প্রকাশ : ০২ জুন ২০২৫, ০৮:৪৩
হৃদয়বতী

এক.
নীল পাঞ্জাবি পরা একজন সবার সামনে। তার পেছনে একদল লোক। তাদের মাথাসহ মুখ লাল গামছায় বাঁধা। কারও হাতে রামদা, কারও হাতে বাঁশের লাঠি। ‘অ্যাকশন অ্যাকশন, ডাইরেক্ট অ্যাকশন’ শ্লোগান দিয়ে পাঞ্জাবি পরা লোকটির নেতৃত্বে এগিয়ে যাচ্ছে তারা। আতঙ্কে এদিক-সেদিক ছোটাছুটি করছে সাধারণ মানুষ।
হ্যান্ড মাইকে নীল পাঞ্জাবি পরা লোকটি ঘোষণা দিলো, ‘খাজনা। এই এলাকায় আমরাই এখন খাজনা তুলবো। কেউ খাজনা না দিয়ে যেতে পারবে না।’
রামদা হাতে সঙ্গীয় লোকজন হৈচৈ করে উঠলো। দূরে রিকশায় বসা এক প্রৌঢ় লোক। বয়স তার ৫০ হবে। দাড়ি-গোঁফ এখনও তেমন একটা পাকেনি। বলিষ্ঠ দেহ। যেনো লোহায় পেটানো তার শরীর। রিকশায় তার পাশে বসা একটি সুন্দরী মেয়ে। তার কন্যা। নাম তাসফিয়া। তাসফিয়া ভার্সিটিতে পড়ে। তাই বাবার সাথে রিকশায় উঠেছে, সে ভার্সিটিতে নেমে যাবে, আর তার বাবা নাদের সাহেব যাবেন তার কাজে।
হৈচৈকারীরা তার কাছে এসে তাকে রিকশা থেকে ধাক্কা মেরে বললো, ‘এই ব্যাটাা, এখান থাইক্কা ভাগ। নাইলে এই রাম দা দিয়া তোর শরীরটা দুই ভাগ কইরা দিমু।’
নাদের সাহেব উত্তর দিলো, ‘হ, বাবা। স্বাধীনতার পর একদল দেশটারে লুটপাট কইরা খাইছে, আর তাদেরকে দৌড়াইয়া এখন তোমরা আইছ। তবে, জেনে রেখো, জুলুম বেশিদিন স্থায়ী হয় না। সীমা অতিক্রম করলে অচিরেই জুলুমের শাস্তি মানুষকে ভোগ করতে হয়।’
নীল পাঞ্জাবি পরা লোকটা আবারও হ্যান্ড মাইকে ঘোষণা দিলো, ‘আমরা এতোদিন জেলে ছিলাম, পলাতক ছিলাম, আমাগো ওপর অনেক জলুম নির্যাতন হইছে, এখন এই এলাকায় আমরা খাজনা উঠামু, কেউ না দিলে তারে দুইভাগ কইরা ফালামু।’
আবারও শ্লোগান উঠলো, ‘অ্যাকশন অ্যাকশন, ডাইরেক্ট অ্যাকশন’, আজাদ ভাই ভালো লোক, জয়ের মালা তারই হোক।’
নাদের সাহেব এবার বুঝতে পারলেন, হ্যান্ড মাইকে ঘোষণাকারী লোকটির নাম আজাদ ভাই। আজাদ ভাই আজ আইছে লোকজনের কাছ থাইকা খাজনা নিতে। তবে, এই খাজনা সরকারি খাজনা নয়। এটা হচ্ছে চাঁন্দা। এভাবেই স্বাধীনতার পর থেকে চলছে দেশটা, একদল যায়, আরেক দল আসে। যেই লাউ হেই কদু।
লোকগুলো এলাকায় ত্রাস সৃষ্টি করছে তার লোকজনের কাছ থেকে চাঁন্দা তুলছে। যারা দিতে পারছে না তাদেরকে বেধড়ক পেটাচ্ছে।
নাদের সাহেব ভাবতে লাগলেন। তার অদ্ভুত জীবন-কাহিনী নিয়ে পত্রিকার পাতায় দেখতে পেয়েছিলেন। স্বাধীনতার পর একদিন এক সাংবাদিক সংবাদ সংগ্রহের জন্যে যায় তার এলাকায়। তার নাম তুষার আহমেদ। সে বাংলার বাণীর স্টাফ রিপোর্টার। খবরের সন্ধানে এলাকার ফারুক নামের এক লোককে জিজ্ঞাসা করে, ‘মালিটোলার নাদেরের নাম শুনেছেন?’
