সোমবার, ০৫ মে, ২০২৫  |   ৩২ °সে
জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয় অন্যান্য
ব্রেকিং নিউজ
  •   চাঁদপুর জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি ইউসুফ গাজী গ্রেফতার

প্রকাশ : ০৫ মে ২০২৫, ০৮:৪৪

খণ্ডে খণ্ডে অখণ্ড জীবন

পীযূষ কান্তি বড়ুয়া
খণ্ডে খণ্ডে অখণ্ড জীবন

॥ ঊনত্রিশতম পর্ব ॥

আমার যত লেখালেখি

মনের ভেতরে কথার কল নিয়ে সবাই বসে থাকে। কেউ মনে মনে কলকলায়, কেউ কলকলায় কণ্ঠে। যার মনের ফল্গুনদীর কলনাদ কলমে উঠে আসে, সে হয়ে যায় লেখক। কলম, কল্পনা আর কথার কলভরা মন না থাকলে লেখা সম্ভব হয় না। বাংলাদেশের এক বরেণ্য শিক্ষক ড. আনিসুজ্জামান। তিনি নিজেকে নিয়ে বলতে গিয়ে বলেছিলেন, তাঁর পেটে বোমা মারলেও নাকি এক লাইন কবিতা বেরুবে না। অথচ তিনি বালামে বালামে গদ্য লিখেছেন, অন্যের লেখা ঠিক করে দিয়েছেন। আজকাল অনেককেই বলতে শুনছি, ভালো লেখক হতে হলে পড়তে হবে। আসলে জানতে হলে পাঠের বিকল্প নেই। পাঠাভ্যাস একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কিন্তু লিখতে হলে অতিরিক্ত পাঠের দরকার নেই। অতিরিক্ত পাঠ লেখক হিসেবে নিজের স্বকীয়তাকে নষ্ট করে দিতে পারে। লিখতে গেলে আসলে চোখ-কান খোলা রাখার পাশাপাশি মনের দরজটাও খুলে রাখতে হয়। পারিপার্শ্বিক ঘটনাবলি এবং মানুষের আচার-আচরণ ও সংস্কৃতি লেখার এক বড়ো ও অনন্য উপাদান। লেখায় যে কেবল দোহাই খুঁজে বেড়ায়, সে লেখা প্রাণের লেখা নয়। সে লেখা পাণ্ডিত্য জাহিরের লেখা। লেখা হবে স্বতঃস্ফূর্ত, লেখা হবে নদী আপন বেগে পাগলপারা চলার মতো। কথায় কথায়, লাইনে লাইনে দোহাইয়ের ধুয়া তুলে লেখাকে খটোমটো করে তোলাটা বোকামি। লেখায় স্বরূপ থাকবে, সচলতা থাকবে। লেখক কী জানেন তা জানানোর তাগিদে নয়, লেখা হয়ে উঠবে শিল্পের প্রসব বেদনায়। রবীন্দ্রনাথ যেমন বলেছেন, অলৌকিক আনন্দের ভার বিধাতা দিয়েছে যারে, তার বক্ষে বেদনা অপার। এই বেদনা হতে মুক্তির তাগিদেই লেখা। মনের কলে জন্ম হওয়া কথার মুক্তি না দিতে পারলে অবস্থা হয়ে যায় রাজার নাপিতের মতো। যে কিনা শেষমেশ মান্দার গাছের কাছে গিয়ে বলে আসতে হয় সন্তর্পণে, রাজার দুটো শিং আছে। অতঃপর তার পেট ফুলে ঢোল হওয়া থেকে মুক্তি। কিন্তু মুক্তি কি তাতেও মেলে? ঢোলের বাড়ি বলে দেয়, রাজার দুটো শিং আছে, রাজার দুটো শিং আছে। কেননা, নাপিতের কথার সাক্ষী মান্দার গাছের কাঠেই নাকি ঢোল বানানো হয়েছিলো।

আমার সোনালি শৈশব, রূপালি কৈশোর লেখার জগতে আমাকে টেনে নিয়ে আসে। তখন তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ি। আমার শ্রেণি শিক্ষিকা মিসেস রুবি বাড়ৈ। তিনি সংস্কৃতিপ্রাণ, নজরুলনিমগ্না। তাঁর ক্লাসের হাজিরা খাতায় লেখা ছিলো নজরুলের কবিতার দুটো চরণ,

‘জয় হোক জয় হোক — শান্তির জয় হোক, সাম্যের জয় হোক্, সত্যের জয় হোক জয় হোক।’ আমি যেহেতু ক্লাস ক্যাপ্টেন ছিলাম, ঐ হাজিরা খাতা দেখে বেশ কয়েকবার শিক্ষার্থীদের নাম শুদ্ধ করে রিপোর্ট কার্ডে লিখতে হয়েছিলো। তাই চরণ দুটো মনে গেঁথে গিয়েছিলো। চরণ যুগল মনের উঠোনে হাঁটাহাঁটি করে আমাকে ব্যতিব্যস্ত করে তুললো, কথার কলে কথা তৈরি করার জন্যে। পাশাপাশি খেলাঘরের দেয়ালিকা এবং সাপ্তাহিক সাহিত্য বাসরও সেই চাপে মিত্রবাহিনী হয়ে যোগ দিলো। তবে মূল শক্তির যোগানদাতা তৎকালীন রাজনৈতিক পরিস্থিতি। স্বৈরাচারী শাসনে থাকতে থাকতে সাধারণ জনতার মধ্যে একটা দ্রোহধারা তৈরি হলো। পথেঘাটে, পাড়ার চায়ের দোকানে সর্বত্র আলোচনা চলতো। সে আলোচনায় দ্রোহের আগুন যেন ঠিকরে পড়তো সবার গায়ে। সে আগুনের তাপ আমার শীতল মনের কলকেও নাড়া দিলো। ব্যস্, তৈরি হয়ে গেলো কথা। কলম তাকে দৃশ্যমান রূপ দেওয়ায় অন্যের কাছে তা হয়ে উঠলো লেখা। তখন ছিলো লিমেরিকের একটা উপযুক্ত সময়। আমার লেখালেখির সূচনা মিষ্টির বিজ্ঞাপনে ছড়া দিয়ে হলেও লেখার তাগিদ মূলত আসে লিমেরিকের দ্রোহকাল থেকে। যোগেশ বাবুর আয়ুর্বেদিক বিজ্ঞাপন সম্বলিত বাংলা ক্যালেন্ডারের ফিনফিনে একটা পাতা দিয়ে ঘরে সেলাই করে বানিয়ে নিলাম কবিতার খাতা। তাতেই মনের কলের কথাগুলো চুপ করে বসে থাকতো অন্য কারও চোখে পড়ার জন্যে।

