের রেখে তো আমার স্বপ্নপূরণ করা সম্ভব হবে না। কিংবা পাবো না কোন চাকরি। আমার হাসব্যান্ড পরিবারের বড় ছেলের দায়িত্ব পালন করতে গিয়েই প্রবাসজীবন পার করলো। তাই চেষ্টা করে যাচ্ছি আমার ক্রেতাদের সঠিক সেবা দিতে, লোকাল এরিয়ার প্রত্যেকটা ঘাটে গিয়ে ক্রেতাদের চাহিদা অনুযায়ী মাছ সংগ্রহ করে পৌঁছানোর জন্য। সেজন্য মাওয়ার ০১৬০৬-৬৭৭৬৯৬ এই নম্বরেও ক্রেতারা যোগাযোগ করতে পারবেন বলে জানান তিনি।