প্রশ্নটি শুনে প্রথমে খানিকটা ভ্রু কুঁচকান পুরান ঢাকার হোসেনী দালান এলাকার বাসিন্দা ফারুক হোসেন। তারপর বলেন, ‘নাদেইরা গুণ্ডা? হেরে তো গণ্ডগোলের সময় পাক মিলিটারি মাইরা ফালাইতে নিছিল! তারপর বুড়িগঙ্গায় ফালাইয়া দিছিল। হেরপরও হুনছি বাঁইচা আছিল। বুকের পাটা আছিল একখান। তবে কখনো সামনাসামনি দেহি নাই।’
উর্দু রোডের প্রবীণ বাসিন্দা মোহাম্মদ আফজালকেও একই প্রশ্ন করা হলে জবাব আসে, ‘নাদেরের নাম শুনলেই মানুষে ডরাইতো। এ কি আইজকাইলের রংবাজ নিকি। পুরানা দিনের রংবাজগো দাপট আছিলো।’
ফারুক, আফজালের কথার সারমর্ম হলো পুরাণ ঢাকার বাসিন্দারা নাদের নামটির সঙ্গে পরিচিত। তাদের মতো পুরাণ ঢাকার অনেক স্থায়ী বাসিন্দাই নাদেরকে কখনো না দেখলেও মালিটোলার নাদের গুণ্ডার
কথা শুনেছেন।
অল্প হলেও নাদেরের বীরত্বগাথার সঙ্গে পরিচিত ক্র্যাক প্লাটুনের মুক্তিযোদ্ধা আলী আহমদ জিয়াউদ্দিন বীর প্রতীক। তিনি সাংবাদিক তুষারকে বলেন, ‘ক্র্যাকডাউনের কিছুদিন পর, এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে আমরা যুদ্ধের ট্রেনিং নিতে ভারতে যাই। পরে এসে যুদ্ধে যোগ দিই। কিন্তু নাদেররা একদম প্রথমেই প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলেন। ২৫-২৬ তারিখে মূলত ঢাকায় তিন জায়গায় সিভিলিয়ানরা প্রতিরোধ তৈরি করেছিল। এর মধ্যে ইংলিশ রোডে নাদের ও তার সঙ্গীরা অন্যতম।’
জিয়াউদ্দিনের ভাষ্য অনুসারে অন্য দুই প্রতিরোধের জায়গা ছিলো ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের পাশের এলাকা ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক হলের (ইকবাল হল) পেছনের বস্তি। তবে আগের দুজনের মতো জিয়াউদ্দিন বীরপ্রতীকও নাদেরকে কখনো সামনাসামনি দেখেননি।
মালিটোলার নাদেরকে মুক্তিযুদ্ধ পুরোপুরি বদলে দিয়েছিল। যুদ্ধের আগে স্রেফ গুণ্ডা বা রংবাজ হিসেবেই তাকে চিনতো সবাই। এই নাদেরই যুদ্ধের সময় পাকিস্তানি বাহিনীর কাছে হয়ে উঠেন এক সাক্ষাৎ ত্রাসের নাম।
স্বাধীনতা যুদ্ধে নাদেরের অসীম বীরত্বের কথা খুব কম মানুষই জানেন। পুরাণ ঢাকার প্রবীণ বাসিন্দারা এই নামটি মনে করতে পারলেও মুক্তিযুদ্ধে তার প্রতিরোধের ঘটনাগুলো তেমন মনে নেই তাদের। তাই এই মুক্তিযোদ্ধার বীরত্ব ও সাহসিকতা অনেকেই জানেন না।