আমার বাবার মাসতুতো ভাই বাংলা নিয়ে পড়তেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে। তিনি বাসায় বেড়াতে এসে আমার খাতাটি উৎখনন করলেন বলা যায়। পড়তে পড়তে তাঁর ভালো লেগে গেলো। দুয়েকটা পংক্তির মাত্রা সংখ্যাও তিনি ঠিক করে দিলেন। একটা ছড়া ছিলো এমন,

তৃতীয় বিশ্বে দরিদ্র দেশ

পায় না দুবেলা খেতে

উন্নত বিশ্ব অস্ত্র বেচতে

আছে যুদ্ধে মেতে।

এটার শেষ দুলাইন তিনি করে দিলেন এভাবে,

উন্নত বিশ্ব যুদ্ধবাজ

আছে যুদ্ধে মেতে।

ফলে ‘উন্নত বিশ্ব’ সাতমাত্রিক হওয়ায় ‘ যুদ্ধবাজ’র পাঁচমাত্রার সাথে যোগ হয়ে ষাণ্মাত্রিক সাম্য রক্ষা হলো। পড়তে হলো এভাবে,

উননত বিশ/শ যুদধবাজ।

বাবার মাসতুতো ভাইয়ের উৎখননে লেখার খাতায় ঢোলের বাড়ি পড়ার পর পর আমার কলমের রেলগাড়ি ছুটলো। একের পর এক চৌপদী, আটপদী খাতা ভরিয়ে তুললো। এই গতিতে ঘি ঢেলে দিলো ক্লাসে ধর্ম শিক্ষকের অকারণ মার। প্রতিবাদী মনকল কথাকে বানিয়ে দিলো বোমা। সে বোমা ফাটালেন ক্লাস টিচার নিজে, ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নজরে এনে। ফলাফল হলো অকারণ শাস্তি হতে মুক্তি। অন্যের ধর্মক্লাসে আমাদের আবদ্ধ না রেখে মুক্তি দেওয়া হলো চল্লিশ মিনিট। আমাদের ধর্মশিক্ষক না থাকায় আমরা এই মুক্তি উপভোগ করতাম হলরুমে আবদ্ধ থেকে কৈশোরিক ক্রীড়ামোদে নিজেদের ব্যাপৃত রেখে।

ছড়া লেখার শক্তিকে গদ্য লেখার শক্তিতে পরিণত করে তুললো বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্র। বইপড়া প্রতিযোগিতায় নাইনে এবং একাদশ শ্রেণিতে অংশগ্রহণ করি। দুবারই অনেক বই উপহার পাই মূল্যায়ন অভীক্ষায় কৃতিত্বের জন্যে। ধীরে ধীরে লেখার জগতে আমার পরিব্রাজনের অভিলাষ নিয়ে অভিষেক হয়। দৈনিক ও সাময়িক পত্রিকায় লেখালেখি হলেও বই প্রকাশের ঝামেলায় তখনও যাইনি। লিখতে লিখতে জমে যাওয়া শস্যগুলো নিয়ে দুহাজার পাঁচ সালে ফেব্রুয়ারিতে আমার প্রথম বই প্রকাশিত হয়, শৈলী প্রকাশন থেকে। রাশেদ ভাই এই প্রকাশনীর কর্ণধার। বন্ধুবর টিটুর মাধ্যমে যোগাযোগ হয় রাশেদ ভাইয়ের সাথে। বইটির নাম ছিলো ‘তোমার নিবীতে অন্য কেউ।’ পঞ্চাশ টাকা মূল্য। তিন ফর্মার বই। প্রথম কাব্য গ্রন্থ। কয়েকটা সমিল ছন্দ-মাত্রার, কয়েকটা আধুনিক গদ্য কবিতা এবং কয়েকটা উত্তরাধুনিক কবিতা নিয়ে বইটা। বইটার প্রচ্ছদ করেছেন পীযূষ দস্তিদার। প্রথম কাব্যগ্রন্থে আমার কবি নাম ছিলো পীযূষ যীশু। বন্ধু তৌহিদের মাধ্যমে বইটার পাণ্ডুলিপি পৌঁছালাম বরেণ্য কবি ও সাংবাদিক জনাব আবুল মোমেনের কাছে। তিনি বেশ স্নেহ নিয়ে পাণ্ডুলিপি পড়ে বইটার একটা নান্দনিক ভূমিকা লিখে দিলেন। প্রতিটা লাইনে একজন নূতন কবির প্রতি তাঁর স্নেহাশিস্ ঝরে পড়েছিলো। রাশেদ ভাই এ ভূমিকাটি পেয়ে পেছনের প্রচ্ছদে ছাপিয়ে দিলেন। রাশেদ ভাইয়ের এ দূরদর্শিতা আমার জন্যে আরেক আশীর্বাদ হয়ে দাঁড়ায়। বইটির প্রচার ও বিপণনে আমার শ্রদ্ধেয় শিক্ষক প্রফেসর শরীফ হাসান ব্যাপক ভূমিকা রাখলেন। বইয়ের নামকরণ তাঁর এতো ভালো লেগেছিল, তাই তিনি নিজে বইয়ের বেশ কয়েক কপি তাঁর অন্য ছাত্র-ছাত্রীদের কাছে বিক্রি করেছিলেন। তিনি নিজেও একজন ভালো আলোকচিত্রশিল্পী। অবেদনবিদ নাজিম ভাইও উৎসাহী ছিলেন বইটা নিয়ে। বইটা নিয়ে একটা আফসোস আমার রয়ে গেছে। একটা কবিতা অর্ধেক ছাপা হয়েছে। অবশ্য পাঠকের এ বিচ্ছিন্নতা চোখে পড়বে না। আশীর্বাদক শ্রদ্ধেয় আবুল মোমেনের লেখাটি আসলে ছয় পংক্তির একটা অনন্য আশাবাদের কবিতা। এতে তিনি লিখেছিলেন, ‘ এ কবিতা স্বপ্ন ও সংগ্রামের কথা বলে / এ কবিতা সার্থকতার পথে প্রথম সোপান।

