সোমবার, ২৩ জুন, ২০২৫  |   ৩২ °সে
জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয় অন্যান্য

প্রকাশ : ২৩ জুন ২০২৫, ০৯:৪৮

‘কবর’ কবিতার একশো বছর

হাসান আলী
‘কবর’ কবিতার একশো বছর

প্রায় পঞ্চাশ বছর আগে কিশোর বয়সে পল্লীকবি জসিমউদদীনের ‘কবর’ কবিতা পড়ার সুযোগ পেয়েছিলাম। এতো শোক, এতো ব্যথা মানুষ কেমন করে সহ্য করে তা ভেবে ব্যাকুল হয়ে পড়েছিলাম। মনের অজান্তে দু ফোঁটা চোখের পানি দিয়ে ‘কবর’ কবিতার দাদুর প্রতি সমব্যথী হয়েছিলাম। এমন হৃদয়স্পর্শী সাড়া জাগানো কবিতা বাংলা সাহিত্যের অমূল্য সম্পদ। তাই শতবর্ষে এসেও কবিতাটির আবেদন ফুরিয়ে যায়নি। সাহিত্য সমালোচকরা ‘কবর’ কবিতার গুণগত মান, প্রকাশভঙ্গি, উপমা, আধুনিকতা ইত্যাদি নিয়ে মতামত দেবেন।

সেই মতামত নিয়ে মতভেদ থাকবে সেটাই স্বাভাবিক, কিন্তু তাতে ‘কবর’ কবিতার প্রাসঙ্গিকতা হারাবে না।সাধারণ মানুষ অন্তর দিয়ে এই কবিতা পড়ে এবং মন দিয়ে শোনে।

কবি বৃদ্ধ দাদুকে শোকাতুর, শক্তিমান, দায়িত্বশীল, দরদী, স্নেহশীল এবং প্রেমিক হিসেবে উপস্থাপন করেছেন। সেকালের প্রথা অনুযায়ী শিশুকে বিয়ে করে তার সাথে যাপিত জীবনকে সরসভাবে তুলে ধরেছেন। স্ত্রীর জন্যে ভালোবাসা ছিলো ঈর্ষণীয়। সে সময় তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে স্ত্রীকে পেটানো হতো। মেয়েরা শ্বশুর বাড়িতে শ্বশুর-শাশুড়ি, দেবর- ননদের হাতে শারীরিকভাবে নির্যাতন নিপীড়নের শিকার হতো। শ্বশুর বাড়িতে অকথ্য নির্যাতনে অকালে প্রাণ হারাবার বহু ঘটনা আমরা শুনেছি। একশো বছর আগে নারীর ওপর যে ধরনের নির্যাতন হতো তার খানিকটা পরিবর্তন হয়েছে। এখনো নারীর ওপর নির্যাতন হয়, তবে প্রতিবাদ-প্রতিরোধ চলমান রয়েছে। দাদু তাঁর স্ত্রীকে মনেপ্রাণে ভালোবাসতেন সেটা যেমন বর্ণনায় পাওয়া যায়, তেমনি যাপিত জীবনের দিকে তাকালে বিশদ উপলব্ধি করা যায়। স্ত্রী মারা যাবার সময় দাদুর বয়স অনেক কম ছিলো। ছোট ছেলে মেয়েকে দেখাশোনা, সেবা-যত্ন করার জন্যে আরেকটি বিয়ে করতে পারতেন। সৎ মায়ের কাছে ছেলেমেয়ের দায়িত্ব দিতে রাজি হন নি। সন্তান বুকে আগলে জীবন কাটিয়ে দিতে চেয়েছেন। স্ত্রীর শোকে এতোটা কাতর হয়ে পড়েছিলেন যে, অন্য কাউকে স্ত্রীর আসনে বসাতে রাজি হননি।

ছেলের হঠাৎ মৃত্যু দাদুকে হতবিহ্বল করে দিলো।ছেলেকে হারিয়ে শোকের সাগরে ভাসতে থাকলেন। এমন সময় পুত্রবধূ মৃত স্বামীর শোকে কাতর হয়ে মৃত্যুবরণ করলেন। একটার পর একটা মৃত্যু দাদুকে অস্থির করে তুললো। সাত বছরের মেয়ের সাপের কামড়ে মৃত্যু হলে দাদু সীমাহীন দুঃখের সাগরে পতিত হলেন। নাতনিকে বিয়ে দিয়েছিলেন, কিন্তু শ্বশুর বাড়ির লোকজনের মানসিক নির্যাতনে দিশেহারা হয়ে উঠেছিলো। নাতনি দাদুর বাড়িতে এসে বাবা-মার কবরের পাশে দিনরাত কেঁদে কেটে পার করে অসুস্থ হয়ে মৃত্যুবরণ করলো।