অবাক হয় সাংবাদিক তুষার আহমেদ। প্রশ্নগুলো মনে মনে ঘুরপাক খায়। তারপর সে বেরিয়ে পড়ে ঘটনার অনুসন্ধানে। তার পরিবারকে খুঁজে বের করে নাদেরের উত্থান, স্বাধীনতা যুদ্ধে যোগদান ও পাক বাহিনীর হাতে ধরা পড়ার ঘটনা জানতে দুই সপ্তাহ ধরে অনুসন্ধান চালায় সে। অনুসন্ধানে পাওয়া যায়, অতি সাধারণ পরিবার থেকে উঠে আসা এক সাহসী তরুণের গল্প। বীরত্বগাথার এক অনন্য ইতিহাস।
ঢাকার কয়েকটি মহল্লার প্রবীণ বাসিন্দা ও মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে কথা বলে সে জানতে পারে, ২৫ মার্চ রাতে শুরু হওয়া পাক-বাহিনীর গণহত্যার মুখে অনেক বাঙালি শহর ছেড়ে পালাতে শুরু করে। কিন্তু নাদের ছিলেন ব্যতিক্রম। কালরাতের প্রথম প্রহরেই পরিস্থিতি আঁচ করতে পারেন তিনি। কয়েকজন সঙ্গীকে নিয়ে রিভলভার আর দোনলা বন্দুক হাতে বংশালের ঈশা ব্রাদার্স ভবনের ছাদে অবস্থান নেন তিনি। করেন পাক-বাহিনীকে অতর্কিত আক্রমণের পরিকল্পনাও।
রাত ১২টার পর পাক সেনারা রায়সাহেব বাজার মোড়ের মসজিদ-সংলগ্ন বস্তিগুলোতে আগুন লাগানো শুরু করে। এরপর তারা আগুন দেয় নয়াবাজারের কাঠের মিলগুলোতে।
আগুন দেওয়া শেষ করে সেনাদের জীপ যখন ঈশা ব্রাদার্স ভবনের সামনে আসে, তখনই গর্জে উঠে নাদের ও তার সঙ্গীদের অস্ত্র। এমন আক্রমণের জন্যে প্রস্তুত ছিল পাক-সেনারা। বেশ ক’জন সেনা কর্মকর্তা নিহত হয়।
এরপর সামলে উঠে যখন তারা পাল্টা আক্রমণ শুরু করে, ততক্ষণে পালিয়ে যান নাদের ও তার সঙ্গীরা।
নাদেরদের ধরতে না পারলেও সে রাতে মালিটোলা-বংশালসহ পার্শ্ববর্তী তাঁতীবাজার, শাখারিবাজার, জিন্দাবাহার লেন, আরমানিটোলা, টিপু সুলতান রোডের মতো অনেক মহল্লায় ঢুকে গণহত্যা চালায় পাক-বাহিনী।
২৬ মার্চ সকালে নাদের তার পরিবারকে নিরাপদ আশ্রয়ে সরিয়ে নিতে মানিকগঞ্জে রেখে আসেন। এ সময় নাদেরের স্ত্রী মেরীর চোখে ছিলো অশ্রুবিন্দু। সে নাদেরকে প্রথমে যুদ্ধে যাবার বিষয়ে বারণ করেছিলো। কিন্তু নাদের নাছোড়বান্দা। তার বুকের পাটা বেশ বড়ো। সে বললো, ‘মনে করো তুমি তোমার মাকে ক্ষত-বিক্ষত হতে দেখছো, এ অবস্থায় তুমি কী করবে?’
