সোমবার, ০১ সেপ্টেম্বর, ২০২৫  |   ৩৪ °সে
জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয় অন্যান্য

প্রকাশ : ০১ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০৯:১৫

‘মেঘনার হানি বাড়িত আইয়া লাগি গেছে, পিছন হরার মতোন জায়গা নাই’

তাবারক হোসেন আজাদ, রায়পুর (লক্ষ্মীপুর)
‘মেঘনার হানি বাড়িত আইয়া লাগি গেছে, পিছন হরার মতোন জায়গা নাই’

সারা দিন চরের জমিতে থাহি। সন্ধ্যার সময় বাড়িতে আই। কিন্তু রাইত আইলে ভয়-আতংক। কুনসুম নদীর পানি বাড়ি যায়, কুনসুম ঢেউয়ের জোরে ঘরবাড়ি ভাঙ্গি নদীতে তলাই যায়। এই ভাঙ্গনের আতঙ্কে ঘুম আসে না মেঘনা নদী সংলগ্ন চরের তীরবর্তী গ্রামের হাজারো মানুষের।

মেঘনা নদীর অবস্থান লক্ষ্মীপুরের রায়পুর উপজেলার উত্তর চরবংশী ইউনিয়নের চরঘাসিয়া গ্রামের সাজু মোল্লার মাছঘাট সংলগ্ন আশ্রয়কেন্দ্রের সামনে। একটু একটু করে পাড় ভেঙ্গে তীরবর্তী ঘরবাড়ির কাছ এসেছে নদীটি। যে কোনো সময় বাড়িঘরগুলো গ্রাস করতে পারে। অপরদিকে মেঘনার পাড় ধরে পায়ে হেঁটে যাওয়ার উপায় নেই। যে কোনো মুহূর্তে পাড়ের মাটি ধসে পড়তে পারে।

শনিবার (৩০ আগস্ট ২০২৫) বিকেলে মেঘনা নদীর ২০০ মিটার দূর থেকে সরেজমিনে ভাঙ্গনের চিত্র দেখা গেছে। মেঘনা নদীর অনেক স্থানেই বাঁধের অস্তিত্ব নেই। কোথাও এক ফুট, কোথাও দুই ফুটের মতো বাঁধ আছে। পাড় ধরে পায়ে হেঁটে যাওয়ার উপায় নেই। যে কোনো মুহূর্তে পাড়ের মাটি ধসে পড়তে পারে। পাড়ের অনেকগুলো গাছ ভাঙ্গনের কবলে নদীর পানিতে তলিয়ে গেছে। কিছু গাছ ঝুলে আছে। পাড়ঘেঁষা বাড়িগুলোর কাছে চলে এসেছে ভাঙ্গন। ভয়ের মধ্যেই লোকজন বাড়িতে বসবাস করছেন। তীরে প্রায় ১৫টি পরিবারের বাস। বংশপরম্পরায় তারা এখানে বসবাস করে আসছেন। এই ভাঙ্গনের মধ্যে আর কত দিন তারা এখানে টিকতে পারবেন, কোথায় বাড়িঘর নিয়ে সরবেন এ নিয়ে দুশ্চিন্তায় তারা। আশ্রয়কেন্দ্রের সামনের প্রায় ৫০০ থেকে ৬০০ ফুট এলাকাজুড়ে বাঁধ ধসে পড়েছে।

চরঘাসিয়া গ্রামের আবিদ মাঝি ও গৃহবধূ মরিয়ম বেগম বলেন, ‘এহন পেছন দিক থাইকা হরবার আর জায়গা নাই। নদী বাড়িত আই লাগি গেছে। ব্লক দিয়া বান দিলে রক্ষা পাইতাম পারি। মাটি দিয়া বান দিলে কোনো লাভ অইতো না। ৩০ বছরে দুইবার ঘর হরাইছি। এহন নদীত পানি বাড়লে ছেলেমেয়ে নিয়া হরি যাইতে অয়। নিরাপত্তা নাই। আতঙ্কের মধ্যে আছি। নদী ভাঙ্গার পর আর ঘুম নাই।’

একই গ্রামের লস্কর মোল্লা বলেন, ‘বাপ-দাদার আমল থাইকা এইহানে আছি। এহন ঘর থাকি ১০ ফুট দূরই আছে নদী। এবার বেশি ভাঙ্গছে। পানিয়ে বাঁধর মোর খুদিলায়। পানি বাড়ার পর যহন আবার পানি নামতে থাকে তখন ফাটা দেখা দিবো আর ভাঙ্গব। আবার ভাঙ্গন দিলে ঘর যাইবো। ঘর ভাঙ্গলে যাওয়ার জায়গা নাই।’

পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) লক্ষ্মীপুর ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, মেঘনা একটি খরস্রোতা নদী। পানির প্রায় পুরোটাই আসে সাগর থেকে। হঠাৎ করে নদীতে পানি বেড়ে যায়। এক-দুই ঘণ্টায় অনেক পানি হয়ে যায় নদটিতে। স্থায়ী প্রতিরক্ষা বাঁধ নেই। পানি বেড়ে গেলে পাড় উপচে বিভিন্ন এলাকায় ঢুকে পড়ে। বিভিন্ন এলাকার ফসল, রাস্তাঘাট, ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। দু পাড়ে বাঁধের পরিমাণ প্রায় ৪০ কিলোমিটার।

পাউবো লক্ষ্মীপুরের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. নাহিদ উজ জামান খান বলেন, ‘শুধু রায়পুরের সাজু মোল্লারঘাট এলাকা নয়, মেঘনা নদীর বাঁধের প্রায় ১০ কিলোমিটার এলাকার ভাঙ্গন খুবই ভয়াবহ। আমরা ভাঙ্গনকবলিত এলাকায় গিয়েছি। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে রিপোর্টও করেছি। কিন্তু রায়পুরে যে পরিমাণ ভাঙ্গন আছে, তাতে অস্থায়ী প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা নিলে কয়েক কোটি টাকা লাগবে। পানির মধ্যে তা টেকসই হবে না। এক-দুই বছরও টিকবে না।’।

নির্বাহী প্রকৌশলী আরও বলেন, ‘কমলনগর ও রামগতিতে ৩১ কিলোমিটার স্থায়ীভাবে বাঁধ নির্মাণের কাজ চলমান । রায়পুরে আলতাফ মাস্টার মাছঘাট এলাকার ২০০ মিটার জায়গায় জরুরি ভিত্তিতে কাজ চলমান। বালুর অভাবে গত কয়েকদিন কাজ বন্ধ রয়েছে। চাঁদপুরের চরভৈরবী এলাকা থেকে রায়পুর, সদর মজু চৌধুরী ঘাট, কমলনগর ও রামগতি এলাকার জন্যে প্রায় ৬০ কিলোমিটারের একটি প্রকল্প পানি উন্নয়ন বোর্ডে জমা দিয়েছি। এতে সম্ভাব্য খরচ কতো ধরা হয়েছে তা বলা যাচ্ছে না।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়