কবিতা নিয়ে আমার দ্বিতীয় প্রকাশনা হলো ‘ আমার মায়ের সুচিকিৎসা চাই’ শিরোনামে কবিতাপত্র। তখন অর্থাৎ দুহাজার দশ সালে ইভটিজিংয়ের বাড় বাড়ন্ত ছিলো। ডিসেম্বরে ধীরে ধীরে বেশ কয়েকটা কবিতা লেখা হলো, ইভটিজিং বিরোধী। কবিতাগুলো নাতিদীর্ঘ। ঐ কবিতাপত্রে একটা মাত্র গদ্যকবিতা স্থান পেয়েছে, যেটির নাম-কবিতা। ‘ আমার মায়ের সুচিকিৎসা চাই।’ এতে পৃথিবীকে মা চিন্তা করে দূষণজর্জর পৃথিবীকে তার সবুজ সতেজ জীবন ফিরিয়ে দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। পৃথিবীকে নারী কল্পনা করে তার প্রতি যতো অনাচার-অত্যাচারকে ইভটিজিং হিসেবে দেখানো হয়েছে। মরোমরো আমার মা পৃথিবীর সুচিকিৎসা চাই। তৎকালীন জেলা প্রশাসক প্রিয়তোষ সাহা বিজয় মেলা মঞ্চে কবিতাপত্রটির মোড়ক উন্মোচন করেন। দুহাজার দশ সালের ষোল ডিসেম্বর। বিজয় মেলা মঞ্চে সুযোগ পেতে বেশ বেগ পোহাতে হয়েছিলো সে সময়। আব্দুল আউয়াল রুবেল ভাই কুমিল্লা থেকে আমার ব্যানার ছাপিয়ে এনেছিলেন। তিনি মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানের আয়োজকের ভূমিকা পালন করে বেশ সহযোগিতা করেছিলেন । কৃতজ্ঞতা তার প্রতি। আমার তৃতীয় বইটি হলো ‘সায়নালোকে এক জীবনের সন্ধ্যায়।’ এটি প্রকাশিত হয় দুহাজার তের সালের ফেব্রুয়ারিতে। পাঞ্জেরী পাবলিকেশন্স থেকে। বইটি প্রকাশের পেছনে কাজী শাহাদাত ভাইয়ের ভূমিকা ছিলো বেশ। শায়ক ভাইয়ের সাথে যোগাযোগ ঘটান তিনি। বইটি একটি উপন্যাসিকা। সায়ন হলো এ কাহিনীর নায়ক। এর মাঝ আমি আমার বাবার প্রতিচ্ছবি দেখি। তাঁর জীবন ও সংগ্রামের আখ্যান। বইটির সাহিত্যমূল্য যাই হোক না কেন, এটি আমার কাছে মূল্যবান। কারণ এখানে জীবন্ত হয়ে আছে বাবার জীবন। পাঞ্জেরী আমাকে বইয়ের নামটা সহজ করতে বলেছিল। আমি নারাজি হই। কারণ যে আবেগকে ধারণ করে বইটা লেখা হয়েছে নামকরণ তার যেন শতভাগ ফুটিয়ে তুলতে পেরেছিল। আমার বাবার ডাক নাম ছিল সায়ন। বইটির নামকরণ তাই অর্থদ্যোতকতায় পূর্ণ। হাজারখানেক কপি ছাপানো হয়েছিল। কাজী শাহাদাত ভাই বিতর্ক প্রতিযোগিতায় আমার বইটি শ্রেষ্ঠ বক্তার পুরস্কার হিসেবে বেছে নেওয়ায় বিপণন নিয়ে আর ভাবতে হয়নি। বাংলা একাডেমি বইমেলায় বিকেলের স্লটে বাংলাভিশনের পক্ষ থেকে আমার ইন্টারভিউ নেওয়া হয়, মেলায় নতুন বইয়ের লেখক হিসেবে। দেশবরেণ্য আবৃত্তিকার মাহিদুল ইসলামের সঞ্চালনায় মোটামুটি ভালই কাভারেজ পেয়েছিলাম প্রথম উপন্যাস নিয়ে। বইটির একটা লাইন ডা. এম আর কে মাসুদ ভাইয়ের বেশ ভালো লেগেছিলো। তিনি পরবর্তী পাঠ প্রতিক্রিয়ায় কোম্পানির এম আর মারফতে তা জানান। লাইনটি ছিলো : ‘সময় নির্মাণ করে সায়নকে আর সায়ন নির্মাণ করে সময়কে।’ মাত্র একশ টাকা মুদ্রিত মূল্যের বইটি এখন আর বাজারে নেই। তবে অনলাইনে প্রচ্ছদ দেখা যায়। বইয়ের প্রচ্ছদটি আঁকা নয়, ডিজিটাল প্রযুক্তি ও আলোকচিত্রের যুগলবন্দিতা। সহজ সরল বর্ণনায় বইটি লেখা যাতে সায়নের জীবনাখ্যান পাঠক সহজে বুঝতে পারে। আমার বন্ধু শ্যামল, যে কি না শিশু চিকিৎসক, তার কাছে আমার গ্রামের বর্ণনাটা নাকি চোখের সামনে ভেসে উঠেছে। সেও খুব উল্লসিত ছিল বইটা পড়ে। চাইলে বইটার কলেবর বাড়ানো যেত। আমার এক শুভাকাঙ্ক্ষী বড়ো ভাই সেকথা বলেছিলেন। কিন্তু আমি দুটো বিষয়ে স্থির প্রতিজ্ঞ ছিলাম। আমি নিছক কোন প্রেম-পিরিতির কাহিনী লিখবো না। আর আমার লেখা অলীক কল্পনায় টেনে বড়ো করবো না।