কথাগুলো শুনে মেরী বাকরুদ্ধ, চোখের অশ্রুবিন্দুগুলো মুছলো। তারপর বললো, ‘যাও, বেরিয়ে পড়ো। বাংলা মাকে রক্ষা করার জন্যে প্রয়োজন হলে জীবনটাও বিলিয়ে দাও। পিশাচ-কুত্তাগুলোকে বাংলার ফুলের বাগান থেকে বিতাড়িত করো। যাও। আমি আর কাঁদবো না। যেদিন তুমি আসবে, ঠিক সেদিন আমার কান্নাগুলো সোনালি সূর্যের আলোয় মুক্তোর মতো ঝিকমিক করবে।’
স্ত্রীর কথায় আশ্বস্ত হয় নাদের। তারপর ২৫ মার্চ রাতের গণহত্যার পর নাদের তার পরিবারকে মানিকগঞ্জে রেখেই আবার মহল্লায় ফিরে আসে। ও আসার পর আমরা নদীর ওপারে কেরানীগঞ্জ চলে যাই, বলেন মালিটোলার প্রবীণ বাসিন্দা বারেক হাজী।
এরপর শুরু হয় নাদেরদের গেরিলা আক্রমণ। আজ আরমানিটোলা তো কাল সিদ্দিক বাজার, সকালে আলাউদ্দিন রোড তো বিকেলে নারিন্দা, ধোলাইখাল; পরক্ষণেই আবার শ্যামবাজার, বাংলাবাজার, ইংলিশ রোড, টিপু সুলতান রোড, নবাবপুর, জোরপুল, হাটখোলা; পুরান ঢাকার বিভিন্ন অলি-গলিতে আচমকা হাজির হতেন নাদের ও তার সঙ্গীরা। মুহূর্তের মধ্যে করতেন অ্যামবুশের পরিকল্পনা। পরক্ষণেই অতর্কিত আক্রমণ। নাদেরদের একের পর এক গেরিলা হামলার মুখে দিশেহারা হয়ে পড়েছিল পাক-বাহিনী।
নাদেরের সহযোদ্ধাদের মধ্যে চেঙ্গিস ছাড়া এখন আর কেউ বেঁচে নেই।
বুকের পাটা নিয়ে এখনও নাদের বেঁচে আছে আল্লাহর দয়ায়। তবে তাদের মুখ থেকে নাদেরের বীরত্বের গল্প শুনেছেন অনেক। তাঁতীবাজারের বাসাবাড়ি লেনের আবদুল মজিদ তাদের একজন।
তুষারকে তিনি বলেন, ‘তখন মোটা অঙ্কের অর্থের বিনিময়ে নাদেরদের অস্ত্র সরবরাহ করতেন সংগ্রাম নামের এক বিহারী। প্রথমদিকে নিজেদের টাকা দিয়েই অস্ত্র কিনতেন নাদের। একসময় তা ফুরিয়ে এলে অস্ত্রের অর্থ সংস্থানের জন্যে বিভিন্ন মহল্লায় গিয়ে চাঁদা তুলতে শুরু করেন নাদের।’
ওদিকে পাকিস্তানি বাহিনীও বসে ছিলো না। নাদেরদের ধরতে মালিটোলা ও পাশের এলাকায় একাধিক অভিযান চালায় তারা। কিন্তু তবুও নাদেরদের কোনো সন্ধান না মেলায় পাক সেনারা তাদের সহচরদের মোটা অঙ্কের পুরস্কারের লোভ দেখায়।
এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি সময়ে ঢাকার বিভিন্ন মহল্লায় শান্তি কমিটি গঠন করা হলে নিরাপত্তার খাতিরে নাদেরদের চলাচল কিছুটা সঙ্কুচিত হয়ে যায়।
পুরাণ ঢাকার একাধিক প্রবীণ তুষারকে জানান, মে মাসের শেষদিকে আরমানিটোলায় একটি সভা আয়োজনের সিদ্ধান্ত নেয় সেখানকার শান্তি কমিটি। সভায় ঢাকার শান্তি কমিটির আহ্বায়ক খাজা খয়েরউদ্দিন উপস্থিত থাকবেন বলে বিভিন্ন এলাকায় প্রচারণা চালানো হয়।