একই পরিবারের পাঁচটি অকাল মৃত্যু দাদুর জীবনে ভয়াবহ শোকের মাতম তৈরি করলো। পরিবারে বেঁচে থাকা দাদু আর নাতিকে এই সীমাহীন দুঃখের বোঝা বইতে হচ্ছে।

একশো বছর পর স্বাস্থ্য খাতের ব্যাপক উন্নতি হয়েছে, ফলে অকাল মৃত্যুর হার কমে গড় আয়ু বেড়ে গেছে। এখনও শিশুর মৃত্যু হয় যুদ্ধ বিগ্রহ, মহামারী, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, মানবসৃষ্ট গোলযোগ, সড়ক দুর্ঘটনা আর পানিতে ডুবে। প্রবীণরা চোখের সামনে সন্তানের অকাল মৃত্যুর দৃশ্য সহ্য করতে না পেরে দিশেহারা হয়ে যান। বিপত্নীক প্রবীণ স্ত্রী শোকে কাতর এবং নিঃসঙ্গ। দাদু যাকে আঁকড়ে ধরেছেন সেই তাকে ছেড়ে চলে গেছে। দাদুর কণ্ঠে, তারপর এই শূন্য জীবনে যত কাটিয়াছি পাড়ি/যেখানে যাহারে জড়ায়ে ধরেছি সেই গেছে ছাড়ি। কবর কবিতায় বোঝা যায় দাদু নিঃসঙ্গ প্রবীণ। নাতি কাছে থাকে না দীর্ঘ সময় ধরে। নাতিকে কাছে পেয়ে দাদু আবেগতাড়িত হয়ে পরিবারের মৃত সদস্যদের কবর এবং মৃত্যুর কারণ বর্ননা করছেন।

‘কবর’ কবিতায় স্বজন হারানো দাদুর শোকের মাতম সাধারণ মানুষের মন ছুঁয়ে গেছে। দাদু নাতিকে নিয়ে জীবন সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছেন। মৃতদের বেহেশতে দেখার জন্যে সৃষ্টিকর্তার নিকট ফরিয়াদ জানিয়েছেন। দাদু নিজের জীবন নিয়ে চিন্তিত নন, ব্যথিত।

বর্তমানে যারা দাদু হবেন বা হয়েছেন তাদেরকে প্রবীণ জীবন নিয়ে ভাবতে হবে, পরিকল্পনা করতে হবে। নিয়তির ওপর ছেড়ে দিয়ে বিলাপ করলে কোনো লাভ হবে না।

দাদু স্ত্রীর শোকে তিরিশ বছর কাটিয়ে দিয়েছেন। এই কথা শুনে দাদুর প্রতি সহানুভূতি জাগতে পারে, কিন্তু এটা জীবনবিমুখ ভাবনা। শোকের মাতম নিয়ে জীবন কাটিয়ে দেয়া কোনো সঠিক সিদ্ধান্ত হতে পারে না। একবিংশ শতাব্দীতে শোকের দীর্ঘায়ু মানুষের জীবন উপভোগের ক্ষেত্রে বড়ো বিড়ম্বনা ছাড়া আর কী হতে পারে? মানুষ বর্তমানকে অতীত করে সামনে এগিয়ে যায়।ভবিষ্যৎকে নিরাপদ শান্তিপূর্ণ, স্বস্তিদায়ক করতে বর্তমানকে কাজে লাগায়।

‘কবর’ কবিতার অকাল মৃত্যুবরণকারী পাঁচজনকে বর্তমানের আধুনিক চিকিৎসার মাধ্যমে বাঁচিয়ে তোলা সম্ভব। চিকিৎসা বিজ্ঞানের কল্যাণে মানুষের গড় আয়ু বাড়ছে। যাপিত জীবন দীর্ঘ হবার ফলে নতুন নতুন চ্যালেঞ্জ মানুষের সামনে হাজির হচ্ছে। সেই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে নানান ধরনের কর্মকৌশল গ্রহণ করতে হচ্ছে। ‘কবর’ কবিতা একশো বছর আগের মানুষের জীবনযাপন, দুঃখ-কষ্ট, ব্যথা-বেদনার প্রামাণ্য দলিল। বর্তমানের কাজ হবে সেসব দুঃখ-কষ্টের অবসান ঘটিয়ে তাৎপর্যপূর্ণ নতুন আনন্দদায়ক দিনগুলোকে সামনে নিয়ে আসা। ‘কবর’ কবিতার ব্যথা-বেদনা মানুষকে শান্তিপূর্ণ আনন্দদায়ক জীবনযাপনের প্রতি আগ্রহী করবে। মানুষ নিজে অশান্তি সৃষ্টি করবে না এবং অন্যরা অশান্তি সৃষ্টি করতে চাইলে তা রুখে দিবে। পৃথিবীতে যাপিত জীবন আনন্দের হবে এই প্রেরণা মানুষের মধ্যে জেগে উঠবে।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়