দুহাজার তেরো সালের পরে একটা দীর্ঘ বিরতি হয় প্রায় চার বছরের। দুহাজার সতের সালের মে মাসে প্রকাশিত হয় আমার ইলিশ ছড়াগ্রন্থ ‘ ইলিশের বাড়ি।’ এটিই প্রথম একক ইলিশকেন্দ্রিক ছড়াগ্রন্থ। এটি প্রকাশে তৎকালীন জেলা প্রশাসক জনাব আবদুস সবুর মন্ডল মহোদয়ের অনুপ্রেরণা জড়িত। জেলা ব্র্যান্ডিংয়ের সাথে ছড়াগ্রন্থটি ওতপ্রোতভাবে জড়িত। মানস মিস্ত্রি বিশেষভাবে ধন্যবাদের যোগ্য। কারণ বইয়ের পাণ্ডুলিপি সম্পাদনা থেকে থেকে প্রকাশনা পর্যন্ত সবই সে করেছে। বইয়ের প্রচ্ছদ এঁকেছে তারই ভাগ্নি প্রিয়ন্তী সমদ্দার। বইটির মোড়ক উন্মোচিত হয় চাঁদপুর সাহিত্য সম্মেলন ২০১৭- এ। মোড়ক উন্মোচন করেন আন্তর্জাতিকভাবে স্বনামধন্য চিত্রশিল্পী হাশেম খান এবং তৎকালীন বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক ড. শামসুজ্জামান খান। বইটিতে জেলা ব্র্যান্ডিং প্রকাশনা কমিটির সদস্যদেরকেও কৃতজ্ঞতা জানানো হয়েছে। এ বইটি বেশ সাড়া তৈরি করেছে এবং বইটির বেশ কয়কটি ছড়া অনেকের মুখে মুখে ছড়িয়েছে। ইলিশকে আমি চাঁদপুরের মেয়ে চিন্তা করে সন্তান জন্মদানকালে বাবার বাড়ি আসার চিরন্তন বাঙালি আবেগকে ফুটিয়ে তুলেছি। এই ধারণাটি অকপটে গ্রহণ করেছেন শাইখ সিরাজ এবং তিনিও তাঁর প্রতিবেদনে এ কথা ব্যবহার করেছেন। এ বইয়ের একটা ছড়ার চার লাইন হলো, ‘জাটকারা চাঁদপুরের নাতি / জাটকা ধরো না / কিশোর ইলিশ বাড়তে দিও / লালসা করো না।’ বইটি জাতীয় জেলা ব্র্যান্ডিং শো-কেসিংএও প্রদর্শিত হয়েছিলো। বইটি বর্তমানে তৃতীয় মুদ্রণ দ্বিতীয় সংস্করণ অতিক্রম করেছে। দ্বিতীয় সংস্করণেও বইটি চাঁদপুর জেলা প্রশাসনের মনোযোগ লাভ করেছে।