নাদের ও তার সঙ্গীরা সিদ্ধান্ত নেন, সভায় আক্রমণ চালিয়ে খয়েরউদ্দিনকে হত্যা করবেন। এই পরিকল্পনার অংশ হিসেবে সংগ্রামের কাছ থেকে ভারী অস্ত্র কিনেন নাদের।
নির্ধারিত দিনে নির্দিষ্ট সময়ে আর্মেনিয়ান গির্জার পাশে অবস্থান নেন নাদেররা। কিন্তু তাদের সেই পরিকল্পনার কথা আগেই পাক বাহিনীকে জানিয়ে দেয় সংগ্রাম ও মালিটোলার ‘গ্যাদা গুণ্ডা’। নাদেরদের ধরতে পাক সেনারা জিপের বদলে সাধারণ মাইক্রোবাসে চড়ে আরমানিটোলায় আসে। মুক্তিযোদ্ধারা টের পাওয়ার আগেই সাদা পোশাকের পাক সেনারা তাদের তিন দিক থেকে ঘিরে ফেলে আক্রমণ চালায়। ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলেন সংগ্রামও। তার বিশ্বাসঘাতকতা আন্দাজ করে প্রথমে তাকেই গুলি করেন নাদের। গুলি খেয়ে কুকুরের মতো ঘেউ ঘেউ করে আওয়াজ তোলে সংগ্রাম, তারপর লুটিয়ে পড়ে মাটিতে।
এরপর পাক সেনাদের উদ্দেশ্যে পাল্টা গুলি চালান নাদের বাহিনী। কিন্তু ততক্ষণে চারদিক থেকে নাদেরদের ঘেরাও করে ফেলে পাক সেনারা। তবুও পিছু হটার চিন্তা না করে গুলি চালিয়ে যান নাদের। একপর্যায়ে নাদেরের সহোদর হারুনের বুকে গুলি লাগে। হারুন লুটিয়ে পড়ার পর অনুসারীদের নিয়ে গুলি করতে করতে পিছু হটার সিদ্ধান্ত নেন নাদের। পিছু হটার সময় গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান আরেক মুক্তিযোদ্ধা সোহরাব।
এ সময় হঠাৎ করে একটি গুলি এসে লাগে নাদেরের পায়ে। তবে ততক্ষণে তার অন্য সঙ্গীরা নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যেতে সক্ষম হন।
নাদেরের চাচাতো ভাই মুন্না মিয়া তুষারকে বলেন, ‘ডান পায়ে গুলি খাওয়ার পরে নাদের কেলাইয়া কেলাইয়া শাবিস্তান হলের ভেতরে গেছে। এরপর দেয়াল টপকাইয়া পাশের বাঘওয়ালা বাড়িতে যাইয়া পলায়। হারুনের লাশও হ্যারা লইয়া গেল।’
কিন্তু রাজাকারদের নিয়ে সেখানেও হাজির হয় পাক সেনারা। জেরা করে বাঘবাড়ির বাসিন্দাদের। তারা প্রাণের ভয়ে নাদেরকে ধরিয়ে দেয়। আটক নাদেরকে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে যায় পাক সেনারা। কিন্তু তারা তখনো জানতো না, এই ব্যক্তিই সেই নাদেইরা গুণ্ডা।