দুহাজার সতের সালের সেপ্টেম্বরে ‘শোকের অর্ঘ্যে বঙ্গবন্ধু’ শিরোনামে একটা কিশোর কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়। বইটির প্রকাশক আরিফ রাসেল বেশ যত্ন নিয়ে চমৎকার একটা প্রচ্ছদ নির্মাণ করেছিলেন। আঠারো সালের ফেব্রুয়ারিতে বাংলা একাডেমির বইমেলায় আমার পাঁচটা বই প্রকাশিত হয়। প্রবন্ধের একটা বই ছিলো যার নাম ‘প্রজ্ঞা-প্রসূন’। কারুবাক থেকে প্রকাশিত হয়। কাজী শাহাদাত ভাই বইটা নিয়ে বেশ সন্তোষ প্রকাশ করেছিলেন। বইয়ের প্রথম প্রবন্ধ ‘ কবিয়াল ও কবিগান : নিভু নিভু যে দেউটি।’ এটি বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি, ঢাকার ষাণ্মাসিক জার্নালে ‘ কবিয়াল ও কবিগান : সংক্ষিপ্ত পর্যালোচনা’ শিরোনামে প্রকাশিত হয়। বইটির ‘মৃত্যু’ বিষয়ক প্রবন্ধটি কথাসাহিত্যিক ইলিয়াস ফারুকী ভাইয়ের মন জয় করে। ইলিশ নিয়ে প্রবন্ধটি বন্ধুপ্রতিম অনুজ কবি ও কথাসাহিত্যিক জব্বার আল নাঈমের নজর কাড়ে। এমনিভাবেই বইটা কোনো না কোনোভাবে পাঠকের দৃষ্টি কাড়ে। বইটার পান্ডুলিপি সম্পাদনাকালে অধ্যাপক মতিউর রহমান গাজ্জালী আফসোস করেন, ‘লেখক যদি রাজধানীবাসী হতেন তাহলে বইটার কদর আরও বাড়তো,’এই বলে। আমি অবশ্য তাঁর ছাত্রী মুক্তার স্বামী বলে তিনি সে সম্পর্কে আমাকে স্নেহও করেন। এ বইটির একটা সুন্দর আলোচনা লেখেন অনুজ অনুবাদক ও কবি মাইনুল ইসলাম মানিক। একই প্রকাশনী হতে বের হয় প্রথম ছোটগল্প সংকলন ‘ কল্পকুসুম’। গল্পগুলো আগে এখানে-সেখানে প্রকাশিত হয়েছিল। বইটির অন্যতম পাঠক কবি জাহিদ নয়ন পাঠ প্রতিক্রিয়ায় বেশ প্রশংসা করেন। বইটির একটি গল্প ‘জ্বিনে ধরা মেয়েটিকে ভূতে ধরেছিলো’ শিরোনামে ছোটগল্পের কাগজ ‘বাঁক’- এ প্রকাশিত হয়েছিল। বইটির প্রথম গল্প ‘অশ্রু ভেসে যায় নীলমের জলে’ পাঠ করে আবেগাপ্লুত হয়েছিলেন অগ্রজ ও প্রয়াত অধ্যাপক আহসানুজ্জামান মন্টু ভাই। বইটির ‘পরিণাম’ গল্পটি ‘নিয়তি’ শিরোনামে কোলকাতার ‘কালি কলম ও ইজেল’-এর ছোটগল্প সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছিল। দুহাজার আঠারো সালেই ‘দৃষ্টি ‘ থেকে প্রকাশিত হয় আমার ভিন্নধর্মী উপন্যাস ‘ঘুমের মধ্যে লীলা আসে।’ এটি কোনো নিছক প্রেমের উপন্যাস নয়। এটি আদতে উপন্যাসের আখ্যানের আদলে বাংলাদেশকে ব্র্যান্ডিং-এর প্রয়াস। বইটির প্রচ্ছদ করেছেন শতাব্দী জাহিদ। কবি ও নির্মাতা বীরেন মুখার্জি বেশ যত্ন নিয়েই বইটি ছাপান। এতে লীলা নামের না পরি বা মানবী এক নারীর সাথে হরিৎ নামের এক যুবক ঘুরতে ঘুরতে বাংলাদেশকে জানতে থাকে। হরিৎ ও লীলার মধ্যে প্রেমের চেয়ে বন্ধুতার উপাদান অধিক। তবে বৃষ্টি নামের এক চরিত্র এসে হরিৎকে হরণ করতে চায়। কিন্তু হরিৎ লীলার সাহচর্য হারাতে চায় না। এ বইটা নিয়ে মরিয়ম আক্তার নামে একজন বিজ্ঞ পাঠিকা জাগো নিউজের অনলাইনে সাহিত্য বিভাগে তার পাঠ প্রতিক্রিয়া লিখে পাঠায়। এটি একত্রিশে জানুয়ারি দুহাজার একুশ সালে প্রকাশিত হয়। বইটা তার কাছে ভালো লেগেছে বলে তার আলোচনায় ফুটে উঠেছে। আমি অনলাইনে বইয়ের প্রচ্ছদ খুঁজতে গিয়ে ঘটনাচক্রে আলোচনার অংশটি নজরে আসে। এখানে তার কয়েকটা লাইন তুলে দিলাম : “ঘুমের মধ্যে লীলা আসে’ উপন্যাসটি পড়তে পড়তে যেন আমিও হরিতের সাথে হারিয়ে যেতাম তার কল্পনার রাজ্যে। নিজেকে যেন লীলার মাঝে খুঁজে পেয়েছি। সত্যিই অসাধারণ লেখকের ভাব প্রকাশের উক্তিগুলো।

লেখক শুধু কাহিনিই রচনা করেননি। তুলে ধরেছেন বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানের পূর্ব ইতিহাস। যেখান থেকে নিঃসন্দেহে যে কেউ তার জ্ঞানের ধারা প্রসারিত করতে পারবেন। যে কোনো পাঠকের মনে স্থান করে নিতে পারবে পীযূষ কান্তির ‘ঘুমের মধ্যে লীলা আসে’।”

‘ঘুমের মধ্যে লীলা আসে’ বইটির বেশ কিছু কপি চাঁদপুরের বিদিত সংগঠক অ্যাডভোকেট বিনয় ভূষণ মজুমদার দাদা সংগ্রহ করে জীবনদীপের স্বেচ্ছায় রক্তদাতাদের উপহার দেন। মজার বিষয় হলো বীর মুক্তিযোদ্ধা বাসুদেব মজুমদার দাদার পত্নী শ্রদ্ধেয়া লীলাদি তাঁর নামের সাথে শিরোনাম মিল থাকায় বইটি নিয়ে আগ্রহী হয়ে উঠেন। একই সালে য়ারোয়া প্রকাশনী থেকে বের হয় আমার শিশুতোষ গল্পের বই ‘মুক্তিবীর’ একটা গল্পে একটা পুস্তিকা। মহান মুক্তিযুদ্ধে একজন গ্রামীণ শিশুর অবদান নিয়ে গল্প। বইটার মুদ্রিত মূল্য মাত্র পঁচাত্তর টাকা। কুমিল্লা জেলা শিল্পকলা একাডেমির তৎকালীন কালচারাল অফিসার সৈয়দ মুহাম্মদ আয়াজ মাবুদ ভাই এ বইটা কুমিল্লা বই মেলায় বেশ ভালোই বিক্রি করিয়েছেন। ‘শেকড়ের টানে ছড়া অভিযানে’ একটা বই প্রকাশ করেছিল মূর্ধণ্য। সঞ্জয়দা বেশ যত্ন করেই ছাপিয়েছেন বইটা। অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) জনাব শওকত ওসমান এ বইটাকে আলোর মুখ দেখিয়েছেন। বইটাতে বাংলাদেশের চৌষট্টিটা জেলার নামকরণের উৎস ছড়াকারে বিধৃত আছে। তবে ছড়াগুলো নিরেট নিয়ম মেনে নয়, কোথাও কোথাও লোকজ ঢংয়ে বিরচিত। শিল্পী মোমিনউদ্দীন খালেদের করা প্রচ্ছদে জেলা ব্র্যান্ডিংয়ের জন্যে বইটি সহায়ক। বইটির একটা সুন্দর ও নির্মোহ আলোচনা করেছেন ছড়াশিল্পী মাহবুবা কুমকুম আপা। দুহাজার উনিশ সালে প্রকাশিত হয় ‘ব-দ্বীপ হতে বাংলাদেশ’ শিরোনামে ইতিহাসভিত্তিক কিশোর কাব্যগ্রন্থ। বইটি শৈলী প্রকাশন থেকে প্রকাশিত হয়। তবে অলংকরণ দুর্বল ছিলো। দৈনিক জনকণ্ঠের সাময়িকীতে বইটির চমৎকার আলোচনা লিখেছেন কবি ও প্রাবন্ধিক সৌম্য সালেক, ‘ছন্দ-সারল্যে বাংলাদেশের ইতিহাস’ শিরোনামে।

বিতর্ক নিয়ে আলোচনা করতে মাঝে মাঝে চিত্রলেখার মোড়ে আমার চেম্বারে আসতো বাবুরহাট স্কুল এন্ড কলেজের শিক্ষক মাসুদুর রহমান। জ্ঞান ও বিজ্ঞান চর্চায় মাসুদুর রহমান একজন নিবেদিতপ্রাণ আধুনিক মানুষ। সন্ধ্যার দিকে রোগীর চাপ কমে গেলে মাসুদ আসতো আমার কাছে। তখন সে দেখতো, আমি চৌপদী কিছু নিবেদনমূলক কবিতা লিখছি। দুয়েকটা শুনতো। সেই ছিলো প্রথম শ্রোতা, ঐ চৌপদীগুলোর। নিজ থেকে বলে উঠলো, সে আমার এই কাব্যগ্রন্থ প্রকাশে ইচ্ছুক। মূলত জুলাইয়ে পত্নীর জন্মদিনকে কেন্দ্র করে আমি দৈনিক একটা করে নিবেদনধর্মী চৌপদী লিখতাম, পরে মাসুদের আগ্রহে প্রতিভা প্রকাশ থেকে একটা কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়,