ক্যান্টনমেন্টে পাকিস্তানিদের নির্মম নির্যাতনের মুখেও নিজের বা সঙ্গীদের পরিচয় প্রকাশ করেননি নাদের। একপর্যায়ে গ্যাদা গুণ্ডাকে ক্যান্টনমেন্টে নেওয়া হলে সে নাদেরের পরিচয় প্রকাশ করে।
ক্যান্টনমেন্টেই পৈশাচিক নির্যাতন করে নাদেরকে লটকিয়ে রাখে পাক সেনারা। মৃত ভেবে পরদিন তাকে বুড়িগঙ্গা নদীতে ফেলে দেয়।
তাকে কেমন পাশবিকভাবে মারা হয়েছে, তা বংশাল-মালিটোলা-রায়সাহেব বাজারসহ আশেপাশের এলাকায় সগর্বে প্রচার করে গ্যাদা ও শান্তি কমিটির সদস্যরা।
মুক্তিযুদ্ধে নাদেরের সঙ্গীদের মধ্যে আরও ছিলেন আলু বাজারের মোহাম্মদ আলী, সিদ্দিক বাজারের সাদেক, গোলক পাল লেনের চড়ুই সাঈদ, মিরপুরের শামসু ওরফে চেঙ্গিস খান, শ্যামবাজারের আবদুল্লাহ।
মালিটোলার কয়েকজন প্রবীণ বাসিন্দার মতে, যুদ্ধ শুরু হওয়ার বছর খানেক আগে একটি খুনকে কেন্দ্র করে নাদেরের সঙ্গে গ্যাদার বিরোধ দেখা দিয়েছিল। এই পূর্ব শত্রুতার জেরে গ্যাদা নাদেরকে ধরিয়ে দিয়েছিলো বলে ধারণা করেন অনেকে।
তবে গ্যাদার পরিণতিও ভালো ছিলো না। চূড়ান্ত বিজয়ের দুদিন আগে মালিটোলায় গ্যাদাকে ধাওয়া করে মহল্লার মানুষ। তখন সে পালিয়ে টিকাটুলিতে যায়। কিন্তু সেখানে মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে ধরা পড়ে। পরে মহল্লাবাসীর সামনে গ্যাদাকে পুরো মালিটোলা প্রদক্ষিণ করিয়ে ব্রাশফায়ার করে হত্যা করে মুক্তিযোদ্ধারা।
নাদেরকে নিয়ে কলতাবাজারের ৯০-ঊর্ধ্ব বাসিন্দা নুরু মিয়া বলেন, ‘আমার লগে এক পাক আর্মির খুব ভালো পরিচয় ছিলো। নাদেরের বিষয়ে হে কইছিল, এরকম চারটা পোলা যদি থাকতো এই দেশ আরও আগেই স্বাধীন হইয়া যাইত।’
তুষার আহমেদ আরও অনুসন্ধান করতে থাকে। সে একজনের কাছে জানতে পারে, গুণ্ডা হিসেবে পরিচিত হলেও নাদের ছিলেন মানবিক। একাত্তরের মার্চ মাসে অসহযোগ আন্দোলনের সময় রেশন দোকানের দোকানিরা বেশি লাভে বিক্রির জন্যে মাল মজুত করতে শুরু করে। ফলে বাজারে দাম বেড়ে যাওয়ার পাশাপাশি দেখা দেয় পণ্যের সংকট। যুদ্ধ শুরু হলে পাকিস্তানি সেনারা রেশন দোকানে লুটপাট শুরু করে। এ অবস্থায় নাদের তার দলবল নিয়ে গোলক পাল লেনের একটি রেশনের দোকান ভেঙে মজুত করা গম চিনি আর চাল এলাকার মানুষের মধ্যে বিলিয়ে দিয়েছিলেন বলে এই তুষারকে জানান মালিটোলার একাধিক প্রবীণ বাসিন্দা।
পুরাণ ঢাকার শ্যামবাজারের ব্যবসায়ী মোহাম্মদ হাবিবের শৈশব-কৈশোর কেটেছে মালিটোলায়। তিনি জানান, ‘মহল্লার বাইরে নাদেরের হয়তো বদনাম ছিলো। কিন্তু মহল্লার মুরুব্বীদের দেখলে তিনি সম্মান করতেন। আমরা যারা ছোট ছিলাম, তাদের ভীষণ স্নেহ করতেন।’’