‘প্রণয়কাব্য’ শিরোনামে। এতে একশো বারোটি প্রণয়কাব্য স্থান পেয়েছে। বইটি সঙ্গত কারণেই উৎসর্গ করা হয়েছে আমার অন্তরবাসিনী জীবনসাথিকে। আমার অগ্রজ কবি ও চিকিৎসক ভাগ্যধন বড়ুয়া বইটি পাওয়ার পরে দ্বিভাষিক করার পরামর্শ দেন। তবে সময়াভাবে তা এখনও হয়ে উঠেনি। কবিতাগুলো সমিল ছন্দে লেখা যাতে প্রণয়কে আরাধনার মতো করে তোলা হয়েছে। এ বইটি হাতে পেয়ে কবি ও ব্যাংকার আরিফ সজীব নিজেই স্বপ্রণোদিত হয়ে তার পাঠ প্রতিক্রিয়া লেখেন। বইটিতে মাত্রার ব্যবহারের পারঙ্গমতায় আরিফ মুগ্ধতা প্রকাশ করেন। বইটির অনন্য বিশেষত্ব হলো, এটি আমার হস্তলিপিতে প্রকাশিত। প্রকাশক ও শিশুসাহিত্যিক মঈন মুরসালিন পাণ্ডুলিপি হাতে পেয়ে উল্লসিত হন। কবি রহিম শাহ্ পাণ্ডুলিপি পাঠে তৃপ্ত হয়ে বইয়ের নাম নিয়ে ভাবতে বলেন। আমি প্রথমে নাম দিয়েছিলাম ‘নিবেদন কথামালা’। পরে কবি রহিম শাহ্ ও মঈন মুরসালিন ভাইয়ের পরামর্শ বিবেচনায় আমি নাম রাখি ‘প্রণয়কাব্য ‘। নামটি দুজনেরই পছন্দ হয়েছিলো। এ বইটির প্রণয়ের কবিতাগুলো আমাদের গণ নানাভাই লায়ন মাহমুদ হাসান খান ভাইয়ের খুবই পছন্দ হয়। তিনি স্বেচ্ছায় আমার কুড়ি কপি বই নিয়ে তাঁর নাতনী মহলে বিতরণ করেন। এ উপলক্ষে কবিকে ডেকে নিয়ে চাঁদপুর প্রেসক্লাবের পেছনে ডাকাতিয়া সংলগ্ন মাঠে কবিকণ্ঠে কবিতাপাঠের আসর বসান। ছবিয়াল হিসেবে ডায়বেটিসের ঝুঁকিপূর্ণ মিষ্টি হাসির ধারক সময় টিভির ফারুক ভাই ছিলেন। দুহাজার কুড়ি সালে ফরিদ আগ্রহ প্রকাশ করলো আমার একশো কবিতার একটা গ্রন্থ হোক। সেই মোতাবেক চৈতন্য হতে বাজারে এলো ১০০ কবিতা শিরোনামে আমার নূতন কাব্যগ্রন্থ। প্রচ্ছদ করেছেন রাজীব দত্ত। এ প্রচ্ছদটি আমার বেশ পছন্দসই হয়েছে। একশো কবিতার মধ্যে হাতে গোণা কয়েকটি দীর্ঘ কবিতা আছে। শুরুর কবিতাটা মাকে নিবেদন করে। বাবাকে নিবেদিত একটা কবিতাও আছে। বইটা উৎসর্গ করা হয়েছিল আবদুস সবুর মন্ডলকে, যিনি চাঁদপুরকে ব্র্যান্ডিং করে গেছেন ভালোভাবেই। বইমেলায় তিনিই বইটার মোড়ক উন্মোচন করেন। ‘ঘুমের মধ্যে লীলা আসে’ বইটির মোড়ক উন্মোচন করেছিলেন খ্যাতিমান অভিনেতা পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়, বইমেলাতেই। এক্ষেত্রে আমার বন্ধু সৌরিনের অবদান আছে। একশো কবিতার কাব্যগ্রন্থ নিয়ে কাজী শাহাদাত ও মোশাররফ ভাইয়ের আগ্রহে শহীদ মিনারে অমর একুশে উপলক্ষে একটা অনুষ্ঠান হয় সনাকের পক্ষ থেকে। এতে আমার বই থেকে সবাই কবিতা পাঠ করেন। কাজী শাহাদাত ভাই, মোশাররফ ভাই, মেরি আপা, বন্যাপা, সবিতাদি, ডা. সৈয়দা বদরুন্নাহার আপা সবাই একটা করে কবিতা পাঠ করে আমার একশো কাব্যগ্রন্থকে তাঁরা বরণ করে নেন। আমার পত্নী মুক্তা পীযূষও বরাবরের মতো একটা কবিতা পাঠ করেন। দুহাজার কুড়ি সালে সুন্দরম্ প্রকাশনী আমার একটা বই প্রকাশ করে। বইটির নাম ‘জনকের অমৃত জীবন।’ বইটির সুন্দর প্রচ্ছদ করে দিয়েছেন উত্তম সেন। ফরিদগঞ্জ উপজেলা পরিষদের সৌজন্যে বইটা পৃষ্ঠপোষকতা পায়। জীবন ও কর্মভিত্তিক বইটা কাহিনীকাব্য আকারে পরিকল্পিত হয়েছে। দুহাজার একুশ সালে য়ারোয়া প্রকাশনী প্রকাশ করে গবেষণাধর্মী আরেকটা বই ‘চাঁদপুরে বঙ্গবন্ধু’। বইটা য়ারোয়া প্রকাশনীর কর্ণধার বাদল চৌধুরীর তাগাদায় লেখা। পরের বছর তারা এর ধারাবাহিকতায় আরেকটি প্রবন্ধ সংকলন প্রকাশ করে ‘সৃজনশস্যে বঙ্গবন্ধু’ শিরোনামে। দুহাজার একুশ সালে প্রসিদ্ধ পাবলিশার্স থেকে বের হয় দুটো শিশুতোষ গল্পগ্রন্থ ‘ভুতুড়ে পাখা’ এবং ‘লুই পা’র কলম’ শিরোনামে। বই দুটোর প্রোডাকশন খুব ভালো হয়েছিলো। গল্পগুলো কিশোরদের জন্যে যথাযথ ছিলো। ‘ভুতুড়ে পাখা’ বইটি পাঠোত্তর ভালো প্রতিক্রিয়া লিখেছিলো কাদের পলাশ। এর ফাঁকে ‘তারা মাসী চাঁদ মামা’ শিরোনামে একটি নিটোল শিশুতোষ ছড়ার বই বের হয় কারুবাক থেকে। বইটার অলংকরণ করেছেন কিবরিয়া। এ বইটা আসলে আমার বড়ো ছেলে প্রত্নকে বড়ো হতে দেখে লেখা, একদম শিশুতোষ। বইটা খোদেজা আপা তার স্কুলের শিক্ষার্থীদের মাঝে পুরস্কার হিসেবে বিতরণ করেন। খোদেজা আপা হলেন সাংবাদিক ও সক্রিয় রোটারিয়ান মাহবুবুর রহমান সুমনের সহধর্মিণী এবং সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা। কিছু বই রোাটারিয়ান মাহমুদা খানম ভাবী রেলওয়ে কিন্ডারগার্টেনে বিতরণ করেন পুরস্কার হিসেবে।

এরপর একটানা বেশ কয়েকটা প্রবন্ধের বই প্রকাশিত হয়। ‘মননশস্যে নজরুল’, ‘শেকড়ের রবীন্দ্রনাথ ও বিবিধ’ ইত্যাদি। এর মধ্যে অনুপ্রাণন বের করেছে নজরুল-রবীন্দ্রনাথ নিয়ে বই দুটো। এ বছর অনুপ্রাণন প্রকাশ করেছে আরেকটি প্রবন্ধের বই