তুষার অনুসন্ধানী প্রতিবেদন করতে গিয়ে আরও জানতে পারেন, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানে টালমাটাল তখন ঢাকার সমস্ত জনপদ। এমনই এক উত্তাল সময়ে বন্ধু হাবিলের বাড়িতে বেড়াতে গিয়েছিলেন নাদের। সেখানেই তার ভালো লেগে যায় মেরী নামের একটি মেয়েকে। জানতে পারেন মেয়েটির বাবা নেই, মা থাকে বরিশালে। হাবিলের বাবা মা’ই লালন-পালন করছে তাকে। নাদের সোজা বিয়ের প্রস্তাব দেন বন্ধুর বাবা-মাকে। কিন্তু রাজী হলেন না হাবিলের বাবা-মা। রাজি না হওয়ায় রাতের বেলায় নাদের তার সাঙ্গপাঙ্গসহ মেয়েটিকে উঠিয়ে অন্যত্র নিয়ে যান। সেখানে বিয়ে করে ফিরে মালিটোলার নিজের বাড়িতে। প্রথমে নাদেরের বাবা-মা রাজি না হলেও কিছুদিন পরে পুত্রবধূকে মেনে নিয়েছিলেন তারা।
বিয়ের পর স্ত্রী মেরীর নাম বদলে মনোয়ারা আক্তার রাখেন নাদের। মনোয়ারা এই তুষারকে বলেন, ‘সব তো ভালাই চলছিল। বাইরে মানুষে গুণ্ডা কইলেও, তার দিল খুব ভালা আছিল। সারাদিন তো বাইরে বাইরেই থাকতো। তয় আমারে খুব ভালোবাসতো।’
নাদের যুদ্ধ শুরু করার পর মনোয়ারার জগত পুরোপুরি পাল্টে যায়। তিন মাসের মধ্যেই সে বুঝতে পারে তার গর্ভে সন্তান। সে তখন মানিকগঞ্জে। কয়েকদিন পরেই ঢাকায় ফিরে আসেন সবাই। মনোয়ারাকে পাঠিয়ে দেওয়া হয় বরিশালে তার মায়ের কাছে। মনোয়ারা তখন চার মাসের অন্তঃসত্ত্বা। যুদ্ধের মধ্যেই জন্ম হয় নাদের-মেরী দম্পতির প্রথম সন্তান অনন্যার। যুদ্ধ শেষে কয়েক মাস বয়সী সন্তানকে নিয়ে ঢাকায় ফিরে এসেছিলেন মনোয়ারা। কিন্তু শ্বশুরবাড়িতে তার ঠাঁই হয়নি।
মনোয়ারা বলেন, ‘আমারে তো বাড়ি থেইকা একরকম খেদাইয়াই দিলো। কখন কী করে এই ভাবনায় আর যাই নাই।’ এক পর্যায়ে মেয়ে অনন্যাকে নিয়ে পালক মা-বাবার কাছে চলে গিয়েছিলেন মনোয়ারা। সেখানে কয়েক বছর থাকার পরে পরিস্থিতির কারণে পালক বাবা-মাও তাকে ত্যাগ করে।
ততদিনে মনোয়ারার ভাই কাঞ্চন বরিশাল থেকে ঢাকায় চলে এসেছিলেন। শেষমেশ ভাইয়ের কাছে গিয়ে উঠেন তিনি। যুদ্ধের পুরো নয় মাস সে তার স্বামী নাদেরের জন্যে অপেক্ষা করে। মানুষরা তাকে জানিয়েছে নাদেরকে মেরে বুড়িগঙ্গায় ফেলে দিয়েছে পাক সেনারা। কিন্তু সে বিশ্বাস করেনি। অশ্রু ঝরাতে ঝরাতে আশায় আশায় থাকে। স্বাধীনতা যুদ্ধের শেষে একদিন খবর পায় তার নাদের বেঁচে আছে।