‘পাঠ শেষে কবি।’ ‘মননশস্যে নজরুল’ বইটি মোশাররফ ভাই তাঁর বাবুরহাট স্কুল এন্ড কলেজে পুরস্কার হিসেবে বিতরণ করেন। দুহাজার বাইশ সালে পরিবার প্রকাশ করে আমার দ্বিতীয় গল্পের বই ‘টক অব দ্য কান্ট্রি।’ এতে নাম গল্পটিই করোনাকে নিয়ে। গল্পটি দৈনিক চাঁদপুর কণ্ঠের সাহিত্য পাতায় প্রকাশিত হয়। সম্পাদনা করার সময় গল্পটি পড়ে কাজী শাদহাদাত ভাই আমাকে ফোন দিয়ে তার সন্তুষ্টির কথা জানান। গল্পের ভাষা বেশ রুচিসম্পন্ন হয়েছে বলে তিনি স্বস্তি প্রকাশ করেন।

দুহাজার তেইশের ডিসেম্বরে দ্বিতীয় সংস্করণ ‘ইলিশের বাড়ি’ প্রকাশ পায়। একই সালের মার্চে আমার আরেকটি প্রিয় বই ‘ফুল ফোটাবার কাব্য’ বের হয়। এতে নীতিকথা ও মূল্যবোধের কবিতা আছে, যা তরুণ ও যুবকদের আলো দেখাতে পারে। বইটি বাবুরহাটের মাসুদুর রহমান তালিকায় রেখেছিলো শিক্ষার্থীদের মাঝে বন্টনের জন্যে। ঊনিশশো চব্বিশের জানুয়ারিতে বের হয় ‘বিতর্ক সমগ্র’। পাঞ্জেরী পাবলিকেশন্স থেকে। পাণ্ডুলিপি আরও পাঁচ বছর আগে দেওয়া হয়েছিলো। এটা মূলত কাজী শাহাদাত ভাইয়ের আগ্রহে রচিত। বইটার পাণ্ডুলিপি গোছানোর কাজে রাজনের শ্রম আছে। এটাকে আমরা বিতর্ক একাডেমির শিক্ষার্থীদের পাঠ্য হিসেবে বিবেচনা করেছিলাম। এই বইটা ছাড়াও টিআইবির প্রকাশনায় ‘বিতর্ক বিধান’ এবং সিকেডিএফ-এর প্রকাশনায় ‘বিতর্ক বীক্ষণ’ নামে দুটি বিতর্ক পুস্তিকা বের হয়। বিতর্ক বিধান সম্পাদনা করেন ইবনে আজম সাব্বির। বিতর্ক বীক্ষণ বইটি সম্পাদনা করেন কাজী শাহাদাত ভাই।

কৈশোরে দেয়ালিকা সম্পাদনা দিয়ে সম্পাদকের দায়িত্ব নিলেও অনেক বছর পরে মেডিকেল কলেজে স্যুভেনির সম্পাদনায় যুক্ত ছিলাম। দুহাজার দশ সালে প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক হিসেবে চাঁদপুর বিএমএ’র প্রকাশনা সম্পাদনা করি। এছাড়াও স্বামী স্বরূপানন্দের চরিত্রগঠন আন্দোলনের শতবর্ষ পূর্তিতে ‘শতার্ঘ্য’, চাঁদপুর রোটারী ক্লাবের ‘দ্য মেঘনা’, বিজয় মেলার প্রকাশনা, পাঞ্জেরী-দৈনিক চাঁদপুর কণ্ঠের ‘বিতর্কায়ন’, মোহনবাঁশি ছড়া উৎসবের ‘চিরকালীন ছড়া’, নির্বাহী সম্পাদকরূপে চাঁদপুর জেলা প্রশাসনের ‘ঋতি’ সম্পাদনা করি। চাঁদপুর সাহিত্য সম্মেলনের ক্রোড়পত্র সম্পাদক হিসেবেও জড়িত ছিলাম। চাঁদপুর সাহিত্য একাডেমির ‘সুবর্ণ শতক’, বঙ্গবন্ধু আবৃত্তি পরিষদের ‘জ্যোতির্ময় মুজিব’, ‘শেকড়ের ধ্বনি’ বইগুলো যৌথভাবে সম্পাদনায় যুক্ত ছিলাম। দ্বিভাষিক চাঁদপুর জেলা ব্র্যান্ডিং প্রকাশনায় সম্পাদনা পরিষদেও সংশ্লিষ্ট ছিলাম। এর পাশাপাশি জীবনদীপের নামকরণ করি। দীর্ঘায়ু নামে একটি সমবায় সমিতিরও নামকরণ এবং লোগো ডিজাইন আমি করেছি। এটি কুড়ি টাকা ফি-তে সুবিধাবঞ্চিতদের মাঝে একেক দিন একেক জায়গায় ফ্রি চিকিৎসা দিয়েছে। বিভিন্ন অনুষ্ঠান ও সেমিনারের অসংখ্য প্রতিপাদ্য, ম্যাগাজিনের নামকরণ এবং স্লোগান তৈরির ক্ষেত্রেও যুক্ত ছিলাম। কত শত যে বাণী লিখে দিয়েছি তার কোনো হিসাব নেই। দুহাজার চব্বিশের বইমেলায় অতি অল্প সময়ের মধ্যে ‘অনুনাদ’ ভাঁজপত্র সম্পাদনার দায়িত্ব পালন করি। আমাদের মেডিকেল কলেজের পঁয়ত্রিশতম ব্যাচের তিরিশ বছর পূর্তির ম্যাগাজিনের সম্পাদক হিসেবেও আমাকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। ম্যাগাজিনের নাম ছিল ‘মেঘবাড়ি’। (চলবে)

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়