যুদ্ধ শেষে নাদের তার কাছে ফিরে আসে। কিন্তু সে জানায়, সে মুক্তিযোদ্ধার সার্টিফিকেট নেয়নি। কারণ সে যুদ্ধে গিয়েছিলো দেশকে রক্ষা করতে, সামান্য সার্টিফিকেটের জন্যে নয়।
নাদের গুণ্ডা আবার সংসারে মনোযোগী হয়। দুই তিন বছরের মাথায় আরও দু কন্যার জনক হয়। রুবিনা ও তাসফিয়া। তিন কন্যাকে নিয়ে সে শান্তি অনুভব করে। তারপর ধীরে ধীরে সবকিছু ছেড়ে পুরাণ ঢাকায় ব্যবসা শুরু করে। প্রায় দশ বছর ব্যবসা-বাণিজ্য করে সে ঘরদুয়ার করে। মেয়েরা এখন ভার্সিটিতে পড়ে। তার একটাই চিন্তা এদেরকে পড়াশুনা করিয়ে প্রতিষ্ঠিত করে তারপর সে জীবন থেকে অবসর গ্রহণ করবে।
আজকের রাস্তার ঘটনা তার জীবনকে অন্যদিকে মোড় নেয়। সে এসব ভাবতে ভাবতে ধীরে ধীরে এগিয়ে যায়। তারপর আজাদ নামক চাঁন্দাবাজের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়।
চারদিকে শত শত লোক ঠায় দাঁড়িয়ে। ভয়ে কেউ চোখের পাতা ফেলছে না, ঠিক এই মুহূর্তে একজন প্রৌঢ় লোককে নির্বিঘ্নে তার সামনে আসতে দেখে সে অবাক হয়। রামদাটা উঁচিয়ে নাদেরকে বলে, ‘এই হালার পো, কেঠারে তুই?’ নাদেরের হাত চলতে দেরি হয় না। কিছুক্ষণের মধ্যে ঠায় দাঁড়ানো জনতা দেখতে পায় এক ভেল্কিবাজি। আজাদকে দু হাতে শূন্যে তুলে নাদের মাটিতে আছড়ে ফেলে। আজাদের পিঠের মেরুদণ্ড একটা আওয়াজ তোলে। কট করে ভেঙ্গে যায়। ব্যথায় কঁকিয়ে উঠে, সে আর দাঁড়াতে পারে না। তার এ অবস্থা দেখে তার সাঙ্গপাঙ্গরা ভয়ে পালিয়ে যায়। উপস্থিত জনতা মোহগ্রস্ত। এমন বয়সী একজন মানুষ কী করে এতো সাহস পায় যে, এলাকার এতো বড় মাস্তানকে দুই হাতে ধরে শূন্যে তুলে আছাড় দিয়ে মেরুদণ্ড ভেঙ্গে দেয়। ধীরে ধীরে তারা এগিয়ে আসে, তারপর একজন প্রশ্ন করে, আপনি কে চাচা?’
নাদের সাহেব হাসেন। তারপর উত্তর দেন, ‘আমি নাদের গুণ্ডা একজন মুক্তিযোদ্ধা ছিলাম। সত্যিকার একজন মুুক্তিযোদ্ধা কখনও পাকিস্তানী শত্রুকেই পরোয়া করে না, আর স্বাধীন বাংলাদেশের এসব পাতি মাস্তানকে ভয় করবে? আপনারা সাধারণ জনতা যদি সাহস করেন, তাহলে এরা এভাবেই লেজ গুটিয়ে পালাবে। মনে রাখবেন, ভয় দিয়ে পৃথিবীকে জয় করা যায় না। বুকের পাটা বড়ো করতে হয়।’
জনতা কিছু বলার আগেই নাদের সাহেব তার কন্যা তাসপিয়াকে নিয়ে রিকশায় উঠে ভার্সিটির দিকে এগিয়ে যায়। (চলবে)